চৌদ্দ শ শতকে ছুরি তৈরিতে সিদ্ধহস্ত শেফিল্ড শহরের নামডাক ছড়িয়ে পড়ে গোটা ইংল্যান্ডে, যা মধ্যযুগীয় ব্রিটিশ লেখক জেফ্রি চসারের বিখ্যাত কেন্টারবারি টেলেও উঠে এসেছে। ধীরে ধীরে আজকের শেফিল্ড গোটা বিশ্বের কাছে পরিচিত হয়ে আছে স্টেইনলেস স্টিলের কাটলারি প্রস্তুতকারক হিসেবে। ষোলো শতকে শেফিল্ডের হালমশায়ার কাটলারি কোম্পানি হয়ে ওঠে গোটা ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় বৃহত্তম চামচ, কাঁটা চামচ ও ছুরি তৈরির শহর হিসেবে। ধীরে ধীরে শেফিল্ড ব্যাপ্তি লাভ করতে শুরু করে শিল্পনগরী হিসেবে। ১৭৪০ সালে শেফিল্ডে স্টিল প্রসেসিং শুরু হয় এবং এখানকার অধিবাসী বেঞ্জামিন হান্টসম্যানের হাত ধরে উদ্ভাবন হয় কাস্ট আয়রনের পণ্যসামগ্রীর।
‘হবিগঞ্জের জালালী কইতর, সুনামগঞ্জের কুঁড়া,
সুরমা নদীর গাংচিল আমি, শূইন্যে শূইন্যে দিলাম উড়া,
শূইন্যে দিলাম উড়া রে ভাই, যাইতে চান্দের চর,
ডানা ভাইঙ্গা পড়লাম আমি, কইলকাত্তার উপর,
তোমরা আমায় চিননি…’
একটু ভালো করে বাঁচার অথবা পেশাগত জীবনের উৎকর্ষের জন্য আমরা যাঁরা দেশ ছেড়েছি, তাঁরাও জল, নৌকা কিংবা দিগন্তজোড়া ফসলের মাঠে নিজের অজান্তেই পদ্মা–মেঘনার গাংচিল হয়ে উঠি। টান পড়ে শিকড়ের সুতায়। হাজারো চাকচিক্যের মাঝে থেকেও বুকে আফাল ওঠে টিনের চালে শ্রাবণের বৃষ্টিময় অলস সন্ধ্যার জন্য। রদারভ্যালির টলটলে জলে অশ্রান্ত নৌকা বেয়ে সেদিনের মতো ভ্রমণ সমাপ্ত করে ফিরলাম বাড়িতে।
আড্ডার মধ্যমণি মৌনির দাদাবাবু রঞ্জিত চক্রবর্তী। যাকে ইতিহাসের তথ্যভান্ডার বললেও মনে হয় ভুল বলা হবে। ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। ছাত্রজীবনে ছিলেন বাম রাজনীতির সাথে যুক্ত। স্বাধীনতার পর প্রথম ডাকসু নির্বাচনে সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।হালের বহু জাতীয় নেতাদের সাথে ছিল সখ্য, হলের রুম শেয়ার কিংবা মিছিলে স্লোগানে গলা মেলানো। যাঁদের অনেকেই তাদের তৎকালীন আদর্শ ত্যাগ করে নানা ধারার রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছেন। দায়িত্ব মনে করেই যোগ দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। তাই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কোনো দিনও কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল করেননি, এমনকি নেননি মুক্তিযুদ্ধের সনদও। ১৯৭৫ সালে ব্রিটিশ কাউন্সিলের স্কলারশিপে চলে এসেছিলেন লন্ডনে। ইতিমধ্যে দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন এবং স্বাধীনতার মূল চারটি স্তম্ভের ধ্বংসস্তূপে আর ফিরে যেতে সায় দেয়নি মন। এরপর থেকেই বসতি শেফিল্ডে। গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডা এবং লম্বা ঘুম শেষে পরের দিন সকালে আমরা প্রস্তুতি নিলাম পিক ডিস্ট্রিক্টে আমাদের শেষ অভিযানের। গন্তব্য হেদার সেইজ, যেখানে পাহাড়ের চূড়ায় ফুল, পাথর আর সবুজের সমারোহ।
