1. [email protected] : চলো যাই : cholojaai.net
পহেলা বৈশাখ এবং আমাদের গন্তব্য
রবিবার, ২২ জুন ২০২৫, ০২:০৪ অপরাহ্ন

পহেলা বৈশাখ এবং আমাদের গন্তব্য

  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪

কিংবদন্তি কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের প্রকাশিত সর্বশেষ গ্রন্থ ‘হিজিবিজি’। যেটার প্রচ্ছদ উনি দেখে গিয়েছিলেন। এই গ্রন্থে লেখকের বহুমাত্রিক শিল্পীসত্তার পরিচয় পাওয়া যায়। এই গ্রন্থেরই একটা প্রবন্ধ বা গল্পের নাম ‘একজন আমেরিকানের চোখে বাংলা বর্ষবরণ উৎসব’। খুবই ছোট কলেবরের এই প্রবন্ধে একজন বিদেশির চোখে দেখা বাংলাদেশের বর্ষবরণ উৎসবের পাশাপাশি বাংলাদেশের মানুষের সামগ্রিক মূল্যবোধের এক নিপুণ চিত্র আঁকা হয়েছে। শুরুতেই বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে- ‘এই ক্ষুদ্র দেশটির অবস্থান ভারতের পূর্বে। দেশটির দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, উত্তরে হিমালয় পর্বতমালা। ট্রপিক্যাল জোনের বেনানা বেল্টে এর অবস্থান।’

এরপর এসেছে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রসঙ্গ – ‘বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এই দেশের জনগোষ্ঠীর নব্বই শতাংশই দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। দারিদ্র্যের সঙ্গে দুর্নীতি সম্পর্কযুক্ত। দুর্নীতিতে শীর্ষ সূত্রে প্রায় প্রতিবারেই এই দেশের নাম আসে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে (বন্যা, জলোচ্ছাস, খরা) আছে মানুষের সৃষ্ট দুর্যোগ। যেমন, জঙ্গি মৌলবাদ। এরা দেশে ইসলামী শাসন কায়েম করতে চায়। এই উদ্দেশ্যে প্রায়ই তারা বোমাবাজি করে। দেশটিতে আমেরিকার মতোই প্রধান দুটি দল। পরস্পরের প্রতি এদের আচরণ অত্যন্ত বিদ্বেষপূর্ণ। যে দল ক্ষমতায় থাকে না, তার প্রধান লক্ষ্য থাকে হরতাল দিয়ে দেশকে অচল করে দেওয়া। হরতাল মানেই দোকানপাট, গাড়ি ভাঙচুর।’

এমন বেশকিছু বর্ণনার পর বিদেশি ভদ্রলোক বাংলাদেশের ঢাকা শহরের মানুষের পহেলা বৈশাখ উদযাপনের এক বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন। অবশ্য তিনি এটা বলতেও ভুল করেননি যে – ‘এই দেশটিতে সরকারিভাবে কিংবা কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই বাংলা ক্যালেন্ডার অনুসরণ করা হয় না। এই ক্যালেন্ডারের ব্যবহার বিভিন্ন উৎসবের দিন নির্ধারণে। বাংলা ক্যালেন্ডারে নববর্ষ হলো বৈশাখের প্রথম দিন। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে এপ্রিলের ১৪ তারিখ।’ পহেলা বৈশাখের আবহাওয়ার বর্ণনাও দেয়া হয়েছে – ‘দিনটি ছিল অসম্ভব গরম। তাপমাত্রা তেত্রিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সূর্যের প্রখর উত্তাপ।’

তিনি বনানী থেকে একটা রিকশা নিয়ে শহর কেন্দ্রের দিকে যাচ্ছিলেন। প্রতিটি রিকশার পেছনের বহুবর্ণ পেইন্টিংও তাঁর দৃষ্টি এড়ায়নি। এরপর তিনি বাংলাদেশের মানুষের মনস্তত্বের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর মতে – ‘বাংলাদেশের সবাই হাসিখুশি। আন্তর্জাতিক একটি জরিপে বাংলাদেশ বিশ্বের সুখী দেশ হিসেবে শীর্ষ অবস্থানে স্থান করে নিয়েছে।’ রিকশাচালক হাসিখুশি যুবক হামিদ এরপর তাঁকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন উৎসবের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। হামিদের ভাষায় – ‘সূর্য উঠার আগে আমাদের অনুষ্ঠান শুরু হয়। রমনা বটমূলে। কী সুন্দর গান যে হয়! গান শুনলে চোখে পানি আসে।’

