শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:১০ পূর্বাহ্ন
Uncategorized

পেগাসাস স্পাইওয়্যার যেভাবে ‘কূটনীতির অস্ত্র’ হয়ে ওঠে

  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ২০ জুলাই, ২০২১

মাত্র কয়েক বছর আগেও ইসরায়েলের সঙ্গে সৌদি আরবের বৈরী সম্পর্ক নিয়ে খুব অল্পসংখ্যক মানুষই সন্দেহ পোষণ করতেন। আনুষ্ঠানিকভাবে দুই দেশের মধ্যে কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল না। এর মধ্যে এক গ্রীষ্মে সৌদি কর্মকর্তারা গোপনে ভিয়েনা, সাইপ্রাস ও রিয়াদে ইসরায়েলি ব্যবসায়ীদের ছোট একটি দলের সঙ্গে বৈঠক করেন। এরপর থেকেই দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কোন্নয়নের ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

ইসরায়েলি ওই ব্যবসায়ীরা এসব বৈঠকে দেশটির প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এনএসও গ্রুপের প্রতিনিধিত্ব করেন। তাঁদের লক্ষ্য ছিল সৌদি আরবের কাছে এনএসও–এর পেগাসাস স্পাইওয়্যার বিক্রি করা। এখন এই স্পাইওয়্যার নিয়েই বিশ্বজুড়ে আলোচনা চলছে। ৫০টির বেশি দেশে ইসরায়েলি কোম্পানির এই স্পাইওয়্যার ব্যবহার করে হাজার হাজার মানুষের স্মার্টফোনে আড়ি পাতা হয়েছে।

এসব ব্যক্তির তালিকায় রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, লেখক–গবেষক, এনজিও কর্মী, সরকারি কর্মকর্তা, মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টরাও রয়েছেন। এনএসও গ্রুপের একটি তথ্যভান্ডারে সংরক্ষিত ৫০ হাজার ফোন নম্বর ফাঁস হয়েছে। সেগুলো নিয়ে কয়েক মাস ধরে অনুসন্ধান চালিয়ে স্পাইওয়্যার ব্যবহার করে স্মার্টফোনে আড়ি পাতার এই ঘটনা প্রকাশ করেছে ১৭টি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম।

এখন দেখা যাচ্ছে, বিশ্বের বিভিন্ন কর্তৃত্ববাদী সরকারকে ফোনে নজরদারির এই প্রযুক্তি সরবরাহ করার মধ্য দিয়ে কূটনৈতিক সম্পর্কেরও উন্নতি ঘটিয়েছে ইসরায়েল। ফিলিস্তিনিদের দমন–নির্যাতনের জন্য মুসলমানদের ক্ষোভের মুখে থাকা ইসরায়েল সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গেই সম্পর্কের উন্নতি ঘটিয়েছে।

২০১৭ সালের জুনে সাইপ্রাসে সৌদি আরবের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ইসরায়েলি ব্যবসায়ীদের যে বৈঠক হয়, সেখানে উপস্থিত একজনের সঙ্গে কথা হয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানের। তাঁর ভাষ্যমতে, পেগাসাস স্পাইওয়্যার নিয়ে উপস্থাপনা দেখে সৌদি আরবের একজন জ্যেষ্ঠ গোয়েন্দা কর্মকর্তা বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন।
সেখানে দীর্ঘ আলোচনায় স্পাইওয়্যারের কারিগরি দিক তুলে ধরা হয়। পরে সৌদি গোয়েন্দা কর্মকর্তার নতুন আইফোনে দেখানো হয় কীভাবে পেগাসাস স্পাইওয়্যার ঢুকিয়ে দূর থেকে ফোনের ক্যামেরা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এটা দেখে ওই কর্মকর্তারা একই সঙ্গে বিস্মিত ও আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছিলেন। তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন, এই অস্ত্রই তো তাঁদের দরকার।

নিজেদের দেশে তৈরি এই হ্যাকিং টুল সৌদি আরবের কাছে বিক্রির চেষ্টা করতে এনএসও গ্রুপকে অনুমতি দিয়েছিল ইসরায়েল সরকার। গোপনে কয়েক দফা বৈঠকের পর কমপক্ষে সাড়ে ৫ কোটি ডলার দিয়ে স্পাইওয়্যারটি কিনেছিল সৌদি সরকার।

