শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১২:০৭ পূর্বাহ্ন

প্যাশন থেকে দেশের বৃহৎ শিল্প গ্রুপে রূপান্তর

  • আপডেট সময় রবিবার, ১৪ মে, ২০২৩
১৯৮৬ সালে চট্টগ্রাম নগরীর পাহাড়তলী এলাকার রেলওয়ের সরকারি বাসার প্রাঙ্গণ থেকে শুরু হয় টুটুলের এই উদ্যোগ। তিন যুগের ব্যবধানে রাকিবুর রহমান টুটুলের এই উদ্যোগ রূপ নিয়েছে এগ্রো খাতে দেশের বৃহৎ শিল্প গ্রুপে। তার মা সামসুন নাহারের নামে প্রতিষ্ঠিত নাহার এগ্রো গ্রুপের অধীনে পোল্ট্রি, ডেইরি, ফিড মিল সহ নানা খাতে রয়েছে ১০টি কোম্পানি। দেশের বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে ৩৫টি কারখানা।

চট্টগ্রাম নগরীতে সরকারি মুরগি ফার্মের দৃশ্য রাকিবুর রহমান টুটুলকে ভীষণ আপ্লুত করতো। একসাথে শত শত মুরগির বিচরণ ভীষণ ভালো লাগতো তার। ঈদ সালামির জমানো ৯০০ টাকা দিয়ে ফাউমি জাতের ৩০০ বাচ্চা নিয়ে আসেন বাসায়। বাসার সামনে টিন দিয়ে ব্রুডিং তৈরি করে সেখানেই মুরগিগুলো পরিচর্যা শুরু করলেন সপ্তম শ্রেণীর শিক্ষার্থী ১৩ বছরের টুটুল।

২০ সপ্তাহ পর এসব মুরগি থেকে প্রতিদিন ২৮০ থেকে ২৯০টি ডিম আসা শুরু করলো। পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে আশেপাশের লোকজনের কাছে শুরু হলো ডিম বিক্রি। ১৯৮৬ সালে চট্টগ্রাম নগরীর পাহাড়তলী এলাকার রেলওয়ের সরকারি বাসার প্রাঙ্গণ থেকে শুরু হয় টুটুলের এই উদ্যোগ। তিন যুগের ব্যবধানে রাকিবুর রহমান টুটুলের এই উদ্যোগ রূপ নিয়েছে এগ্রো খাতে দেশের বৃহৎ শিল্প গ্রুপে। তার মা সামসুন নাহারের নামে প্রতিষ্ঠিত নাহার এগ্রো গ্রুপের অধীনে পোল্ট্রি, ডেইরি, ফিড মিল সহ নানা খাতে রয়েছে ১০টি কোম্পানি। দেশের বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে ৩৫টি কারখানা।

এসব কারখানায় সরাসরি কাজ করে চার হাজারের অধিক লোক। দেশের বিভিন্ন এলাকায় ১০ হাজার পোল্ট্রি খামারীদের মুরগির বাচ্চা, খাদ্য সহ বিভিন্ন কারিগরি সহযোগিতা প্রদান করছে শিল্প গ্রুপটি। নাহার এগ্রোর বর্তমান বার্ষিক টার্নওভার এক হাজার কোটি টাকা।

যেভাবে শুরু

রাকিবুর রহমান টুটুলের বাবা টিএস মাহবুবুর রহমান চট্টগ্রামে রেলওয়ের প্রকৌশলী হিসেবে চাকরী করতেন। সেই সুবাদে টুটুলের জন্ম-বেড়ে ওঠা পাহাড়তলীর রেলওয়ের সরকারি বাংলোতে। তবে গ্রামের বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ, পুকুর ভরা মাছ, হালচাষ, দুগ্ধজাত গরু, নবান্ন উৎসব ভীষণ টানতো তাকে। স্কুল বন্ধ হলেই চলে যেতেন ফেনী জেলার গ্রামের বাড়িতে। কৃষকদের সাথে চলে যেতেন ক্ষেতে। ছোটবেলা থেকেই কৃষির প্রতি তার ভালোলাগা তৈরী হয়।

যেহেতু বাইরে কোনো আড্ডায় জড়িত ছিলেন না তাই তার বাবাও মুরগির খামারের কাজে উৎসাহ দিতেন। কাজে সহযোগিতা করতেন মা সামসুন নাহার। স্কুল শেষে সহপাঠীরা যখন খেলাধুলা, দুরন্তপনায় মেতে উঠতো তখন টুটুল সময় দিতেন তার শখের খামারে।

পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে আশেপাশের এলাকায় ডিম বিক্রি শুরু করলেন টুটুল। ক্রেতাদের ইতিবাচক সাড়া তাকে আরো উদ্যমী করে তোলে।

