শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:০৬ অপরাহ্ন

পালকি মটরস-এর সিটি বয়: দেশের গণপরিবহনের ভবিষ্যৎ কি বৈদ্যুতিক গাড়ি

  • আপডেট সময় সোমবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৩
গাড়িটি বেশ কমপ্যাক্ট — পেছনে অনায়াসে দুইজন বসতে পারেন, সামনে চালকসহ দুইজন। গাড়িটির আরও আছে সানরুফ, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এবং অ্যান্ড্রয়েড ইনফোটেইনমেন্ট সিস্টেম। যেসব মানুষ সিএনজি, উবার ও পাঠাও চালান, তাদের কথা ভেবে বানানো হয়েছে পালকি মটরস-এর সিটি বয়।

ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ে তড়িৎ প্রকৌশল পড়ার সময় এক কোর্সে এসি মোটর নিয়ে পড়তে হয়েছিল মোস্তফা আল মমিনকে। সে সময় অবসরে তিনি মোটর গাড়ির গ্যারাজে অনেক সময় কাটাতেন।

তার মাথায় একটা আইডিয়া এল। মনে মনে ভাবলেন, ‘থানার পাশে কত পুরোনো আর পরিত্যক্ত গাড়ি পড়ে আছে; এ মোটরগুলো আবার চালু করে এগুলোতে পর্যাপ্ত টর্ক দিতে পারলে গাড়িগুলো কি আবার চলবে?’

এরপর যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তি নিয়ে পড়তে চলে যান মমিন। পড়ালেখা শেষ করে আবার দেশে ফিরে এসে নয়টা-পাঁচটার একটা চাকরিও শুরু করেন। বেতনটাও মন্দ ছিল না।

কিন্তু সেই পুরোনো আইডিয়া তার মাথা থেকে তখনো যায়নি। আইডিয়াটাকে ২০১৬ সালে ব্যাবসায় পরিণত করতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ভালো একটা চাকরি ছেড়ে দিয়ে এভাবে হুট করে ব্যবসায় নেমে যাওয়ার পরিকল্পনা পরিবারের পছন্দ হয়নি।

ওই সময় জীবন নিয়ে অনেক কিছু ভাবতেন মমিন। সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালকদের সঙ্গেও অনেক সময় কাটিয়েছিলেন তিনি। বিভিন্ন গ্যারাজে যেতেন, চালকদের সঙ্গে খেতেন — তাদের জীবন সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেছিলেন, এমনকি কিছুদিন ওসব চালকদের মতো করেও বাস করেছিলেন। পরে টের পেলেন সিএনজি চালকেরা খুবই কঠিন জীবনযাপন করেন। আর তখনই তার মাথায় সিএনজি’র বিকল্প বৈদ্যুতিক গাড়ি পালকি মটরস-এর ধারণা আসে।

পালকি মটরস-এর প্রতিষ্ঠাতা মমিন এখন প্রতিষ্ঠানটির সিইও হিসেবে আছেন। অন্যদিকে সিওও-এর দায়িত্ব পালন করছেন মো. আরিফুর রহমান। বাংলাদেশের প্রথম বৈদ্যুতিক গাড়ি তৈরি করছেন তারা।

‘আমি জানি বৈদ্যুতিক গাড়ি তৈরি করা সহজ নয়। অনেক তহবিল দরকার, গবেষণা ও উন্নয়ন খাতেও প্রচুর ব্যয়ের প্রয়োজন আছে। তবে আমাদের গাড়িগুলো ব্যক্তিগত গাড়ির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার জন্য বানানো হয়নি। বরং আমাদের লক্ষ্য হলো ব্যবসায়িক চালকেরা, বিশেষত সিএনজি চালকেরা,’ বলেন মমিন।

‘সিএনজি চালকেরা দৈনিক প্রায় ১৪ থেকে ১৫ ঘণ্টা কাজ করেন। তাদেরকে দিনে ১,১০০ টাকা মালিককে দিতে হয় — এ অর্থ তাদের দৈনিক আয়ের প্রায় ৪০ শতাংশ। এছাড়াও জ্বালানি খরচের জন্য আরও কয়েকশ টাকা লাগে। তাই তাদের কথা ভেবে আমার আমাদের গাড়ির নকশা করেছি,’ মমিন বলেন।

ছবি: নূর-এ-আলম

সিটি বয় প্রোটোটাইপ

করোনাভাইরাস মহামারি শেষ হওয়ার পর পালকি মোটরস চালু করেন মমিন ও রহমান। মমিনের দায়িত্ব হচ্ছে গাড়ির নকশা করা, আর রহমান ব্যাবসার দিকটা সামলান। বর্তমানে তারা দুটো প্রোটোটাইপ তৈরি করেছেন এবং ২০টি গাড়ির প্রি-অর্ডারের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