এবার আর গাড়ি নয়। পুরো পথটাই যেতে হবে হেঁটে। বাড়ি থেকে বেরিয়েই খাড়া পাহাড়। সেই পাহাড় বেয়ে উঠতে উঠতেই শুরু হলো ঢালু রাস্তা। এভাবে উঁচু–নিচু রাস্তা হাঁটতে হাঁটতে কখন যে আমরা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অনেক উঁচুতে উঠে এসেছি টেরই পাইনি। আসলে এমন শান্ত প্রকৃতি, অপূর্ব ঝরনা, দুধারে সবুজ ঘাসের মাঠে ভেড়া আর গরুর পালের আনাগোনায় ক্লান্তি টের পাওয়া যায় না।
এমন সরু পাহাড়ি পথে প্রকৃতির সাথে একাত্ম হয়ে সারিবদ্ধভাবে আমরা পাঁচজন মোহগ্রস্ত হয়ে হাঁটছিলাম, তখন পাখির কূজন, পাহাড়ি ঝিরিতে স্বচ্ছ জলের শব্দ আর বাতাসের আনাগোনা ছাড়া অন্য কিছুই মনে ছিল না। কিন্তু উঁচু পাহাড়ের চূড়া থেকে দৃশ্যপটে এল পাখির চোখে শেফিল্ড শহরের ইট-কংক্রিটের জঙ্গল, তখনই সংবিত ফিরে পেলাম। চারপাশের এত জৌলুশ পাহাড়, প্রকৃতি আর হাতের কাছে নরম মেঘের আনাগোনার মাঝে মনুষ্য সৃষ্ট শেফিল্ড শহরকে নিতান্তই নগণ্য মনে হলো।
অবশেষে আমরা পৌঁছালাম আমাদের গন্তব্য হেদার সেইজে। সিজন এখনো আসেনি, তাই হেদার ফুলের রঙিন ফুলপাহাড়ের দর্শন না পেলেও এমন প্রকৃতি সহজেই হার মানায় স্বর্গের অপ্সরী কিংবা মর্ত্যের প্রিন্সেস অব আলেকজান্দ্রিয়া ক্লিওপেট্রা কিংবা হেলেন অব ট্রয়কেও।
আমরা হাঁটছি মিলিয়ন বছরের পুরোনো পাথুরে পাহাড়ের গায়ে সারি সারি দেবদারুগাছ আর হেদার ফুলের ইন্দ্রপুরীতে। মনে হচ্ছিল নীল আকাশে সাদা মেঘগুলো চলে এসেছে একেবারেই হাতের নাগালে। হেদারের ঝাড়গুলো আর সুনীলের কবিতার উল্টো অনুবাদ করে পাহাড়ের পায়ের কাছে নয় বরং উঠে এসেছে একেবারেই চূড়ায়।
এমন অপার প্রকৃতির সান্নিধ্যে কৃত্রিম নাগরিক যাপিত জীবনের ভাবনা বড্ড বেমানান। সেই ভাবনা থেকেই হয়তো মনের মধ্যে চলছিল প্রেম, প্রকৃতি আর অপার্থিব জীবনের সন্ধান। আর হেডফোনে প্রিয় শিল্পী মানসী অনন্যার খালি কণ্ঠে গাওয়া রবীন্দ্রনাথের গান:
বঁধু তোমায় করবো রাজা তরু তলে,
বনফুলের বিনোদমালা দেব গলে।।
সিংহাসনে বসাইতে হৃদয়খানি দেব পেতে,
অভিষেক করব তোমায় আঁখি জলে।।
লেখক: পিএইচডি গবেষক ও প্রভাষক, ফ্যাকাল্টি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, এংলিয়া রাসকিন ইউনিভার্সিটি, কেমব্রিজ