উচ্চ মাধ্যমিকে পড়া অবস্থায় মনে হলো পরিবারে দুধের চাহিদা মেটানোর জন্য গরুর খামার করা প্রয়োজন। সেই চিন্তা থেকে ১৯৯১ সালে ১ লাখ ১০ হাজার টাকায় একটি দুগ্ধজাত গরু ক্রয় করেন টুটুল। একই বছরে ৮৭ হাজার টাকায় আরো একটি গরু কেনেন। আশেপাশের এলাকায় লোকজনের কাছে বিক্রি করা হতো দুধ। চাহিদা বাড়ায় পরের বছর ১ লাখ ৪১ হাজার আরো একটি গরু ক্রয় করা হয়। ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত বাছুর সহ ১৭টি গরু হয় খামারে।

ছবি-মোহাম্মদ মিনহাজ উদ্দিন/টিবিএস

পিতার মৃত্যুর পর আরো উদ্যোগী টুটুল

১৯৯৩ সালে ‘গোল্ডেন হ্যান্ডশেকে’র মাধ্যমে রেলওয়ে চাকরি থেকে অব্যাহতি নেন টুটুলের পিতা মাহবুবুর রহমান। অবসর নেওয়ার ছয় মাসের মধ্যে ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে ১৯৯৪ সালে তিনি মারা যান। তখন টুটুল সবে ডিগ্রী পরীক্ষা দিয়েছেন।  ছোট ভাই উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী।

পিতার মৃত্যুর পর পাহাড়তলীর সরকারি বাসা ছেড়ে জায়গা ক্রয় করে চলে আসেন দক্ষিণ খুলশীর ঝাউতলা এলাকায়। সেখানে কিছু খালি জায়গা ছিলো। ২৪০০ ব্রয়লার মুরগির ফার্ম দেন সেখানে।

পিতার মৃত্যুর পর সংসারের হাল ধরতে এই খাতে ব্যবসা বাড়াতে আরো উদ্যোগী হন টুটুল। সমানতালে চলে পড়াশোনাও। মাস্টার্সে ভর্তি হন তিনি। ছোট ভাই ভর্তি হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। ওই সময়ে ভারত থেকে গরু নিয়ে আসতেন টুটুল। কিছু গরু নিজেরা লালন-পালন করতেন। কিছু গরু বিক্রি করতেন। তখন ডেইরি ফার্ম থেকে প্রতিদিন প্রায় দুইশ লিটার দুধ উৎপাদন হতো। নিজেদের পড়াশোনা, সংসার খরচের পুরোটাই চলতো এই আয় থেকে। মূলত সংগ্রাম শুরু তখন থেকেই।

ব্যাংক ঋণে বড় হয় ব্যবসা

১৯৯৪ সালে সোনালী ব্যাংক বহদ্দারহাট শাখার ম্যানেজার মোহাম্মদ মহসিনের কাছে  ৫০ হাজার টাকা ঋণ দেওয়ার অনুরোধ করেন টুটুল। কিন্তু ব্যাংক ম্যানেজার ফার্ম পরিদর্শন করে তাকে ৫ লাখ টাকা ঋণ দেওয়ার প্রস্তাব দেন। এত টাকা ঋণ নিয়ে পরিশোধ করতে পারবেন কিনা দুশ্চিন্তায় পড়ে যান টুটুল। সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য ব্যাংক ম্যানেজার তাকে এক সপ্তাহ সময় দেন।

পরবর্তীকে সাড়ে তিন লাখ টাকা ঋণ নিয়ে আরো দুটি গরু ক্রয় করেন টুটুল । দুই বছরের মধ্যে ঋণ পরিশোধ করে আরো ৫ লাখ টাকা ঋণ নেন তিনি। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ডেইরি ফার্মে বাড়াতে থাকেন গরুর সংখ্যা। একপর্যায়ে ঝাউতলায় মুরগীর খাদ্যের একটি দোকান দেন।  চট্টগ্রামে ব্রয়লার মুরগীর চহিদা বাড়তে লাগলো। প্রায় ৭০ হাজার ব্রয়লার ও লেয়ার মুরগী হয় তার খামারে।

১৯৯৪ সালে নাহার ডেইরি, নাহার পোল্ট্রি, নাহার পোল্ট্রি ফিড নামে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু করেন টুটুল। ১৯৯৮ সালে কুমিরাতে ৪২০০ বাচ্চা দিয়ে প্যারেন্ট স্টক (বাচ্চা উৎপাদনের জন্য ডিম দেওয়া মুরগি) পালন করা শুরু করেন তিনি। ২০০২ সালে নাহার এগ্রো কমপ্লেক্স লিমিটেড কোম্পানি গঠন করা হয়। এরপর মিরসরাই, সীতাকুণ্ড, ফটিকছড়ি সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে একে একে গড়ে উঠে কারখানা।