প্রায় পাঁচ লাখ টাকা দামের গাড়িটির আকার একটা সিএনজির মতো। চার্জ হতে সময় লাগে ঘণ্টা দুয়েক, এক চার্জে ১৫০ কিলোমিটার চলতে পারে। আর এ গাড়ির সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৪৫ কিলোমিটার। সাধারণত একটা সিএনজির দাম পড়ে চার লাখ টাকার মতো এবং এ অটোরিকশাগুলো ঘণ্টায় ৫৬ কিলোমিটার পর্যন্ত গতি তুলতে সক্ষম। একজন সিএনজি চালকও দিনে গড়ে দেড়শ কিলোমিটার গাড়ি চালান।

গাড়িটি বেশ কমপ্যাক্ট — পেছনে অনায়াসে দুইজন বসতে পারেন, সামনে চালকসহ দুইজন। গাড়িটির আরও আছে সানরুফ, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এবং অ্যান্ড্রয়েড ইনফোটেইনমেন্ট সিস্টেম।

‘বাংলাদেশে প্রায়ই কর্দমাক্ত বা পানিতে ডুবে থাকা রাস্তায় গাড়ি চালাতে হয় — আমাদেরকে এসব বিষয়গুলোও মাথায় রাখতে হয়েছে। আমরা চালক, যাত্রী ও বাজারে চাহিদার কথা মাথায় রেখে গাড়িটি তৈরি করেছি,’ বলেন পালকি মটরস-এর মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার অপল সাহা।

‘সাধারণ আমরা সবকিছু চাই — সবচেয়ে সুন্দর নকশা আর সবচেয়ে শক্তিশালী ইঞ্জিন। কিন্তু আমাদের রিসোর্স সীমিত, আর মানুষজনও আমাদের গাড়ি বেশি টাকা দিয়ে কিনতে চাইবে না। তাই সবকিছুর মধ্যে একটা ভারসাম্য রাখতে হয়েছে,’ যোগ করেন অপল।

‘যেসব মানুষ সিএনজি, উবার ও পাঠাও চালান, তাদের কথা ভেবে বানানো হয়েছে এ গাড়িটি,’ ব্যাখ্যা করেন মমিন।

‘দিল্লিতে আজকাল প্রচুর বায়ুদূষণ, ঢাকাও ক্রমশ সে পথে এগোচ্ছে। যদিও জনপ্রিয় ধারণা হলো, সিএনজি পরিবেশ দূষণ করে না, কিন্তু বাস্তবতা উল্টো। এ সমস্যার উত্তর হলো বৈদ্যুতিক গাড়ি,’ মমিন যোগ করেন।

আংশিক অক্সিডেশন বিক্রিয়ার কারণে সিএনজিচালিত গাড়িগুলো বিপুল পরিমাণে মিথেন, কার্বন মনোঅক্সাইড ও ফরমালডিহাইড গ্যাস উৎপন্ন করে যা মানুষ, পশুপাখি ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক।

ঢাকায় গাড়ি নির্মাণের যত চ্যালেঞ্জ

পালকি তাদের গাড়ির নাম দিয়েছে ‘সিটি বয়’। চীন, তাইওয়ান ও আরও কিছু জায়গা থেকে এ গাড়ির যন্ত্রাংশ আমদানি করা হয়েছে। তবে পালকি এখন নিজস্ব কারখানা তৈরির কাজ শুরু করেছে, ফলে এখানেই গাড়ি তৈরি করতে পারবে তারা।

‘ম্যানুফ্যাকচারিং-এর পাঁচটা সেকশন আছে: স্ট্যাম্পিং, ওয়েল্ডিং, পেইন্টিং, অ্যাসেম্বলি এবং ইন্সপেকশন। স্ট্যাম্পিংয়ের জন্য প্রচুর অভিজ্ঞতা ও ভারী যন্ত্রপাতির দরকার। পেইন্টিং আর টেস্টিংও খরুচে। আমরা কয়েকটি কোম্পানি থেকে বর্তমানে এ সেবাগুলো নিচ্ছি, বিশেষ করে স্ট্যাম্পিং। এ কারণেই আমরা চীন থেকে গাড়ির বডি আমদানি করছি,’ মমিন বলেন। ভবিষ্যতে এ কাজগুলো নিজেদের কারখানায় করবেন বলেও যোগ করেন তিনি।

‘প্রথম বাধাটা ছিল কারখানার জন্য একটা জায়গা খুঁজে পাওয়া। যেহেতু আমরা একটা উদ্যোগ, তাই বেশি ভাড়া দেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব না। এছাড়া গাড়ি রং করার কারণে সুয়েজের মতো বাড়তি সুবিধাও আমাদের দরকার ছিল। কিন্তু সৌভাগ্যবশত আমার অবশেষে এ ধরনের একটা জায়গা পেয়েছি, শীঘ্রই সেখানে সবকিছু স্থানান্তর করব,’ রহমান বলেন।

