অসংখ্য ঝর্ণা আর পাহাড়ের ভূমি খাগড়াছড়ি। চারদিকে ছড়িয়ে আছে বুনো পাহাড় আর তার নয়ন জুড়ানো দৃশ্য। প্রকৃতি আমাদের আত্মাকে শুদ্ধ করে এবং দেহকে চাঙা করে। আপনি যদি পাহাড় থেকে সূর্যোদয় বা অস্তমিত হওয়ার দৃশ্য উপভোগ করতে চান, ঝলমলে ঝর্ণার সামনে কিছুটা নির্জন সময় কাটাতে চান অথবা কাছাকাছি থেকে আদিবাসী সংস্কৃতি অনুভব করতে চান তবে খাগড়াছড়ি হতে পারে ভ্রমণের জন্য একটি আদর্শ স্থান। খাগড়াছড়ি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত চট্টগ্রাম বিভাগের একটি পার্বত্য জেলা। ঢাকা থেকে খাগড়াছড়ির দূরত্ব ২৬৬ কিলোমিটার এবং বন্দরনগরী চট্টগ্রাম থেকে এর দূরত্ব ১১২ কিলোমিটার।
এক নজরে খাগড়াছড়ি জেলার কয়েকটি দর্শনীয় স্থান:
খাগড়াছড়ি ভ্রমণে গেলে প্রাকৃতিক অপরূপ সৌন্দর্য রিসাং ঝর্ণাটি দেখা কোনোভাবেই মিস করবেন না। মারমা ভাষায় এর নাম রিসাং ঝর্ণা,‘রি’শব্দের অর্থ পানি আর‘সাং’শব্দের অর্থ গড়িয়ে পড়া।
ঝর্ণার পুরো যাত্রা পথটাই দারুণ রোমাঞ্চকর। যাত্রাপথে দূরের উঁচু-নিচু সবুজ পাহাড়, বুনোঝোঁপ, নামহীন রঙ্গিন বুনোফুলের নয়নাভিরাম অফুরন্ত সৌন্দর্য যে কাউকে এক কল্পনার রাজ্যে নিয়ে যায়। মহাসড়ক থেকে ঝর্ণার পথটি সবুজ পাহাড় দ্বারা বেষ্টিত। ঝর্ণার কাছে গেলে এক পবিত্র স্নিগ্ধতায় দেহমন ভরে উঠে। ২৫-৩০ হাত উঁচু পাহাড় থেকে আছড়ে পড়ছে ঝর্ণার জলরাশি, ঢালু পাহাড় গড়িয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে এই প্রবাহ। কাছাকাছি দুটো ঝর্ণা রয়েছে এ স্থানে। প্রতিদিন বহু পর্যটক এখানে এসে ভিড় জমায় এবং ঝর্ণার শীতল পানিতে গা ভিজিয়ে প্রকৃতির সাথে একাত্ম হয়ে কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যায়।
খাগড়াছড়ি জেলা সদর থেকে ১১ কিলোমিটার এবং মাটিরাঙা উপজেলা সদর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরত্বে খাগড়াছড়ি-ঢাকা মূল সড়ক ছেড়ে ১ কিলোমিটার দক্ষিণে চারিদিকের পাহাড়ি প্রকৃতির মাঝে অবস্থান রিসাং ঝর্ণার। ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে যেকোনো বাসে সরাসরি খাগড়াছড়ি জেলা শহর বা মাটিরাঙা নামতে পারেন। সেখান থেকেই চাঁদের গাড়ি (জিপ), সিএনজি অটোরিকশা বা মোটরসাইকেলে চড়ে যেতে পারবেন রিসাং ঝর্ণায়। এছাড়া ব্যক্তিগত গাড়িতে করেও যেতে পারবেন সেখানে।
আলুটিলা খাগড়াছড়ি জেলায় আলুটিলা পর্যটর কেন্দ্রে অবস্থিত একটি প্রাকৃতিক গুহার নাম। এই গুহাটি‘আলুটিলা রহস্যময় গুহা’নামেও পরিচিত। নাম টিলা হলেও আলুটিলা কিন্ত মোটেও টিলা নয়। বরং আলুটিলা খাগড়াছড়ি জেলার সবচেয়ে উঁচু পর্বত। আলুটিলার আগের নাম ছিল আরবারী পর্বত। জানা যায়, খাগড়াছড়িতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় খাদ্যের অভাব প্রচণ্ডভাবে দেখা দিলে এলাকার মানুষজন খাদ্যের সন্ধানে এই পর্বত থেকে বুনো আলু সংগ্রহ করে তা খেয়ে বেঁচে ছিল। সেই থেকে পর্বতটির নাম হয়ে যায় আলুটিলা।
