আমাদের এবারের যাত্রা রাঙামাটির বিলাইছড়ি। আমি, বন্ধু নিশান ও রুবেল ভাই এই তিনজনের পরিব্রাজক দল। পরিকল্পনা মতো রাতে তুর্ণা নিশিথায় চট্টগ্রামে যাওয়ার জন্য আমরা এয়ারপোর্ট স্টেশনে পৌঁছে যাই। রাইট টাইম ১১.৫৩, ট্রেন এসে পৌঁছলো ১১.৫৪। আমিতো খুবই অবাক, এতো টাইম মেনে চলে ট্রেন! যাইহোক হালকা আলাপচারিতায় মধ্যে দিয়ে যাত্রা শুরু। ঘুমাতে গিয়ে যত বিপত্তি। ট্রেনের এসি কোচে লাইট বন্ধ হয় না। সারা রাত ধরে আলো জ্বলতে থাকলো। এতে যা হলো, ভিতরের সবকিছু দৃশ্যমান, কিন্তু বাহিরের কিছুই আর দেখা যাচ্ছে না। স্টেশনের আকাশে বড় একটা চাঁদ দেখে এসেছিলাম। ভেবেছিলাম ট্রেনের জানালা দিয়ে চাঁদের স্নিগ্ধ আলো উপভোগ করবো। কিছুই দেখা হলো না। একেতো ঘুমুতে পারছি না তারওপর একটা টিভি চলছে, সেটা করছে ঝিরঝির। ছবি ভালো না, কি চলছে শব্দ না থাকায় কিছুই বোঝা যায় না। শুধু শুধুই বসে আছি। এসি কামরা কিছুক্ষণ পরপর শীতও লাগছে। এভাবে আফসোস করে করে রাত পার হয়ে গেলো।
শহর থেকে যত বের হচ্ছি ততই মনের মধ্যে ভালো লাগা শুরু হচ্ছে। রাঙ্গুনিয়া পার হবার পর কুয়াশায় আশেপাশে দেখা যাচ্ছিলো না। শীতের বাতাস গায়ে মেখে আমরা স্মৃতিচারণ করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। কুয়াশার আড়ালে সুর্য দেখা, রাস্তার পাশে শিশিরস্নাত সবুজ সবজির ক্ষেত। ভোরের নরম আলোয় গ্রাম্য জীবন কতদিন পর দেখছি সেটা নিয়ে নিজেরা আফসোস করছি।
কাপ্তাইয়ের কাছাকাছি চলে আসতেই চারপাশের দৃশ্যপট বদলে যেতে থাকে। পাহাড়ি রাস্তার পাশে অনেক নীচ দিয়ে বয়ে চলা কর্ণফূলী নদীর ওপর আটকে পড়া ভাসমান সাদা কুয়াশার দৃশ্য মনের ভিতরটা নাড়িয়ে দেয়। নদীর ওপর জাঁকিয়ে বসা কুয়াশায় সেজেছে দুপাশের সবুজ প্রকৃতি, পাহাড়ি পথে যেতে যেতে মাঝে মাঝেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি। দেখতে দেখতে কাপ্তাই জেটি ঘাটে পৌঁছে যাই সাড়ে আটটা বাজার বেশ কিছুটা আগেই। হালকা কিছু খাবার কিনেই উঠে পড়লাম ট্রলারে। ঠিক সময়েই ছেড়ে দিলো ট্রলার। বিলাইছড়ি পর্যন্ত মাথা পিছু ভাড়া পড়লো ৫৫ টাকা।
সকালের স্নিগ্ধতা এখনও প্রকৃতিজুড়ে। পেটের মধ্যে টান অনুভবেই খাওয়া শুরু করলাম। ধীরে ধীরে লোকালয় ছেড়ে আমরা পাহাড় আর জলের নান্দনিক হৃদয় দোলানো প্রকৃতিতে প্রবেশ করছি। ট্রলারের ছাদে বসে বিস্তৃতি জলাধারের রূপে আমি মাঝে মাঝেই হারিয়ে যাচ্ছি। যতদূর চোখ যায় পাহাড়ের কোল ঘেষে জলের সীমারেখা। নীলাভ জলের ভিতরে ভিতরে ছোট ছোট দ্বীপের মতো টিলা। সেসব ছোট ছোট টিলায় মানুষের বসতি। ওদের দেখে ঈর্ষা হয়। একটা দ্বীপের মালিক নিজেই। ইশ! আমার যদি এরকম একটি টিলা থাকতো! শহুরে জীবনের প্রতি তীব্র ঘৃণায় থুথু মারলাম জলের দিকে। এই সভ্যতা কি দিয়েছে আমায়। যান্ত্রিক আর জটিলতার নোংরা অনুভূতি ছাড়া আর কিছুই না না না। ট্রলারের একঘেয়ে শব্দও আমার মনের এই ভাবনা সরাতে পারছিলো না। ইচ্ছে হচ্ছিলো স্বচ্ছ নীলাভ জলের ভিতর লাফ দিয়ে ডুবে যাই। এই নাগরিক শহর আর দেখতে চাই না। ফিরতেও চাই না।
