কাশ্মিরের জজিলা পাস ও জজিলা জিরো পয়েন্ট ভ্রমনঃ
একবার শিক্ষা সফরে গিয়ে মেডিকেলের এক সহপাঠি পাহাড় দেখে আবেগে বলেছিল ‘পাহাড় দেখিলে তাহার কথা মনে পরে -।’ এরপর এ কথাটা ঘুরেফিরে ক্যাম্পাসে বেশ চালু ছিল। কাশ্মিরের লাদাখ ভ্রমনে জজিলা গিরিপথে (Zojila pass) অসংখ্য পাহাড় দেখে ‘কাহার কথা’ মনে পরেছিল মনে নেই তবে ভয়ংকর সেই ভ্রমনে নিজের নামটাও যে আমি ভুলে গিয়েছিলাম তাতে সন্দেহ নেই।
সেই ভ্রমন অভিজ্ঞতা লিখার আগে জম্মু কাশ্মিরের লাদাখ সম্পর্কে একটু জেনে নেই। লাদাখ বা লা – দ্বাগস (তিব্বতি শন্দ) অর্থ ‘গিরিবর্ত্বের দেশ’ । ভারতের জম্মু ও কাশ্মির রাজ্যের অন্তর্গত কুনলুলু ও হিমালয় পর্বত ঘেরা এ অঞ্চল। লেহ ও কারগিল জেলা নিয়ে লাদাখ গঠিত। কাশ্মিরের সবচেয়ে জনবিরল এলাকার মধ্যে একটি। লাদাঘ তিব্বতী সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত অঞ্চল। মুসলিম বা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বিদের সংখ্যা প্রায় সমান সমান। এদের ভাষা উর্দু ও লাদাখি ভাষা।
২-১০-২০১৮ এর এক মনোরম ভোর । ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু , দুস্তর পারাবার —- ‘ বানীতে উদ্দীপ্ত পাঁচ সদস্যের আমাদের ভ্রমণ দল শ্রীনগর থেকে লাদাখের কারগিলের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। প্রথমে আমাদের যেতে হবে কারগিলের সোনমার্গ ও পরে মুল গন্তব্য জজিলা জিরো পয়েন্টে যা শ্রীনগর থেকে ২৫০ কি মি এবং সোনমার্গ থেকে ২৫-৩০ কিমি দূরে।
অক্টোবরের সবে শুরু। এর মধ্যেই বেশ শীত পরেছে। আমাদের গায়ে ভারী শীত পোশাক। নভেম্বর পরবর্তী ছ’মাস এ অঞ্চল ৫০- ১০০ ফুট বরফে ঢাকা থাকে। এখানে সেসময় সকল চলাচল বন্ধ থাকে।
আমরা সোনমার্গ জীপ স্ট্যান্ড থেকে ৬০০০ রুপি ভাড়ায় পাহাড়ি পথের জন্য নির্ধারিত একটি ছোট জীপে উঠে বসি। এই ভ্রমনের ভ্রামনিকরা সকলেই প্রায় পঞ্চাষোর্ধ। বয়স যাই হউক ‘আমরা নবীন দল’ পৃথিবীর অন্যতম এক উঁচু গিরিশৃংগে ভ্রমনে যাচ্ছি। আমরা রোমাঞ্চিত, উত্তেজিত!!