পাহাড়ের ভেতরে এই গুহা যেকোনো ভ্রমণপ্রেমীকে আনন্দ দিতে পারে। গুহাটির চারপাশে রয়েছে ঘন সবুজের অরণ্য। গুহাটি ভেতরে ১০০ মিটার দীর্ঘ, ১ দশমিক ৮ মিটার উঁচু এবং শূন্য দশমিক ৯ মিটার প্রশস্ত। এই গুহাটি খুবই অন্ধকার ও শীতল। কোনো প্রকার সূর্যের আলো প্রবেশ করে না বলে মশাল নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে হয়। সুড়ঙ্গের তলদেশ পিচ্ছিল এবং পাথুরে। এর তলদেশে একটি ঝর্ণা প্রবাহমান। গুহাটির একপাশ দিয়ে প্রবেশ করে অন্যপাশে দিয়ে বের হতে সময় লাগতে পারে ১০ থেকে ১৫ মিনিট। গুহাটির উচ্চতা মাঝে মাঝে খুব কম হওয়ায় নতজানু হয়ে হেঁটে যেতে হয়। আলুটিলা গুহা খাগড়াছড়ি শহর থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। সেখান থেকে স্থানীয় বাস, প্রাইভেট জিপ বা অটোরিকশায় করে আপনি আলুটিলা গুহায় পৌঁছাতে পারেন।
খাগড়াছড়ি-রাঙ্গামাটি সড়কের নুনছড়ি মৌজায় চির প্রশান্তির দেবতার পুকুর অবস্থিত। এটি পর্যটন মোটেল থেকে ১২ কিলোমিটার এবং মাইসছড়ি থেকে ৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। পৌরাণিক কাহিনী মতে, এই পবিত্র পুকুরের পানি শুকিয়ে যাবে না এবং দূষিত হবে না। স্থানীয় লোকদের তৃষ্ণা নিবারণের জন্য স্বয়ং দেবতা এই পুকুর খনন করেন। তাই এর নাম দেবতা পুকুর। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১ হাজার ফিট ওপরে পাহাড় চূড়ায় এটি অবস্থিত। পুকুরের আকার দৈর্ঘ্যে প্রায় ১ হাজার ৫০০ ফুট এবং প্রস্থে প্রায় ৬০০ ফুট।
রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি সড়কে চলাচলকারী স্থানীয় ট্রান্সপোর্ট চাঁদের গাড়ি সাধারণত মাইসড়ি আর্মি ক্যাম্পে যায়। এই জায়গা থেকে নুনছড়ি ত্রিপুরা গ্রাম প্রায় ৪ কিলোমিটার দূরে। পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার জন্য প্রায় ৪ থেকে ৫ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে যেতে হবে। চাঁদের গাড়ি, সিএনজি অটোরিকশা ভাড়া করে বা ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে গেলে নুনছড়ি ত্রিপুরা গ্রাম পর্যন্ত যাওয়া যায়।
খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ির অরণ্য কুটির যা বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের পবিত্র তীর্থস্থান হিসাবে পরিচিত। এ কুটিরে দেখা যাবে ৪৮ দশমিক ৫ ফুট উচ্চতার বৃহৎ বৌদ্ধ মূর্তি। প্রায় ৬৫ একর জায়গা নিয়ে শান্তিপুর অরণ্যকুটির অবস্থিত। যা মুহূর্তেই যে কাউকে অভিভূত করবে। এটি বাংলাদেশের বৃহত্তম গৌতম বুদ্ধের মূর্তি। মূল মূর্তিটি ৪২ ফিট উঁচু এবং বেদিটি ৬ দশমিক ৫ ফিট উঁচু। সব মিলিয়ে মূর্তিটি ৪৮ দশমিক ৫ ফিট উঁচু। পানছড়ি শান্তি কুটির খাগড়াছড়ি শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে। সেখান থেকে বাসেও যেতে পারেন। এছাড়া শহরের চেঙ্গি স্কয়ার থেকে সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে সরাসরি অরণ্য কুটির যাওয়া যায়।
