মূল সেতুর সঙ্গে সংযোগ সেতু বা উড়ালপথে (ভায়াডাক্ট) রেলিং বসানোর জন্য স্ল্যাব ঢালাইয়ের কাজ করছিলেন রফিকুল ইসলাম। তিনি জানালেন, দিন-রাত কাজ চলছে। হাতের ইশারায় তিনি দেখালেন সেতু থেকে পশ্চিম দিকে তাকালে কবতুরখালী গ্রাম। ওই গ্রামেই তাঁর বাড়ি। আধা কিলোমিটার হবে হয়তো। তার পরও ছয় মাস ধরে বাড়ি যেতে পারছেন না, কারণ ছুটি নেই।
গত মঙ্গলবার সরেজমিনে পদ্মা সেতু প্রকল্প এলাকা ঘুরে শ্রমিকদের কর্মব্যস্ততার এমন চিত্র দেখা গেছে। কর্মরত প্রকৌশলীরা বলছেন, এখন কাজ অতি সামান্যই বাকি রয়েছে। তাঁদের ভাষায় ‘ফিনিশিং টাচ’ দেওয়ার কাজ চলছে।
গত ১ জুন পর্যন্ত সেতুর কাজের অগ্রগতির প্রতিবেদন বলছে, মূল সেতুর দুই হাজার ৯১৭টি রোডওয়ে স্ল্যাবের মধ্যে বসানো হয়েছে দুই হাজার ৬৫২টি। অর্থাৎ কাজ সম্পন্ন হয়েছে ৯১ শতাংশ। বাকি আছে ২৬৫টি রোডওয়ে স্ল্যাব বসানোর কাজ। দুই হাজার ৯৫৯টি রেলওয়ে স্ল্যাবের মধ্যে বসানো হয়েছে দুই হাজার ৯৪৫টি। অর্থাৎ কাজ সম্পন্ন হয়েছে ৯৯ শতাংশ। বাকি আছে ১৪টি রেলওয়ে স্ল্যাব বসানোর কাজ। ৮৪টি রেলওয়ে আই গার্ডার বা রেলিংয়ের মধ্যে সবই বসানো হয়েছে। ৪৩৮টি সুপার গার্ডারের মধ্যে সব বসে গেছে।
১ জুন পর্যন্ত মূল সেতুর বাস্তব কাজের অগ্রগতি ৯৩.৫০ শতাংশ। আর প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৮৬ শতাংশ। এই অগ্রগতি বিবেচনায় কর্মকর্তারা বলছেন, পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ এগোলে আগামী জুনে সেতু দিয়ে যানবাহন চলাচল শুরু হবে। একই দিন ট্রেন চালুরও লক্ষ্য আছে।
কর্মকর্তারা বলছেন, শ্রমিকদের ছুটি দিলে কাজ পিছিয়ে পড়বে। জুন মাসে সেতু উদ্বোধন করা যাবে না। গত ঈদের দিনও তাঁরা আট ঘণ্টা কাজ করেছেন। কর্মকর্তারাও কেউ ছুটি নেন না।
মূল সেতুর কাজের অগ্রগতি : পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিলোমিটার। দুই প্রান্তের ভায়াডাক্ট অর্থাৎ সংযোগ সেতুর দৈর্ঘ্য ৩.৬৭ কিলোমিটার। অর্থাৎ সেতুর মোট দৈর্ঘ্য ৯.৮২ কিলোমিটার। সেতুর দক্ষিণ প্রান্ত মিশেছে শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার নাওডোবা এলাকায়। উত্তর প্রান্তে সেতু শুরু হয়েছে মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার মাওয়া এলাকা থেকে। গত ১০ ডিসেম্বর পদ্মা সেতুর সর্বশেষ বা ৪১তম স্টিলের স্প্যান জোড়া দেওয়ার মাধ্যমে মূল সেতুর পুরোটা দৃশ্যমান হয়। দ্বিতলবিশিষ্ট পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে চলবে যানবাহন আর ভেতর দিয়ে চলবে ট্রেন। এখন সেতু পারাপারের জন্য কংক্রিটের স্ল্যাব জোড়া দিয়ে সড়ক ও রেলপথ তৈরি হচ্ছে।
মূল সেতুকে মাটির সঙ্গে যুক্ত করার জন্য দুই প্রান্তে রয়েছে ভায়াডাক্ট। দুই প্রান্তে দুই ভাগ হয়ে এই ভায়াডাক্ট মিশেছে সংযোগ সড়কের সঙ্গে। একটি ভায়াডাক্ট দিয়ে যানবাহন মূল সেতুতে উঠবে এবং অন্যটি দিয়ে নেমে যাবে। দুই প্রান্তে সড়ক সেতুর দুটি ভায়াডাক্টের মাঝখান দিয়ে ট্রেন মূল সেতুতে ওঠা-নামার জন্য থাকবে আরেকটি ভায়াডাক্ট।