আমাদের যাত্রা শুরু হয়ে গেছে। হিমহিম বাতাসে চুল উড়ছে, চশমার কাঁচ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। আমরা প্রতীক্ষিত জজিলা পাসে উঠছি। গাড়ি চলতে চলতে তাহলে জজিলা পাস বা জজিলা গিরিপথ সম্পর্কে জেনে নেই একটু। প্রথমেই বলি এটি পৃথিবীর প্রথম দশটি বিপদজনক পথের একটি। এবং এশিয়ার মধ্যে এক নম্বর। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এই গিরিপথের উচ্চতা প্রায় ১৩০০০ ফুট। পাহাড় কেটে তৈরী এই জজিলা পাসের দৈর্ঘ্য ২৫ – ৩০ কি মি।
গিরিপথটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, উচ্চতাজনিত স্বাস্থ্যগত সমস্যা সৃস্টি করতে পারে অনেকের এবং কিছুটা ব্যয় বহুল হবার কারনে এখান পর্যটক সংখ্যা একটু কম। হাজারো মৃত্যুফাঁদ পাতা সূক্ষ আঁকাবাঁকা কত ভয়ংকর ওখানে না গেলে কেউ তা কল্পনা করতে পারবে না।
জজিলা গিরিপথ কিন্তু যথেষ্ট সরু। দুটো গাড়ি পাশাপাশা চলতে পারে না। নুড়ি পাথর বিছানো পথে খানা খন্দকও আছে। মাঝে মাঝে বেকায়দা ঝাঁকুনি সেটাই জানান দেয়। আমাদের গাড়ির ড্রাইভার আনুমানিক ২৫ বছর বয়সী এক ঝকঝকে তরুন। শরীরে অপুষ্টির ছাপ। পরনে মলিন পাতলা জ্যাকেট, জীর্ণ কান টুপি। কি নিপুন দক্ষতায় অল্প বয়সী এই ছেলেটি এই কঠিন পথে গাড়ি চালাচ্ছে শান্তভাবে সেটাও দেখবার বিষয়।
ক্রমশ: সমতল ভূমি থেকে সর্পিল পাহাড়ের বাঁক বেয়ে বেয়ে গাড়ি উপরে উঠছে। উঠছে তো উঠছেই। গভীর খাদ পাশেই। খাদের একদম কিনার ঘেঁষে গাড়ির চাকা। ইঞ্চিখানেক এদিক ওদিক হলেই একদম গভীর খাদে ! আমার পাশে বসেছে ছোট বোন সুমি, তার পাশে বড় খালা মুক্তি, পিছনে ছোট খালা তৃপ্তি। ড্রাইভারের পাশে ছোট খালু। সমস্ত পথ আমার দুই খালা প্রায় চোখ বন্ধ করে ভয়ে সিঁটিয়ে রইলেন।
এর মাঝেই দেখছি দুইপাশের অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। পাহাড়, খরস্রোতা নদী, পাথর, অরন্য, খাদ সব মিলিয়ে অপুর্ব ছবি ! সাঁই সাঁই গাড়ি ছুটছে। মনে হচ্ছে বুঝি রোলার কোস্টারে চড়েছি আমরা।
মুক্তি খালা উর্দু বাংলা মিশিয়ে আর্তনাদ করে উঠছেন কিছুক্ষন পরপর ‘আর কতোদূর, যাব না আমি , আমায় নামিয়ে দাও –‘। বিকারহীন জীপ চালক হিন্দি গান বাজিয়ে মৃদু মাথা নাড়ে আর গাড়ির গতি যেন আরো বাড়িয়ে দেয়।
সাধারনত আমাদের এই ভ্রমন দল বেড়াতে গেলে পথে সমস্বরে গান ধরে। ক’দিন আগেই কলকাতা থেকে শান্তিনিকেতন যেতে পথটুকুতে ‘বিস্ময়ে তাই জাগে, জাগে আমার গান –, গ্রাম ছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ –” কত সুর ছড়িয়ে এলাম। আর আজ গান তো দুরের কথা কেউ একটু কথা বলে উঠলেই খালা সুরা পড়া বন্ধ করে কটকট করে তাকাচ্ছেন।
সবাই শক্ত করে গাড়ির হ্যান্ডেল ধরে বসে। এক্ষুনি যেন ছিটকে পরে যাব খাদে। জীবন মৃত্যুর রোমাঞ্চ নিয়ে আমি আর সুমি কিন্তু বেশ উপভোগ করছি এই দুর্ধর্ষ ভ্রমন। দু একটা টুরিস্ট ও আর্মি জীপ আসছে। উপর থেকে দেখে মনে হচ্ছে যেন খেলনা গাড়ি!
