মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ০৪:৩৭ অপরাহ্ন
Uncategorized

পুরান ঢাকার সাকরাইন উৎসব

  • আপডেট সময় সোমবার, ১২ জুলাই, ২০২১

চৌদ্দ জানুয়ারী পুরান ঢাকার আকাশ থাকে ঘুড়িদের দখলে। আকাশ জুড়ে নানান রং আর বাহারের ঘুড়িদের সাম্যবাদ। এক সপ্তাহ ধরে পুরান ঢাকার বাহান্ন রাস্তা তেপান্ন গলির অধিকাংশ গলিতে আর খোলা ছাদে চলে সুতা মাঞ্জা দেওয়ার ধুম। শীতের উদাস দুপুর আর নরম বিকালে আকাশে উড়বে নানান রঙের ঘুড়ি। এদিন আকাশে উড়ে চোখদ্বার, মালাদ্বার, পঙ্খীরাজ, চশমাদ্বার, কাউঠাদ্বার, চাপালিশ, চানদ্বার, এক রঙা ইত্যাদি ঘুড়ি। এমনকি জাতীয় পতাকার রঙেও ঘুড়ি তৈরি করা হয়। তবে ঘুড়ির চেয়েও সুন্দর হয় এর লেজ। লেজ অনেক আকৃতির ও রঙ বেরঙ এর হয়ে থাকে। ঘুড়ির সঙ্গে সঙ্গে নাটাইগুলোর নামও বেশ মজাদার। বাটিওয়ালা, মুখবান্ধা, মুখছাড়া ইত্যাদি। পাতলা ঘুড়ি ভালো হলেও নাটাই যত ভারী হবে ঘুড়ি উড়াতে তত ভালো হয়।

সাকরাইন উৎসব

পৌষ সংক্রান্তি পুরনো ঢাকার একটি ঐতিহ্যবাহী দিন। এ দিন পুরনো ঢাকার দয়াগঞ্জ, মুরগীটোলা, কাগজিটোলা, গেন্ডারিয়া, বাংলাবাজার, ধূপখোলা মাঠ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, সদরঘাট, কোটকাচারী এলাকার মানুষ সারাদিন ব্যাপি ঘুড়ি উড়ায়, খাবার এর আয়োজন করে, সন্ধ্যা আগুন নিয়ে খেলে আর ফায়ারওয়ার্ক্স তো থাকেই । সন্ধ্যা থেকে ফায়ারওয়ার্ক্সের লাল নীল আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে পুরানো ঢাকা। তারা তাদের এলাকার সবচেয়ে বড় ভবনকে বেছে নেয় ঘুড়ি উড়ানোর জন্য। সেখানে বন্ধু ও আত্মীদয়রা মিলে ১২-১৫ জন ঘুড়ি উড়ায়, কিন্তু বাড়ীর নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ সবাই ছাদে উঠে তাদেরকে উৎসাহ দেয়। চৌদ্দ জানুয়ারী পৌষ মাসের শেষ দিন। পৌষ সংক্রান্তির দিনই পালিত হয় পুরান ঢাকার এবং আদি ঢাকাইয়াদের ঐতিহ্যের সাকরাইন উৎসব। প্রতিবছর ১৪ বা ১৫ই জানুয়ারী পৌষের শেষ দিনে পৌষ সংক্রান্তিকে ঘিরে লোকজন ঘুড়ি উৎসবে মেতে ওঠে।

ঢাকায় এই উৎসব হচ্ছে প্রায় ৪০০ বছর ধরে। বাংলাদেশের পুরানো ঢাকায় ঘুড়ি ওড়ানো বিনোদন শুরু হয়েছিল মুঘল আমলে। কথিত আছে, ১৭৪০ সালে নবাব নাজিম মহম্মদ খাঁ এই ঘুড়ি উৎসবের সূচনা করেন। সেই থেকে এই উৎসব পালিত হয়ে আসছে। এই ঘুড়ি উৎসব পশ্চিম ভারতের গুজরাটেও পালিত হয়। সেখানে মানুষ সুন্দর সুন্দর ঘুড়ির মাধ্যমে সূর্যদেবতার কাছে নিজেদের ইচ্ছা ও আকুতি প্রেরণ করেন। উত্তর ভারতীয় এ ঘুড়ি উৎসবটিকে স্থানীয়রা ‘সাকরাইন’ নামে অভিহিত করে। পুর্বে এই উৎসব হতো খোলা মাঠে এবং এই উৎসবকে কেন্দ্র করে মাঠে প্রচুর লোক সমাগম ঘটত। বর্তমানে মানুষ বাসাবাড়ীর ছাদে উঠে ঘুড়ি উড়ায়। এ উৎসবে তারা চিকন সূতা দিয়ে পাতলা কাগজের ঘুড়ি উড়ায়। এ উৎসবে সাধারণত ঘুড়ি উড়ানোর চাইতে অন্যের ঘুড়ির সাথে প্রতিযোগিতা করা হয় বেশী। এ প্রতিযোগিতা হয় মূলত সূতায় সূতায় প্যাচ লাগিয়ে।