ওই ব্যক্তির ভাষ্যমতে, সে সময় ইসরায়েলে ব্যবসার মধ্য দিয়ে কূটনীতিকে এগিয়ে রাখার পক্ষে জোরালো রাজনৈতিক অবস্থান ছিল। ‘ব্যবসা প্রথম, তারপর কূটনীতি’ নীতি নিয়েছিল তারা। এই নীতির পক্ষে যুক্তি ছিল, যখন তুমি একসঙ্গে কোনো চুক্তি করবে, তখন কূটনীতির অনেক দরজা খুলে যাবে।

এদিকে ইসরায়েলের একদল সাবেক সাইবার গোয়েন্দা কর্মকর্তার হাত ধরে গড়ে উঠেছিল এনএসও গ্রুপ। দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ ছিল তাদের। কোন কোন দেশকে পেগাসাস স্পাইওয়্যার দেওয়া যাবে, আর কাদের দেওয়া যাবে না, সেই সিদ্ধান্ত ইসরায়েল সরকারের কাছ থেকেই আসত।

এর প্রমাণ পাওয়া যায় সম্প্রতি প্রকাশিত এনএসও গ্রুপের একটি প্রতিবেদনে। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, কোনো দেশের কোনো সংস্থাকে পেগাসাস স্পাইওয়্যার ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ার আগে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ডিফেন্স এক্সপোর্ট কন্ট্রোল এজেন্সি (ডিইসিএ) তাদের মানবাধিকার রেকর্ড খতিয়ে দেখে। তারপরই লাইসেন্স দেওয়া হয়।

গ্রাহক যাচাই–বাছাইয়ের এই প্রক্রিয়াকে এনএসও গ্রুপের মধ্যেও দেখা হয় ‘রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা’ হিসেবে। এই প্রক্রিয়া সম্পর্কে অবগত একজনের ভাষ্যমতে, কারও কাছে পেগাসাস স্পাইওয়্যার বিক্রির জন্য ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ এবং প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের সম্মতি নিতে হয়। সে জন্য ওই দুই দপ্তরের কর্মকর্তাদের বিষয়টি আগেই জানানো হয়ে থাকে।
সৌদি আরবের কাছে গোয়েন্দা নজরদারির এই অস্ত্র বিক্রির প্রক্রিয়া সম্পর্কে অবগত একজন জানান, সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ডের পর ২০১৮ সালে কয়েক মাস সৌদি আরবকে পেগাসাস স্পাইওয়্যার ব্যবহার করতে দেওয়া হয়নি। তাদের এই সেবা বন্ধ করে দিয়েছিল এনএসও গ্রুপ। পরে ইসরায়েল সরকারের হস্তক্ষেপে ২০১৯ সালে আবার সৌদি কর্তৃপক্ষকে স্পাইওয়্যারটি ব্যবহার করতে দেওয়া হয়।

ফরেনসিক বিশ্লেষণে যেসব দেশে পেগাসাস স্পাইওয়্যার ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে, সেগুলোর মধ্যে ১০টি দেশের সঙ্গে ইসরায়েলের বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে বা সাম্প্রতিক সময়ে কূটনৈতিক সম্পর্কের উন্নতি ঘটেছে।
১৯৪৮ সালে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত আরব দেশগুলোর মধ্যে মাত্র দুটি দেশের সঙ্গে তাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। ১৯৭৯ সালে মিসর আর ১৯৯৪ সালে জর্ডানের সঙ্গে ইসরায়েলের শান্তি চুক্তি হয়। সেখানে ২০২০ সালেই আরবের চার দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, সুদান ও মরক্কোর সঙ্গে এই ইহুদি রাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।

টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের সিটিজেন ল্যাব ফোন নম্বরের ফরেনসিক বিশ্লেষণের ভিত্তিতে পেগাসাস স্পাইওয়্যার ব্যবহার করা হয়ে থাকতে পারে এমন ৪৫টি দেশের নাম প্রকাশ করেছে। সেই সব দেশের তালিকায় সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও মরক্কোর নাম রয়েছে।

এনএসও–এর গ্রাহক তালিকায় রয়েছে ভারত ও হাঙ্গেরি। ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে দেশ দুটির প্রধানমন্ত্রীদের বৈঠকের পরই ওই সব দেশে পেগাসাস স্পাইওয়্যারের ব্যবহার শুরু করা হয়েছে বলে দেখা গেছে।