ইলিশ মাছ ভাজা দিয়ে এরপর পান্তাভাত খাওয়ার কথা এসেছে। এসেছে পোশাকের কথা। ফাল্গুন মাসের এক তারিখে মেয়েদের পরতে হয় হলুদ শাড়ি। আর পহেলা বৈশাখে পরতে হয় লাল শাড়ি। এরপর শাড়ি বিষয়ে বলা হয়েছে – ‘শাড়ি বাংলাদেশের মেয়েদের প্রধান পোশাক। এটা ছয় গজ লম্বা ও সোয়া গজ প্রস্থের একখণ্ড বর্ণিল বস্তু।’ এরপর এসেছে মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রসঙ্গ। সেটাকে তিনি ব্রাজিলের সাম্বা উৎসবের শোভাযাত্রার সঙ্গে তুলনা করেছেন। মঙ্গল শোভাযাত্রাতে সবাই মুখোশ পরে উদ্দাম মিছিল করে। পহেলা বৈশাখের উৎসবে মেয়েদের কাঁচের চুড়ি কেনা নাকি বাধ্যতামূলক।

এরপর রিকশাচালক হামিদ নিজের টাকায় উনাকে পান্তা ইলিশ খাওয়ান। এটাতে আমাদের চিরায়ত অতিথি পরায়ণতার দিকটি ফুটে উঠেছে। এরপর তিনি তার অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন এইভাবে – ‘আমি আমেরিকান। আমেরিকানরা আবেগশূন্য না। তবে আবেগে আমেরিকানদের চোখ কখনো ভিজে ওঠে না। আমি লক্ষ করছি, আবেগে আমার চোখ ভিজে উঠছে। যে দেশের মানুষ দুঃখ-কষ্ট-হতাশা-বঞ্চনা একপাশে ফেলে। আনন্দে মেতে উঠতে পারে, সে দেশের মানুষ অনেকদূর যাবে তা বলাই বাহুল্য। থ্রি চিয়ারস ফর দেম! হিপ হিপ হুররে!!’

এতো গেলো একজন বিদেশির চোখে দেখা আমাদের বর্ষবরণ উৎসবের বর্ণনা। এইবার আসি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞার বিষয়ে। টেলিকম কোম্পানিতে চাকুরীর সুবাদে দেশের প্রায় সবগুলো জেলা ঘুরে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। তখন দেখেছি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ঠিক কতটা পরিশ্রমী। খাতাকলমে আমরা দুর্নীতিতে শীর্ষে। এই দুর্নীতির সাথে সাধারণ মানুষের কোন যোগ নেই। কারণ একজন কৃষক যদি তার কৃষিকাজে ফাঁকি দেন তাহলে তিনি কোনদিনই কাঙ্খিত ফসল পাবেন না। একজন শ্রমিক কাজ না করলে তার পরিবার সেদিন না খেয়ে থাকবে। একজন প্রবাসী হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে তার উপর্জনের পুরোটাই দেশে পাঠিয়ে দেন। আমার মতে বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তি হচ্ছেন এইসব খেটে খাওয়া মানুষেরা।

আর উৎসব পালনের বিষয়টাও খুবই অনুপ্রেণাদায়ী। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ অতি সামান্যতেই আনন্দিতবোধ করেন। জীবনের মৌলিক প্ৰয়োজনগুলোর কোন কিছুই ঠিকঠাক না পাওয়া মানুষগুলো যখন কোন কিছু পেয়ে যান তখন তাদের খুশিটা হয় দেখার মতো। তারা বিশ্বাস করেন অদৃষ্টে। তারা তাদের সমস্ত না পাওয়ার দায় চাপিয়ে দেন সৃষ্টিকর্তার ঘাড়ে। উপরওয়ালা চান নাই বলেই আমি এটা পেলাম না। আসলে আমার ভাগ্যে নেই জিনিসটা তাহলে পাবো কিভাবে। এমন মনস্তত্ব যাদের তাদেরকে আপনি শত বাধা দিয়েও আটকে রাখতে পারবেন না। উৎসবের দিনে সামান্য একটু ভালো খাবার, সস্তার একটা পোশাক তাদেরকে অপরিমেয় আনন্দ দেয়। সামান্য একটা মাটির পুতুলও যেন তাদের কাছে সাত রাজার ধন।

