শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৪:২৯ অপরাহ্ন

পাহাড়ি খাবারের স্বাদ ‘জুমঘর’ রেস্তোরাঁয়

  • আপডেট সময় বুধবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৩

ঢাকা থেকে খাগড়াছড়ি এসে পৌঁছালাম সকাল ৭টায়। সেখানে আগে থেকেই সরকারি রেস্ট হাউজে আমাদের থাকার বন্দোবস্ত করেছেন দীঘিনালা উপজেলা নির্বাহী অফিসার আরাফাত ভাই।

রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে সকালের নাশতা সেরে বিশ্রাম নিলাম। দুই-তিন ঘণ্টা বিশ্রাম নেওয়ার পর আরাফত ভাইয়ের ফোন। এরপর চলে গেলাম উপজেলায় তার কার্যলায়ে।

আলাপচারিতা ও চা চক্র শেষে আরাফত ভাই বলে উঠলেন, ‘আমরা আজ দুপুরের খাবার খাবো এখানকার খুব জনপ্রিয়র রেস্তোরাঁ জুমঘরে। সেখানে সব ধরনের পাহাড়ি খাবার পাওয়া যায়।’

আমরা সানন্দে রাজি হয়ে গেলাম। ভাই গাড়ি বের করতেই আমরা গাড়িতে চেপে পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে মাত্র কয়েক মিনিটে চলে আসলাম জুম ঘরের সামনে। মেইন রোড থেকে একটা সরু ইটের হেয়ারিং করা রাস্তা নেমে গিয়েছে পুলিন হেডমেন পাড়া গ্রামের দিকে।

অবশ্য মূল সড়ক থেকে এই রাস্তার মিলনস্থলেই একপাশে জুমঘর আরেকপাশে অন্য এক ভাষায় (হয়তো চাকমা ভাষা) রেস্তোরাঁটির নাম চোখে পড়লো। রাস্তা সরু হওয়ায় গাড়ি না ঢুকায় আমরা সবাই নেমে হেঁটে গেলাম রেস্তোরাঁর ভেতরে।

আমরা বলতে আমি, এখানকার ইউএনও আরাফাত ভাই, দীঘিনালা সরকারি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এখতার আলী, বাংলাদেশ বেতারের উপস্থাপক সজীব দাদা ও ছোট ভাই বোরহান।

রেস্তোরাঁয় ঢুকতেই চোখে পড়লো ছন, খড় দিয়ে নানা কারুকার্য। রেস্তোরাঁর ভিতরে কৃত্রিম ঝড়নাসহ বেশ কিছু ছোট-বড় কুঠির। আর একদম সামনে একটা ঘরে দেখলাম যেখানে দুজন চাকমা নারী আপন মনে রান্না করছেন। আর সেই ঘরের উপরে সাইনবোর্ডে লেখা ‘পিজোর’।

আমাদের দেখেই ছুঁটে আসলেন দুই যুবক। এরপর কুশল বিনিময় করে আমাদের নিয়ে গেলেন একটা বড়সর কুঠিরে। দেখতে অনেকটা মাঁচার মতো। যেখানে মাটিতে লেপ্টে বসার মতো দারুণ এক ব্যবস্থা।

আমি গিয়েই প্রথমে জিজ্ঞাস করলাম ‘পিজোর’ অর্থ কী? রেস্তোরাঁর ছেলেটি বললেন, ‘এর অর্থ রান্নাঘর। চাকমা ভাষায় রান্নাঘরকে ‘পিজোর’ বলি।’

আমাদের আসার আগেই আরাফাত ভাই জুমঘরে ফোন দিয়ে বলে দিয়েছিলেন যে, দুপুরের খাবার তাদের ওখানেই খাবো। তাই আগে থেকেই তারা সব কিছু তৈরি করে রেখেছে।

এরপর আমাদের সামনে নিয়ে আসলো বাঁশ দিয়ে তৈরি বিশেষ এক মোড়া (টুলজাতীয় জিনিস) যেখানে প্লেট রেখে খাওয়া হবে। এই বিশেষ মোড়াগুলোকে পাহাড়িরা ‘মেজাং’ নামে ডাকে।

তারপর একেক করে নিয়ে আসলো মাটির প্লেট ও গ্লাস। এরপর মাটির পানি রাখার বিশেষ এক পাত্র নিয়ে আসলো। যেটা অনেকটা দেখতে আমাদের পানি রাখার জগের মতো। তবে পানি বেরনোর নলটা কিছুটা লম্বা। আর সেখানে কলাপাতা গুজে দেওয়া। আর তার মুখটাও কলাপাতা দিয়ে গুঁজে দেওয়া।

আমরা অনেকটা ক্ষুধার্ত। তাই দেরি না করে তাড়াতাড়ি খাবার আনতে বলা হলো। এরপর এক এক করে আনা হলো বিশেষ বিশেষ খাবার। পাহাড়িদের একটা রীতি হলো তারা সব খাবার একসাথে প্লেটে দেয়।

তাই আমরা বললাম, ‘একেক করে খাবারগুলোর নাম বলবেন আর পরিবেশন করবেন। আমরা আলাদা আলাদা করে খাবারের নাম জানতে ও স্বাদ নিতে চাই। একথা শুনে তারা তাই করলেন। আরাফাত ভাই অবশ্য বলে উঠলেন কলাপাতায় খাওয়ার কথা। তবে আমরা মাটির প্লেটেই সাঁয় দিলাম।