২০১৭ সালে হাঙ্গেরিতে দেশটির প্রধানমন্ত্রী ভিক্তর আরবানকে পাশে রেখে এক সংবাদ সম্মেলনে নেতানিয়াহু বলেছিলেন, ‘কোন কোন যন্ত্র কাজের, তা বাজারই ঠিক করে দেয়, আমি ঠিক করি না। মাত্র একটি জায়গায় আমি হস্তক্ষেপ করেছি, তা হলো সাইবার নিরাপত্তা।’
এদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ২০১৭ সালের ইসরায়েল সফরেই দেশটিতে পেগাসাস স্পাইওয়্যার ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ার বিষয়ে রফা হয়েছিল বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। ভারতের প্রথম কোনো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ওই বছরের জুলাই মাসে ইসরায়েলে যান নরেন্দ্র মোদি। ফরেনসিক বিশ্লেষণে ভারতের বেশ কয়েকজন নাগরিকের ফোনে পেগাসাস স্পাইওয়্যার দিয়ে নজরদারি চালানোর প্রমাণ পাওয়া গেছে। নজরদারির জন্য এসব নম্বর বাছাই নরেন্দ্র মোদির ওই সফরের কাছাকাছি সময়ে ঘটেছিল বলে গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম টেলিগ্রাফ লিখেছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর হাইফা সৈকতে খালি পায়ে হাঁটার একটি ছবি টুইটারে দিয়েছিলেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী। ছবির ক্যাপশনে তিনি লিখেছিলেন, ‘বন্ধুদের সঙ্গে সৈকতে যাওয়ার মতো আনন্দের আর কিছু নেই!’

এখন নতুন করে একটি বিষয় অনেক দেশের নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তা হলো দেশে দেশে এনএসও গ্রুপের স্পাইওয়্যার ব্যবহার করে যেসব তথ্য সংগ্রহ করা হয়, সেগুলো ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো পেয়ে থাকতে পারে। ওই কোম্পানির সংশ্লিষ্ট একজন নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেছেন, এ বিষয়ে আলোচনা রয়েছে। এনএসও–এর গ্রাহকেরা যেসব তথ্য সংগ্রহ করে, সেগুলো ইসরায়েল দেখতে পায় কি না, সে প্রশ্নের জবাবে তিনি গার্ডিয়ানকে বলেন, ‘আমেরিকানরাও সে রকমটাই মনে করেন।’

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ও বর্তমান গোয়েন্দা কর্মকর্তারাও এমনই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। ওয়াশিংটন পোস্টকে তাঁরা বলেছেন, এসব নজরদারির টুল ব্যবহার করে সংগৃহীত তথ্য ‘ব্যাকডোর’ দিয়ে ইসরায়েল পেয়ে থাকে বলে সন্দেহ আগে থেকেই রয়েছে।
টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের সিটিজেন ল্যাবের জ্যেষ্ঠ গবেষক জন স্কট–রেইলটন বলেছেন, এটা দিয়ে কী করা হচ্ছে, সে বিষয়ে জানতে পারার সক্ষমতা ছাড়া পেগাসাসের মতো এত শক্তিশালী নজরদারির টুল ব্যাপকভাবে কোনো দেশে ব্যবহার করতে দেওয়াটা ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’ কাজ বলেই তিনি মনে করেন। তাঁর ভাষ্যমতে, আদালতের নথিতে দেখা গেছে, এনএসও এমন সার্ভার ব্যবহার করেছে, যেগুলো গ্রাহকের এলাকায় বসানোর দরকারই হয়নি।

নিজেদের দেশের জনগণের ওপর নজরদারি চালানোর অস্ত্র পেতে যাঁরা ইসরায়েল সরকারের সঙ্গে ভাব জমিয়েছিলেন, সেই অস্ত্রের মাধ্যমেই তাঁদের তথ্য যদি ওই দেশের গোয়েন্দাদের কাছে উন্মুক্ত হয়ে যায়, তাহলে তার সমাধান কীভাবে হবে, সেটাও এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।

তথ্যসূত্র: গার্ডিয়ান, ওয়াশিংটন পোস্ট, দ্য টেলিগ্রাফ, কাউন্সিল অন ফরেন অ্যাফেয়ার্স, আল–জাজিরা

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com