ছবি: নূর-এ-আলম

‘আমাদের মতো স্টার্টআপগুলোর জন্য একটি সাপোর্টিভ নেটওয়ার্ক খুবই দরকার। তাই আমরা ইউএনডিপি ও সিটি ফাউন্ডেশনের ইয়ুথ কো:ল্যাব নামক স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম থেকে সুবিধা গ্রহণের চেষ্টা করছি,’ মমিন জানান।

সিটি বয় রাস্তায় চলাচলের জন্য বৈধ?

এ প্রতিবেদনটি লেখার সময় গাড়িগুলোর রাস্তায় চলাচলের অনুমতি ছিল না। কিন্তু পালকি মটরস অনুমতি গ্রহণ প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। এ গাড়ি চালানোর জন্য লাইসেন্সের দরকার হবে। এছাড়া এআইটি, কর ও ফিটনেসের বিষয়গুলো বাংলাদেশে ১৫০০সিসি গাড়ির সমতুল্য হবে বলে ধারণা করছেন পালকি মটরসের উদ্যোক্তারা।

‘কারখানা স্থাপন ও আমাদের পণ্য তৈরি করা ছাড়াও আমরা গাড়ির অনুমোদন সংগ্রহের প্রক্রিয়া শুরু করেছি। বিআরটিএ থেকে এখনো অনুমতি না পাওয়ায় অর্ডার পাওয়া গাড়িগুলো আমরা এখনো গ্রাহকের কাছে সরবরাহ করিনি,’ রহমান জানান।

‘আগামী মে মাসের মধ্যে ২০টি প্রি-অর্ডার সরবরাহ করার জন্য কাজ করছি আমরা। এখন পর্যন্ত পাঁচটি গাড়ির টেস্ট ড্রাইভের অনুমতি পাওয়া গিয়েছে। বিআরটিএ’র কাছে আমরা আবেদন করছি — এটি একটি ধীর ও দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। আমরা যথাসময়ে গাড়িগুলো গ্রাহকের হাতে তুলে দেব। ডেলিভারির সময় পর্যন্তও গাড়ির যদি নিবন্ধন না পাওয়া যায়, তাহলে আমরা অনুমতি থাকা একটি গাড়ি লোন হিসেবে দেওয়ার প্রস্তাব রাখব,’ মমিন ব্যাখ্যা করেন।

ভবিষ্যৎ কী বৈদ্যুতিক গাড়ির?

সিটি বয় চালানো একটি ভিন্ন অভিজ্ঞতা। গাড়িটি কি সিএনজি থেকে বিলাসবহুল — এমন প্রশ্নের উত্তরে নির্দ্বিধায় হ্যাঁ বলতে হবে। এ গাড়িটি ব্যবহারে খরচ কম, আর যানজটে আটকে থাকা যেকোনো কমবাশ্চন ইঞ্জিনের গাড়ির চেয়ে অনেক বেশি কর্মদক্ষ এটি।

তবে পালকি মটরসের টার্গেট ভোক্তা, যারা সাধারণত নিজেদের গাড়ি ভাড়া দিয়ে থাকেন, তাদের জন্য পাঁচ লাখ টাকা অনেক বড় বিনিয়োগ। তাই লোন করে গাড়ি সংগ্রহের বিষয়টি তাদের কতটা আকৃষ্ট করবে সে প্রশ্ন থেকেই যায়।

কিন্তু মমিন আশাবাদী।

যেমনটা তিনি ব্যাখ্যা করলেন, ‘কেউ যদি পাঁচ বছরের জন্য লোন নেয়, তাহলে ওই টাকা পরিশোধ করা তাদের জন্য সহজ হবে। কারণ গাড়ির ভাড়া একই থাকবে কিন্তু তারা গাড়িটি ব্যবহার করে আয় করা অর্থ থেকে কিছু জমাতেও পারবেন। গাড়িটির ব্যাটারির তিন বছরের রিপ্লেসমেন্ট ওয়ারেন্টি থাকছে।

‘আর মোটরের ওয়ারেন্টি এক বছরের। পরবর্তী তিন বছর গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ক্রেতাকে ভাবতে হবে না। সবমিলিয়ে তাদের জন্য এটি ভালো বিনিয়োগ হবে।’

‘সবাইকে তো একদিন মরতে হবে, কিন্তু আমরা চাই আমাদের একটা লেগেসি থাকুক, যেটার দ্বারা মানুষ আমাদের মনে রাখবে। আমি চাই পালকি হবে আমার লেগেসি,’ মমিন বলেন।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com