যা যা খেলাম

আমরা মোটামুটি পাহাড়ি প্রায় ৮-১০ পদের তরকারি দিয়ে খাবার খেলাম। পাহাড়ে চাকমাদের উৎপাদিত সুগন্ধি ঝরঝরে চালের ভাতের সঙ্গে ছিল জুম সবজি, বাঁশ কোড়াল, ব্যাম্বু চিকেন, ব্যাম্বু ফিস (বাঁশের মাঝে বিশেষ পদ্ধতিতে রান্না করা) এরপর কলাপাতায় বিশেষ প্রক্রিয়ার রান্না করা ডিম হেবাং, সিদ্ধ বরবটি, মরিচ হেবাং, স্পেশাল জুম ডাল, পাজন ও আলু ভর্তা।

আমরা এক এক করে সব খাবার ট্রাই করতে লাগলাম। আমার কাছে সব খাবারের মান ছিলো ১০ এর মধ্যে সাড়ে নয়। খাবারের স্বাদ এক কথায় অন্যান্য। প্রথমে আমি ভেবেছিলাম পাহাড়ি খাবার সেভাবে খেতে পারবো কি না বা কোনো অসুবিধা হবে কি না। তবে না প্রথমেই খাবার মুখে দিয়ে আমার ভুল ভাঙলো।

সব খাবার ছিলো অত্যন্ত সুস্বাদু। তবে বাঁশ কোড়ালের পাজন খেতে একটু অসুবিধা হচ্ছিলো। তারপরেও খারাপ ছিল না। খেতে খেতে আরাফাত ভাই আমাদের খাবারের বিশেষত্বগুলো বলতে লাগলেন। কোনটি কী খাবার? আর কোনটি কোথায়ই বা পাওয়া যায়?

খাবার শেষে তারা আমাদের জন্য তাদের কলাগাছ থেকে সদ্য পেরে আনা পাহাড়ি কলা খেতে দিলো। এরপর দিলো লাল চা। তবে লাল চায়ের একটা বিশেষত্ব ছিলো চায়ের মধ্যে আদা-লবঙ্গের সঙ্গে ছিলো চাল ভাজা। এটি আমার কাছে দারুণ লেগেছে। একদম ভরপেট খেয়ে আমরা হেলান দিয়ে পা মেলিয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম।

রেস্তোরাঁ শুরুর গল্প

বিশ্রাম নেওয়া শেষ হলে আমি কথা বললাম রেস্তোরাঁর মালিকদের সঙ্গে। কথা বলে জানলাম, সুপন চাকমা, স্টালিন চাকমা, দিপিকা চাকমা ও উদয় শংকর চাকমা তারা ভাই-বোন মিলে এই বছরের শুরুর দিকে রেস্তোরাঁটি চালু করেছে।

চারজনই শিক্ষিত তরুণ-তরুণী। ছোটবোন স্টালিন চাকমা উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ছেন এছাড়া বাকি সবার গ্রাজুয়েশন শেষ। তারা জানান, পড়াশোনার পাশাপাশি তারা কৃষি কাজ ও প্রজেক্টের বিভিন্ন কাজ করতেন। এরপর ব্যাংক লোন ও নিজেদের জমানো টাকা দিয়ে তাদের পতিত জমিতে সুন্দর সাজসজ্জা করে চালু করেন এই রেঁস্তোরা।

সুপন চাকমা বলেন, ‘আমি হ্যান্ডি ক্রাফটের কাজ করতাম। হঠাৎ আমার মাথায় রেস্টুরেন্ট করার চিন্তা মাথায় আসলো। তাই আমারা ভাই-বোন মিলে এই রেস্টুরেন্টটি শুরু করালাম। আর রেস্টুরেন্টের ডেকোরেশন সব কাজ আমার করা। আগেই বলেছিলাম আমি হ্যান্ডি ক্রাফটের কাজ করি তাই খুব বেশি কষ্ট হয়নি ডেকরেশন করতে।’

আরেকজন উদ্যোক্তা দিপিকা চাকমা বলেন, ‘এই রেস্টুরেন্ট থেকে মাসে এখন এক দেড় লাখ টাকার মতো আয় হয়। খাগড়াছড়ির বিভিন্ন জায়গা থেকে আমাদের এই রেস্টুরেন্টে অনেকেই খেতে আসেন।’

খাবারের মান ও দাম

পোমাংপাড়া গ্রাম থেকে এখানে খেতে আসা মুগিনি নামে এক চাকমা মেয়ে বলেন, ‘অথেন্টিক পাহাড়ি খাবারের জন্য মাঝে মধ্যেই আমরা এখানে খেতে আসি। এদের খাবারের স্বাদ চমৎকার।’

আমরা নিজেরাও তো খেয়ে দেখলাম। খাবারের মান নিয়ে আমরা সন্তুষ্ট। আর খাবারের দামগুলোও আছে সাধ্যের মধ্যে। পাহাড়িদের পাহাড়ি সব খাবার পাওয়া যায় এখানে। শুধু তাই না স্ন্যাকস আইটেম হিসেবে তাদের নিজেস্ব পিঠাও আছে।

ব্যাম্বু চিকেন, ব্যাম্বু ফিস, চিকেন মমো ও হরো গুদুরে ছাড়া বাকি সব খাবার আইটেমপ্রতি ১০০ টাকার মধ্যেই পাওয়া যায়। তবে হ্যাঁ, অনেক আইটেম একসঙ্গে খেতে চাইলে আগেই তাদের ফোন দিয়ে অর্ডার দিতে হবে।

কীভাবে যাবেন?

ঢাকার কল্যাণপুর থেকে শান্তি পরিবহনে ডিরেক্ট আসা যায় খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলায়। এসি বাসের ভাড়া ১৬০০-১৭০০ টাকা ও নন এসি বাসের ভাড়া ৮২০ টাকা। এরপর দীঘিনালা বাজারে গিয়ে অটো রিকশাকে বললেই নিয়ে যাবে ‘জুমঘর’ রেস্তোরাঁয়। ভাড়া জনপ্রতি ২০ টাকা।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com