স্থানীয় ভাষায় একে বলে কাটাকাটি। কাটাকাটির পর বিজয়ী ঘুড়ি আকাশে উড়তে থাকে আর হেরে যাওয়া অর্থাৎ কেটে যাওয়া ঘুড়ি বাতাসে দুলতে দুলতে দুরে মিলিয়ে যায়। আর ভাগেটটা হওয়া ঘুড়ি পেতে এলাকার অপেক্ষাকৃত ছোটরা লগি নিয়ে ঘুড়ে বেড়ায়। তারা চিকন মুলিবাঁশ দিয়ে ঘুড়ির সূতা পেঁচিয়ে ঘুড়ি নিচে নামিয়ে আনে। এই চিকন বাঁশকে লগি বা লগগি বলে। তারা প্রথম দিন ঘুড়ি ধরে জমায় এবং দ্বিতীয় দিন এ ঘুড়িগুলো উড়ায়।

আতশবাজি

এ প্রতিযোগিতায় সুতাটাই প্রধান। এ সুতাকে মজবুত ও ধারাল করার জন্য যে ব্যবস্থা করা হয় তাকে মাঞ্জা বলে। সুতা ২-৩ ঘণ্টা লেইতে ভিজিয়ে রাখা হয়। লেই বা ল্যাদ্দি তৈরী করা হয় শিরিষ (যা ল্যাদ্দি কে আঠালো করে), রঙ (সুতা কি রঙ এর হবে সেই গুড়া রঙ), বার্লি, ডিম, বিভিন্ন ডালের কষ, ভাতের মাড় ইত্যাদির সংমিশ্রন ঘটিয়ে। ২-৩ ঘণ্টা পর রিল থেকে সুতা নাটাইয়ে প্যাচিয়ে রাখা হয়। শিরিষের আঠার জন্য সুতার সঙ্গে সুতা যেন না লেগে যায় তার জন্য রিল থেকে নাটাইয়ে সুতা যাওয়ার মধ্যপথে দুই জন সুতায় চূর লাগিয়ে দেয়। এ চূর তৈরী করা হয় কাচের গুরা দিয়ে। মাঞ্জা দেয়া শেষ হলে এ সুতা শুকানোর জন্য সমস্ত সুতা ছেড়ে দিয়ে ঘুড়ি ওড়ানো হয়। এ সময় তারা কারো সঙ্গে কাটাকাটি খেলে না। তাই তারা সাকরাইনের ৩-৪ দিন পূর্বে মাঞ্জা দেয়। মাঞ্জার গুনাগুনের উপর নির্ভর করে প্রতিযোগিরা একজন আরেকজনকে টানে অথবা ছোড়ে (ঢিল), কোন পদ্ধতিতে পরাজিত করবে।

সাকরাইন উৎসব, ঘুড়ি

ঘুড়ি তৈরী করা হয় পাতলা কাগজ বা পলিথিন দিয়ে। ছোটরা পলিথিনের ব্যাগ কেটে নারকেল পাতার শলা দিয়ে ঘুড়ি তৈরী করে। আর বড়দের জন্য দোকানিরা পাতলা কাগজ দিয়ে ঘুড়ি তৈরী করে এবং এর আকৃতি দেয়া হয় বাঁশের পাতলা চটি দিয়ে। পুরান ঢাকার ঘুড়ি প্রেমীরা সারাদিন ঘুড়ি উড়িয়ে সন্ধ্যায় সকল ঘুড়ি, নাটাই, সুতা, লগি সকল উপকরণ দিয়ে আগুন জ্বালায়। এসময় তারা আতশ বাজী পোড়ায় ও মুখে কেরোসিন তেল নিয়ে আগুন দিয়ে চমৎকার এক ধোঁয়ার কুণ্ডলী তৈরী করে, যা গোল হয়ে আকাশের দিকে উড়ে যায়। অতীতে সাকরাইনে পুরান ঢাকায় শ্বশুরবাড়ি থেকে জামাইদের নাটাই, বাহারি ঘুড়ি উপহার দেওয়া এবং পিঠার ডালা পাঠানো ছিলো অবশ্য পালনীয় অংগ।

ডালা হিসেবে আসা ঘুড়ি, পিঠা আর অন্যান্য খাবার বিলি করা হতো আত্নীয়-স্বজন এবং পাড়ার লোকদের মধ্যে। নীরব প্রতিযোগিতা চলতো কার শ্বশুরবাড়ি হতে কত বড় ডালা এসেছে। আজ এই সব চমৎকার আচারগুলো বিলুপ্ত হতে চলেছে। স্বপ্ন দেখি এই সকল প্রাণময় ঐতিহ্যগুলো আবার নতুন করে পুনরুজ্জীবিত হবে।

লেখা: সুফিয়া আহমেদ

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com