বিপর্যয়েও থেমে যায়নি নাগার এগ্রোর পথচলা

হ্যাচারী দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে ২০০৪ সালে ফ্রান্স থেকে ৪৬ হাজার প্যারেন্ট স্টক বাচ্চা আমদানি করে নাহার এগ্রো। কিন্তু এয়ারপোর্ট পর্যন্ত আসার পর ২৬ হাজার বাচ্চা মারা যায়। এতে বড় ধরনের লোকসানে পড়ে যান রাকিবুর রহমান। ওই সময়ে আটকে যায় ব্যাংক ঋণও।

প্যারেন্ট স্টক মুরগি থেকে উৎপাদন হওয়া ডিম থেকে কিভাবে বাচ্চা উৎপাদন করবেন এ নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়ে টুটুলের। এর মধ্যে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ৭০ লাখ টাকার ঋণ আবারো আশাবাদী করে তোলে টুটুলকে। আড়াই মাসে তৈরী করে ফেলেন হ্যাচারী। ২০০৫ সালে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে প্রথম হ্যাচারীর যাত্রা শুরু হয়।

হ্যাচারী করার পরপরই ২০০৫ সালে দেশে বার্ড ফ্লু রোগের সংক্রমণ শুরু হয়। ‘বায়োসিকিউরিটি’ বজায় রাখার কারণে হ্যাচারীর বাচ্চা মারা না গেলেও বাজারে এর চাহিদা কমে যায়। বিপর্যয় নেমে আসে। উৎপাদন খরচের তুলনায় বাচ্চার দাম কমে যায়। লোকসানে পড়ে কারখানা চালানো কঠিন হয়ে পড়ে।

বর্তমানে নাহার এগ্রোর বিভিন্ন খামারে ব্রয়লার এবং লেয়ার পোল্ট্রি প্যারেন্ট স্টক মুরগী রয়েছে ১২ লাখ। এসব প্যারেন্ট স্টক মুরগীর ডিম থেকে বিভিন্ন হ্যাচারীতে প্রতি সপ্তাহে ২২ থেকে ২৪ লাখ বাচ্চা উৎপাদন হয়। এছাড়া ডেইরি খামারে দুগ্ধজাত, প্যাটেনিং সহ গরু আছে ১৭০০টি। প্রতিদিন ৫৫০০ থেকে ৬ হাজার লিটার দুধ উৎপাদন হয়।

মিরসরাই, সিরাজগঞ্জ, যশোরে ৪টি ফিড মিল রয়েছে নাহার এগ্রোর। প্রতি মাসে উৎপাদন সক্ষমতা ৬০ হাজার মেট্রিক টন। নিজেদের খামার এবং বাজারজাতকরণের জন্য প্রতি মাসে ৩০ হাজার মেট্রিক টন ফিডমিল উৎপাদন হচ্ছে। এর মধ্যে ২০ শতাংশ নিজেদের খামারে ব্যবহৃত হয়। বাকি ৮০ শতাংশ বাজারজাত করা হয়।

নাহার এগ্রো মুরগির বাচ্চা, ফিড এবং অন্যান্য কারিগরি সহযোগিতা দেয় প্রায় ১০ হাজার পোল্ট্রি খামারিকে। ৫০০ থেকে ৫ হাজার মুরগীর খামার রয়েছে এসব উদ্যোক্তাদের।

নাহার এগ্রো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাকিবুর রহমান টুটুল বলেন, “দেশে প্রোটিন এবং আমিষের চাহিদা পূরণ করে মেধাবী জাতি গঠনে কাজ করা আমার স্বপ্ন।”

তিনি বলেন, “টিকে থাকার জন্য কোম্পানির পরিচালন ব্যয় কিভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় আমরা সেই প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখি। ব্যবসায়িক ধারা অব্যাহত রাখতে নিজেরাই অনেক পরিশ্রম করছি। আমার সন্তানরাও এখন কোম্পানির হাল ধরেছে। কঠোর পরিশ্রম করছে। ব্যবসায় লাভ হলে সেটি দিয়েই আমি পুনর্বিনিয়োগের চেষ্টা করি।”

নাহার এগ্রো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাকিবুর রহমান টুটুল বর্তমানে চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক এবং বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি ব্রিডারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (২০১৭-২০২১) সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া রাকিবুর রহমান ভাটিয়ারি গলফ এন্ড কান্ট্রি ক্লাব, চট্টগ্রাম ক্লাব লিমিটেড, শাহীন গলফ এন্ড কান্ট্রি ক্লাব সহ বিভিন্ন সেবামূলক সংগঠনের সাথে যুক্ত আছেন।

রাকিবুর রহমান টুটুল ২০২১ সালে মিনিস্ট্রি অব ফিশারিজ এন্ড লাইভস্টক কর্তৃক ‘ডেইরি আইকন’, ‍২০২২ সালে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড চ্যানেল আই কর্তৃক ‘সেরা কৃষিক’, এবং ২০২২ সালে বেস্ট ক্যাটল ফার্ম কর্তৃক ‘এসিআই দীপ্ত কৃষি অ্যাওয়ার্ড’ পান।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com