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মূল সেতুর কাঠামো তৈরি করতে মোট ৪১টি ট্রাস বা স্প্যান ব্যবহৃত হয়েছে। এই স্প্যানের ওপর দুই হাজার ৯১৭টি রোডওয়ে স্ল্যাব বসানো হবে। গত ১ জুন কাজের অগ্রগতির হিসাবে ২৬৫টি স্ল্যাব বসানোর কাজ বাকি আছে। পাঁচ হাজার ৮৩৪টি শেয়ার পকেটের মধ্যে বাকি রয়েছে ৮১২টি। মূল সেতু ও ভায়াডক্ট মিলে রোডওয়েতে মোট ১২ হাজার ৩৯০টি প্যারাপেট ওয়াল বা রেলিং বসানো হবে। এর মধ্যে এক হাজার ৮৯১টি বসানো হয়েছে। অর্থাৎ বাকি আছে ৮৫ শতাংশ কাজ। রোডওয়েতে পানি নিরোধক একটি স্তর (ওয়াটার প্রুফ মেমব্রেন) বসানো হবে। এর ওপর সিমেন্ট ও পিচ ঢালাই হবে। পানি নিরোধন স্তর স্থাপনের কাজ এখনো শুরু হয়নি। সেতুর নিরাপত্তা এলাকায় এই স্তর বসানোর পরীক্ষামূলক কাজ করে তা পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে অনুমোদন পেলে এই স্তর বসানোর কাজ শুরু হবে। এখনো সড়ক বাতি লাগানোর কাজ শুরু হয়নি। বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার কাজও বাকি। পদ্মা সেতুতে ৫০০ কেভিএ বিদ্যুতের প্রয়োজন হবে। সেতুতে বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য জাজিরা ও মাওয়া প্রান্তে দুটি সাবস্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে। জাতীয় গ্রিড থেকে ওই সাবস্টেশনে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে। পদ্মা সেতুতে প্রতিদিন কত টাকার বিদ্যুৎ খরচ হতে পারে এমন প্রশ্নে কর্মকর্তা জানান, এখনো সে হিসাব চূড়ান্ত করা হয়নি। সেতুতে বিদ্যুৎ সরবরাহের কাজ ইজারা দেওয়া হবে। ইজারা পাওয়া প্রতিষ্ঠান নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ ও আনুষঙ্গিক কাজের দায়িত্ব পালন করবে। সেতুর ওপর গ্যাস লাইন বসানোর কাজ চলছে।
অন্যদিকে রেলওয়ে স্ল্যাব বসানো হয়ে গেলে আগামী সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাস থেকে সেতুতে রেল ট্র্যাকও বসানো শুরু হবে বলে রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
পদ্মা সেতু বহুমুখী প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান মো. আবদুল কাদের কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কর্মপরিকল্পনা অনুসারে আগামী বছর ৩০ এপ্রিলের মধ্যে সেতুর বিদ্যুৎ সংযোগ ও বাতি লাগানোর কাজ সম্পন্ন সম্ভব হবে। রেলিংসহ অন্যান্য যে কাজ বাকি রয়েছে সেগুলো আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে এবং জুনের মধ্যে সেতুর কার্পেটিংয়ের কাজ শেষ হয়ে যাবে। জুন মাসেই পদ্মা সেতু যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া সম্ভব হবে।’
তবে সেতুতে কর্মরত একাধিক প্রকৌশলী জানিয়েছেন, আশা করা যায় আগামী বছর মার্চ মাসে অর্থাৎ ঘোষিত জুন মাসের দুই মাস আগেই পদ্মা সেতু যান চলাচলের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে।
পদ্মা সেতু সরকারের অগ্রাধিকার তালিকার একটি বৃহৎ প্রকল্প। এ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। ১ জুন পর্যন্ত প্রকল্পে মোট ব্যয় হয়েছে ২৫ হাজার ২৬০ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
রেল সংযোগের কাজ : পদ্মা সেতু প্রকল্পের সঙ্গে বাস্তবায়িত হচ্ছে আরেকটি মেগা প্রকল্প, সেটি হচ্ছে রেল সংযোগ প্রকল্প। ঢাকা থেকে যশোর পথ ১৬৯ কিলোমিটার ডুয়াল গেজ রেলপথ হচ্ছে এই প্রকল্পের আওতায়। এই রেলপথের সংযোগ ঘটবে এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে।