আপনি যদি প্রকৃতিপ্রেমী হন তবে খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গার শতবর্ষী পুরাতন বটগাছটি দেখে এক প্রশান্তি অনুভব করবেন। মাটিরাঙ্গার খেদাছড়ার কাছাকাছি এলাকায় এই শতবর্ষী বটগাছের অবস্থান। এই গাছ শুধু ইতিহাসের সাক্ষী নয়, এ যেন দর্শানাথীদের জন্য আশ্চর্য এক বস্তু। পাঁচ একরেরও বেশি জায়গাজুড়ে রয়েছে এ গাছ। মূল বটগাছটি থেকে নেমে আসা প্রতিটি ঝুড়িমূল কালের পরিক্রমায় এক একটি নতুন বটবৃক্ষে পরিণত হয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় হল-ঝুড়ি মূল থেকে সৃষ্টি প্রতিটি গাছ মূল গাছের সঙ্গে সন্তানের মতোই জড়িয়ে আছে।
স্থানীয়দের মতে, এ বটবৃক্ষের নিচে বসে যিনি শীতল বাতাস লাগাবেন তিনিও শতবর্ষী হবেন। খাগড়াছড়ি বাস টার্মিনাল থেকে চট্টগ্রাম/ফেনীর দিকের বাসে উঠুন। মাটিরাঙ্গা বাজারে এসে বাস থেকে নামুন। বাসের ভাড়া ২০ টাকা। এখান থেকে প্রায় ১ দশমিক ৫ কিলোমিটার হাঁটার রাস্তা। এছাড়া মোটরবাইক ভাড়া করেও যেতে পারেন।
পাহাড়ের চূড়া থেকে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত উপভোগ করতে চাইলে খাগড়াছড়ি ভ্রমণণে সাজেক ভ্যালি কোনোভাবেই মিস করবেন না। প্রকৃতির অপরূপ দৃশ্য উপভোগ করতে উপত্যকাটি অবশ্যই ঘুরে আসবেন। সাজেক যদিও রাঙ্গামাটি জেলায় অবস্থিত, তবে যাতায়াতের সহজ পথ খাগড়াছড়ি-দীঘিনালা রোড। তাই যারা খাগড়াছড়ি ভ্রমণে যান তাদের কাছে অন্যতম আকর্ষণ সাজেক ভ্যালি। খাগড়াছড়ি থেকে ৬৯ কিলোমিটার এবং বাঘাইছড়ি উপজেলা থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরের সাজেকের পুরোটাই পাহাড়ে মোড়ানো পথ।
খাগড়াছড়ি শহরের শাপলা মোড় থেকে চাঁদের গাড়ি/সিএনজি অটোরিকশা ভাড়া করে সাজেক যাওয়া যাবে। এছাড়াও নিজস্ব মাইক্রো বা গাড়ি নিয়েও যাওয়া যাবে। সময় লাগবে সব মিলিয়ে ৩ ঘণ্টা। তবে যাওয়ার পথের সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে চাঁদের গাড়ির ছাদে বসে যেতে হবে। সেই ক্ষেত্রে সাবধানে গাড়ি ধরে বসতে হবে। একটি চাঁদের গাড়িতে অনায়াসে ১২ জন যেতে পারবেন।
সাধারণত-খাগড়াছড়ি পর্যটন স্পটগুলো ভ্রমণের জন্য শীতকাল উপযুক্ত সময়। বর্ষার সময় জলপ্রপাতগুলো এবং সবুজ পাহাড়গুলো দেখতে খুবই দারুণ দেখায়। তবে বর্ষাকালে পাহাড়ি এলাকায় ভূমিধসের ঘটনা ঘটে। এ জাতীয় দুর্ঘটনা কয়েকদিন ধরে খাগড়াছড়ির স্থানীয় পরিবহন ব্যবস্থাকে ব্যাহত করে। তাই সেখানে ভ্রমণের পরিকল্পনা করার আগে আবহাওয়ার পূর্বাভাসও দেখে নেয়া জরুরি। সূত্র-ইউএনবি