যত উপরে উঠছি পথ ততো বিপদজনক মনে হচ্ছে। আমার দুই খালা এর মধ্যে প্রায় অর্ধ মুর্ছা! পিছন থেকে মিহি সুরের বিলাপ শোনা গেল ‘ ড্রাইভার গাড়ি থামাও , যাবো না, আল্লা গো।’ সামনের সীটে বসা খালু ধমক দিয়ে ওঠেন। আবার একটু বাঁক বা ঝাঁকি, আবার মিহি কান্না, আবার ধমক। এই কোরাস বেশ খানিকক্ষন চলে। আমি পানির বোতল ছোট খালাকে এগিয়ে দিতে গিয়ে একবার ধমকও খেলাম। আমরা দুই ‘কন্যা সাহসিকা’ বোন হাসি চেপে রাখি। এ ওর গায়ে চিমটি কাটি।
অবশেষে বেলা প্রায় ১১টায় পৌঁছালাম জজিলা জিরো পয়েন্টে। মেঘ কেটে তখন ঝকঝকে রোদ উঠেছে । উপত্যকা আর পাহাড় জুড়ে নানা বর্ণের নাম না জানা ছোটবড় গাছ। অরন্য ঘেরা পাহাড় নীল আকাশে হেলান দিয়ে আছে সম্রাজ্ঞির মতন।
পাহাড় চূড়ায় জমে আছে শুভ্র বরফ মুকুট । সূর্যরশ্মিতে চিকমিক সেই বরফ কুচি হাজার বাতির আতশবাজি জ্বেলে আছে উপত্যকা জুড়ে। আমরা পথের ক্লান্তি, ভয় ভুলে যাই মুহুর্তে। উপত্যকায় অল্প সংখ্যক পর্যটকও ঘুরাঘুরি করছে। চা, বিস্কুটের ছোট ছোট দোকান আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে।
ঐতিহাসিক কারগিল যুদ্ধে মৃত সৈনিকদের স্মরনে মনুমেন্ট রয়েছে এখানে। আছে রঙিন টিনের চাল ছাওয়া আর্মি ক্যম্প । পতপত করে উড়ছে ভারতীয় পতাকা। জলপাই রঙ ভারতীয় সেনা বাহিনীর উপস্থিতি চারিদিকে। এই জিরো পয়েন্ট সীমান্তে ভারত ও পাকিস্তানি সৈন্যদের মধ্যে প্রায়ই সংঘর্ষ ঘটে। পরিবেশটায় কেমন থমথমে গা ছমছম ভাব আছে।
আমরা কারগিল যুদ্ধের যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে আছি – ভাবতেই অন্যরকম অনুভুতি হলো। এখানেই সংঘটিত হয়েছিল ভারত – পাকিস্তান মধ্যকার ঐতিহাসিক ‘কারগিল যুদ্ধ’। যে জজিলা পাস অতিক্রম করে আমরা এলাম সেই পথে দিয়েই যুদ্ধের সময় কাশ্মির থেকে অস্ত্র ও সৈন্যদের খাবার দিয়ে যাওয়া হত ।
জিরো পয়েন্টের ওপারে পাকিস্তানের অংশ-আজাদী কাশ্মীর( মুজাফফরবাদ) মাত্র ৭ কিমি দূরে। এপারে ভারতীয় অংশ জম্বু- কাশ্মীর। মাঝখানে নীল পানির খরস্রোতা সিরু নদী। সিরু একটি উপনদী যা কারগিলে প্রবাহিত হয়ে পাকিস্তানের সিন্ধু নদে মিলিত হয়েছে।
রুপসী সিরু নদীর দুই পাড়ে বিশাল বিশাল পাথরের স্তুপ। তাতে আছড়ে পরছে প্রমত্ত ঢেউ। এইসব নদি, আকাশ, পাহাড় – এরা সীমানা দ্বন্দ বোঝে না, বোঝে না বিভেদ। মানুষই কেবল দেশে – দেশে, জাতিতে- জাতিতে, ধর্মে – ধর্মে বিভাজন খোঁজে, বিভেদ সৃস্টি করে। তাই এতো অস্ত্র, যুদ্ধ, রক্তক্ষয়। এইতো কিছুদিন আগেই লাদাখে হয়ে গেল চীন ভারত মধ্যকার স্মরনকালের রক্তক্ষয়ি সংঘর্ষ।