পানির রাজ্যের মনমাতানো সৌন্দর্য দেখতে দেখতে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। শীতল হাওয়ায় শরীরটা কাঁপছে। তবুও বিরক্ত হচ্ছি না। চোখে পড়ছে জলরাশির মধ্যভাগে জেগে থাকা ছোট ছোট সবুজ দ্বীপ। দিগন্ত বিস্তৃত নীল আকাশের নিচে নীলাভ পানি। লেকের নীল ঢেউ কেটে কেটে ঘরে ফেরা মানুষ নিয়ে যাচ্ছে নৌকাগুলো। পাহাড় ছুঁয়ে কাছে-দূরে কেবল রাশি রাশি নীল জল। একটা পাহাড়ের পিছনে আরেকটি অস্পষ্ট দূরের পাহাড়। ছোট ছোট ঢেউয়ের শান্ত নীল পানি। দূরে তাকালে নীল পানি, কাছে আসলে স্বচ্ছ সবুজ পানি। আমি শুয়ে পড়লাম, বিশাল নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি। আহা কতোদিন! চিন্তাহীন হয়ে আকাশ দেখিনা। কি! সুন্দর মনোরম নীল আকাশ।
এখানেই ফিরে আসার স্মৃতিচারণ করাটাই যৌক্তিক। দুদিন পর আমরা বিলাইছড়ি থেকে কাপ্তাইয়ে ফিরতে ট্রলারে উঠি বিকেল ৪.৩০। এটাই কাপ্তাই ফেরার শেষ ট্রলার। ফিরতে ফিরতে লেকের ভিতরে সন্ধ্যা নামে। আলো-আধারির খুনসুটিতে গাছের আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে সূর্য। মেঘছোঁয়া পাহাড়ের বুকে রক্তিম সূর্যটা ডুবে যাচ্ছে। রাঙানো অসীম আকাশে নীড়ে ফেরা পাখি। রক্তিম উদার আকাশ। আকাশের গাঁয়ে অগ্নিশিখা! ঝিরিঝিরি বাতাস ছুঁয়ে যাচ্ছে শরীর। দিগন্তে হলুদ-লাল রঙ মেখে আকাশটা সেজেছে গায়ে হলুদের বধূর মতো। সব মিলে মনোমুগ্ধকর। আসলে এসব দৃশ্য বর্ণনার চেয়ে বেশি উপলদ্ধির। একাকী দুঃসময়ের জন্য আমি মাথা ভর্তি এসব স্মৃতি নিয়ে নিলাম।
হ্রদের জল কেটে কেটে এগিয়ে যাচ্ছে ট্রলার। ট্রলারের পিছনে ঢেউয়ের রেখা। গোধূলিরাঙা আলোর ছায়া পড়েছে হ্রদের জলে। রাঙা আলোতে মনে আনে অপার্থিব প্রশান্তি। পাশ দিয়ে চলে যাওয়া নৌকার স্পর্শে জেগে উঠা ঢেউ- জলে তরঙ্গ তোলে, কেঁপে উঠে সোনা রঙের জলের ওপর ভাসমান উপরের আকাশ। রাত্রির আগমনে হারিয়ে যাওয়া গোধুলির সাথে আমারও মনে আসে বিরহ।
যতই দেখছি চোখের তৃষ্ণা মিটে না। আমার ইচ্ছে করছিলো শহরে ফিরে না যাই, হ্রদের যেকোন একটি পাহাড়ে থেকে যাই, থেকে যাই। চলমান ট্রলারের সাথে একটি একটি করে পাহাড় পিছনে চলে যাচ্ছে আর বহুমাএিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ আমি হতাশা নিয়ে লোভের চোখে তাকিয়ে আছি। হায় মানব সভ্যতা, হায় মানব মন।
চলুন আমরা আবার বিলাইছড়ি যাওয়ার পথে চলে যাই। আস্তে আস্তে সকালের আলোর তেজ বাড়ছে। তবুও আলোটা মনোরম। দিগন্তে নীল আকাশ। পাহাড় আর জল দেখতে দেখতে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। আমরা কিছু ছবিও তুলে নিলাম।