বাংলাদেশের শিক্ষিত, শহুরে, সংস্কৃতিমনা মানুষেরা কখনোই এই দেশটাকে নিজের মনে করে না। এরা দেশের সাধারণ মানুষের দেয়া ট্যাক্সের টাকায় পড়াশোনা করে আরো বেশি নিরাপত্তার আশায় বিদেশে পাড়ি জমায়। পাশাপাশি দেশের সব সহায় সম্পত্তি বিক্রি করে সেই টাকাটাও সাথে করে নিয়ে যায়। আর শিক্ষিত দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা দুর্নীতির টাকা হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচার করে সেখানে প্রাসাদ গড়ে তোলেন। কিন্তু প্রবাসী শ্রমিকেরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যৎসামান্য যাই উপার্জন করেন খেয়ে না খেয়ে তার পুরোটাই দেশে পাঠিয়ে দেন। তাই শিক্ষিত এবং দুর্নীতিবাজদের শতশত কোটি টাকা পাচারের পরও আমাদের দেশটা তলাবিহীন ঝুড়ি হয়ে যায় নাই।

এরপর আছে আমাদের দুঃখী বাংলা ভাষা। দুঃখী কেন বলছি। আমরাই মনেহয় পৃথিবীর বুকে একমাত্র জাতি যারা ভাষার জন্য বুকের তাজা রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করেছিল। রাষ্ট্রের সব পর্যায়ে তাই মাতৃভাষা বাংলার প্রচলন হওয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু উপনিবেশের দাস আমাদের শিক্ষিত মানুষেরা সেটা হতে দেয়নি অত্যন্ত সচেতনভাবে। কারণ সবকিছু যদি বাংলায় লেখা হয় তাহলে তাদের একক কতৃত্ব খর্ব হবে। তাদেরকে আর কেউ মানবে না। তাই এখনও আমাদের সমাজে ভুলভাল বিদেশি ভাষা বলাটাকে স্মার্টনেস ধরা হয়। শিক্ষিত মানুষদের পরিবারে বাংলা ভাষার কোন স্থান নেই। যদি কেউ বাংলায় কথা বলেন তাকে দেয়া হয় ‘খ্যাত’ ট্যাগ। আর যদি কেউ স্থানীয় আঞ্চলিকতায় কথা বলেন তাহলে তাকে দেয়া হয় ‘মূর্খ’ ট্যাগ। শিক্ষিত মানুষেরা তাই দিনে দিনে বাংলাটাকে ভুলে যান।

বাংলাদেশ বলি আর বাংলা ভাষায় বলি এই দুটোকেই টিকিয়ে রেখেছে আপামর সাধারণ মানুষ। তারাই দেশটাকে নিজের মনেকরেন। তাদের তো আর দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার কোন জায়গা নেয়। তাই দেশের উৎসবগুলোও তারাই টিকিয়ে রাখেন। ইদানিং শহরের মানুষের মধ্যে একটা প্রবণতা লক্ষ করলাম। গ্রামের প্রতি তাদের ভালোবাসা দেখানোর জন্য শহরে তারা ‘গ্রামের মিনিয়েচার’ তৈরি করে নিয়েছেন। এতেকরে এখন আর শেকড়ের টানে শহর থেকে গ্রামে যেতে হয় না। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তারা এই মিনিয়েচার দেখিয়েই আত্মপ্রসাদে ভুগেন। এটা যে কতবড় আহাম্মকি সেটা নূন্যতম বোধবুদ্ধিসম্পন্ন যেকোন মানুষের পক্ষেই অনুভব করা সম্ভব কিন্তু আমাদের শিক্ষিত মানুষেরা সেটা টের পান না কারণ তারা শিক্ষিত হবার পাশাপাশি জড় বস্তুতেও পরিণত হন।

যাইহোক তবুও বাংলাদেশ এগিয়ে যাবেই। বিদেশি মানুষটার কণ্ঠের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে তাই বলতে ইচ্ছে করে, যে দেশের মানুষ দুঃখ-কষ্ট-হতাশা-বঞ্চনা একপাশে ফেলে আনন্দে মেতে উঠতে পারে, সে দেশের মানুষ অনেকদূর যাবেই। আমিও ব্যক্তিগতভাবে অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথেই এটা বিশ্বাস করি। আমরা যারা দেশের এবং দেশের মানুষের সমালোচনা করি আমরা আসলে কখনোই দেশটাকে আপন মনেকরি না, নিজের মনেকরি না। দেশটার মালিক সাধারণ মানুষেরা। তারাই দেশটাকে, ভাষাটাকে লালন করেন। কারণ তাদেরকে দেশেই থাকতে হয়, বাংলা ভাষাতেই কথা বলতে হয়। থ্রি চিয়ারস ফর দেম! হিপ হিপ হুররে!!

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Developed By ThemesBazar.Com