থেমে নেই আমাদের ক্লান্তিহীন ফটোসেশন। প্রতিটা স্পট এতো সুন্দর যে ইচ্ছে করে সব ধ’রে রাখি ছবি ফ্রেমে। দুপুরের রোদ ক্রমে ম্লান হতে থাকে। এবার আমাদের ফিরতে হবে। আসন্ন সুর্যাস্তের কাছে, ধ্যানী পাহাড়পুঞ্জের কাছে, খরস্রোতা সুরা নদীর কাছে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে বসি।
আবার সেই জজিলা পাস! বিপদজনক ভীতিকর পথ চলা। এবার পাহাড় বেয়ে ক্রমশ নীচে নামছে গাড়ি। নামছে তো নামছেই। প্রতি মুহুর্তে মনে হচ্ছে জীপটি এক্ষনি নিয়ন্ত্রন হারিয়ে মুখ থুবরে গড়িয়ে পরবে। আমি দেখছি পাহাড়ের গায়ে গায়ে বিকেলের সোনা মাখা রোদ। গাড়িতে তখন দুই খালা কঠিন মুখে বসে আছেন। তাদেরকে রাগানোর জন্য সুমি গুন গুন করে ‘এ পথ যদি না শেষ হয় –‘ । দোয়া দরুদ বন্ধ করে খালা চিৎকার করে উঠে ‘ গান থামাও, মরে যাচ্ছি, এখানে কেউ আসে –‘। আমরা দু বোন চোখে চোখে হাসি। নির্ঘাত ব্লাড প্রেসার বেড়ে গেছে খালার।
রুদ্ধশ্বাস ৩ ঘন্টার ভ্রমন শেষে সমতলের দেখা মিললো। স্বস্তি ফিরে এলো সবার মনে । এরমধ্যে সুর্য সবে অস্ত গেছে। আমাদের সাথে সাথে পাহাড় থেকে সিরু নদীটিও নেমে এসেছে। সেই সিরু নদীর পাড় ঘেঁষে গাড়ি চলছে। ওপারে গভীর অরন্য। আকাশে তখন টুকরো মেঘ। জনমানবহীন লোকালয়ে খরস্রোতা নদীর কলকল শব্দ মাদকতা ছড়াচ্ছে নীরব প্রকৃতিতে, আমাদের মনে।!
স্তব্ধতার রেশ নিয়ে রাত আমরা ৮ টার দিকে আমরা কারগিল শহরের সোনমার্গ পৌঁছাই। আজ শ্রীনগরে আমাদের রাত্রি যাপনের ব্যবস্থা । পর্যটকরা ইচ্ছে করলে কারগিলের পর্যটন কেন্দ্রে থাকতে পারেন।
রাত বাড়ে। আমরা এগোই গন্তব্যের দিকে। পিছনে পরে থাকে মৌন পাহাড় , দুর্গম গিরিপথ, পাহাড় চুড়ায় বরফ কুচি, সিরু নদির স্রোত, পাথরের স্তুপ আর বিমুর্ত সময় !
“কে না জানে পাহাড়ের চেয়ে নদীর দামই বেশি
পাহাড় স্থানু, নদী বহমান।
তবু আমি নদীর বদলে পাহাড়টাই কিনতাম,
কারন আমি ঠকতে চাই ———-
এখানে জয়ী হবার বদলে ক্ষমা চাইতে ভাল লাগে”
–সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
ভাবছিলাম এমন ভুস্বর্গে কেন এতো দ্বন্দ্ব, যুদ্ধ, কেন এতো রক্তক্ষয়! জয়ী হবার বদলে মানুষ কেন নদীর মতন বিভেদহীন হতে পারে না, পারে না পাহাড়ের মতন উদার হতে।
ডা: মালিহা পারভীন