কিন্তু সবুজাভ জলের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর আমার মনটা একেবারে বেদনাকাতর হয়ে পড়লো। আমার মনে হচ্ছে এই জলের নিচে কতগুলো মানুষের হাহাকার ডুবে আছে। কত মানুষের স্মৃতি-দুঃখ চাপা দিয়েছি এই জল দিয়ে। আমার কেনো জানি মনে হচ্ছে জলের মধ্যে আমি ডুব দিলেই দেখতো পাবো অনেক নারী-পুরুষ বসে আছে। জলের নিচে ওরা একটা বিস্ময় চোখ নিয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে আছে। এইতো সেই হ্রদ। যা লক্ষ মানুষকে বাস্তুচ্যুত করেছে। জলের নিচে ডুবে গেলো কারো স্বপ্ন, স্মৃতি, পূর্বপুরুষ।
এই কাপ্তাই হ্রদ রাঙামাটি জনপদের দুঃখ। এই বাঁধ হাজারো মানুষের ট্র্যাজেডি। এই জলে মিশে আছে লাখো মানুষের চোখের পানি। আজ এই হ্রদ দেখে যতটা মানসিক প্রশান্তি পেলাম, যান্ত্রিক সভ্যতা থেকে দূরে এসে আরামবোধ করছি। আসলে তা অন্য মানুষের দুঃখের ওপর গড়ে উঠা। হাজারো মানুষের স্বপ্নকে মৃত্যু দিয়ে আজ আমরা শান্তি খোঁজতে এসেছি এখানে।
একটু তথ্য দেই- পঞ্চাশের দশকে বাঁধ নির্মাণের কারণে ৬৫৫ বর্গ কিলোমিটারে এলাকা প্লাবিত হয়, যার মধ্যে ছিলো ২২ হাজার একর চাষাবাদযোগ্য জমি। উর্বর সমতল ভূমিতে কৃষিকাজ করতো যে মানুষগুলো। তারা উচ্ছেদ হলো এই বাঁধ নির্মাণে কিন্তু কেউ সমপরিমাণ উর্বর চাষাবাদযোগ্য জমি ফিরে পায় নি। জল বেড়েছে সবকিছু ফেলে পাহাড়ে পাহাড়ে উঠে যেতে হয়েছে এদেরকে। ১৮ হাজার মানুষের ঘরবাড়ি বিলুপ্ত হয়ে যায়, প্রায় ১ লক্ষ মানুষকে তাদের আবাসভূমি থেকে সরে যেতে হয়েছে। কিন্তু বিনিময়ে কি পেলো তারা?
সবুজে ঘেরা শান্ত জলের নিচে দুঃখগাঁথা আর শোকের আর্তনাদ ডুবিয়ে রেখেছি আমরা সভ্যতার নামে। এই লেকের মাঝেই বিলীন আসল কর্ণফুলী নদী। হায় নাগরিক জীবন!
যেতে যেতে পাহাড়ের গাঁয়ে বসবাসরতদের নিয়ে আমার কষ্ট অনুভব হয়। কতো সুবিধা থেকে এরা বঞ্চিত। কয়েকটা শিশু-কিশোরকে দেখলাম ট্রলারে উঠতে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে শিক্ষার্থী। এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে যাচ্ছে পড়াশুনার জন্য। এরাও শিক্ষাগ্রহণ করছে আর ঢাকার শিশুরাও শিক্ষা নিচ্ছে।
এরকম হাজারো চিন্তা নিয়ে গাছকাটাছড়া আর্মি ক্যাম্পে পৌঁছে যাই। নাম এন্ট্রি করে আবার যাত্রা। এটা এখানকার নিয়ম যেকোন ট্রলারকে যেতে-আসতে হলে ক্যাম্পে জানাতে হবে। এই ক্যাম্প পার হতেই ধীরে ধীরে মানুষের বসবাসের চিহ্নগুলো দেখা যেতে শুরু করলো।
হ্রদ থেকে দেখে মনে হলো পাশাপাশি তিনটি পাহাড়ের পাদদেশে এই বিলাইছড়ি। পাহাড়ের পাদদেশে গড়ে উঠা বিলাইছড়িতে আপনাকে স্বাগতম।
তালহা বিন জসিম