পদ্মা সেতুর সঙ্গে রেল সংযোগ সেতুর কাজও চলছে পুরোদমে। রেল প্রকল্পের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আগামী জুন মাসে পদ্মা সেতুতে যান চলাচলের দিনই ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু দিয়ে ট্রেন যাবে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, গত ৩ মে পদ্মা মূল সেতুর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রেলের ২১ কিলোমিটারের এলিভেটেড অংশ। এপ্রিল পর্যন্ত পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্পের অগ্রগতি হয়েছে ৪১.৫০ শতাংশ আর আর্থিক অগ্রগতি ৪২.৯০ শতাংশ।
১৬৯ কিলোমিটার মূল রেললাইনের সঙ্গে লুপ ও সাইডিং রয়েছে ৪৩.২২ কিলোমিটার। আর ডাবল লাইন তিন কিলোমিটারসহ মোট ২১৫ দশমিক ২২ রেল ট্র্যাক নির্মিত হচ্ছে।
কর্মকর্তারা জানান, রেল সেতুর মধ্যে থাকছে দুই প্রান্তে ২৩.৩৭৭ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট, ১.৯৮ কিলোমিটার র্যাম্পস। পুরো রেলপথে ৬৬টি বড় সেতু থাকছে। ছোট সেতু, কালভার্ট ও আন্ডারপাস থাকছে ২৪৪টি। এ ছাড়া একটি হাইওয়ে ওভারপাস, ২৯টি লেভেলক্রসিং থাকছে। চলছে ১৪টি নতুন স্টেশন নির্মাণ এবং ছয়টি বিদ্যমান স্টেশনের উন্নয়ন ও অবকাঠামো নির্মাণকাজ। সঙ্গে ২০টি স্টেশনে টেলিযোগাযোগসহ সিস্টেম সিগন্যালিং ব্যবস্থাপনা। রেলপথের জন্য দুই হাজার ৪২৬ একর ভূমি অধিগ্রহণের কাজ চলমান।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, মাওয়া-ভাঙ্গা অংশের কাজের অগ্রগতি ৬৬ শতাংশ, যার মধ্যে প্রিকাস্ট বক্সগার্ডার সেগমেন্ট বসানোর কাজ শেষ। আর বড় সেতু, ভায়াডাক্ট ৩-এর পিয়ার ও বাঁধ (এমব্যাংকমেন্ট), সপ্যান বসানো, কালভার্ট ও আন্ডারপাসের কাজ প্রায় শেষের পথে। তবে বাঁধের কাজ অনেকটা বাকি আছে।
ঢাকা-মাওয়া অংশের কাজের অগ্রগতি ৩৬ শতাংশ আর ভাঙ্গা থেকে যশোর পর্যন্ত অংশের নির্মাণকাজের অগ্রগতি ২৫ শতাংশ। কবে নাগাদ রেল ট্র্যাক বসানো শুরু করা যাবে এমন প্রশ্নে মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, আগামী সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে এই কাজ শুরু করা যাবে।
৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পে ১৮ হাজার ২১০ কোটি ১১ লাখ টাকা দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। বাকি ২১ হাজার ৩৬ কোটি ৬৯ লাখ টাকা ঋণ দিয়েছে চায়না এক্সিম ব্যাংক। প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয় ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। ২০১৬ সালের ২৭ এপ্রিল প্রকল্পটি সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্পের তালিকাভুক্ত করা হয়। তিন ভাগে বিভক্ত প্রকল্পের কাজ হচ্ছে ঢাকা-মাওয়া, মাওয়া-ভাঙ্গা ও ভাঙ্গা-যশোর অংশে। এর মধ্যে ঢাকা-মাওয়া ও ভাঙ্গা-যশোর অংশের বাস্তবায়নকাল ধরা হয়েছে ২০২৩ সাল। প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেড (সিআরইসি)। প্রকল্পের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কনস্ট্রাকশন সুপারভিশন কনসালট্যান্ট (সিএসসি) কাজ করছে।
এদিকে গত ১ জুন পর্যন্ত অগ্রগতি প্রতিবেদন অনুযায়ী, পদ্মা সেতু প্রকল্পের নদীশাসনের কাজের বাস্তব অগ্রগতি ৮৩.৫০ শতাংশ। আর্থিক অগ্রগতি ৭২.৩০ শতাংশ।