শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ০১:০৫ অপরাহ্ন
Uncategorized

নিশীথ সূর্যের দেশে

  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১৪ জানুয়ারি, ২০২২

সুইডেন-এর মাটিতে পা দিয়ে মনে হ’ল এই দু’দিন গরম জামাকাপড়ের বুঝি বা আর প্রয়োজন পড়বে না। কলকাতার তীব্র দাবদাহ থেকে এসে কনকনে ঠান্ডায় বেশ মজা পেয়ে গেছি, অভ্যস্ত হ’য়ে পড়েছি।

স্টকহোমে পৌঁছে আবহাওয়া খানিক উষ্ণ ও শুষ্ক লাগলো। মনটা খানিক দ’মে গেল। তবে গরম বলা মানায়না, অন্তত ভারতবাসীর। বিকেল নাগাদ বীর দর্পে সোয়েটার ছাড়াই বেরিয়ে পড়লাম। প্রকৃতিদেবী হয়তো তখন অলক্ষ্যে মুচকি হেসেছিলেন। হোটেলের বাইরে এসে প্রাণ জুড়িয়ে গেল। বসন্ত শুরুর মত ঈষৎ ঠান্ডা অথচ আরামদায়ক বাতাস বইছে হু হু করে।

হঠাৎ ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি শুরু হলো। ব্যাস ! আমূল বদলে গেলো আবহাওয়া! এক লহমায় তাপমাত্রা নেমে গেল অনেকখানি। তখন সোয়েটার আর মোজার জন্য মন হু হু করতে লাগল। বুঝলাম আজ সন্ধ্যেটা কেঁপেই ঘুরতে হবে।

স্টকহোমের ভৌগোলিক অবস্থান সুইডেনের পূর্ব উপকূলে Mālaren হ্রদের মোহনায়। জলাশয়ের আধিক্যের কারণে এই শহরকে বলা হয় ‘স্ক্যান্ডিনেভিয়ার ভেনিস’। ছোট বড় চোদ্দটি দ্বীপ নিয়ে বৃহত্তম স্টকহোম। দ্বীপগুলি পরস্পর সেতু দ্বারা যুক্ত। ‘স্টক’ শব্দের অর্থ রক্ষিত স্থান, আর ‘হলম’-এর অর্থ দ্বীপ। অর্থাৎ ‘সম্পদ রক্ষাকারি দ্বীপ’।

আয়তনে বেশ বড় শহর, মানুষজনের ব্যস্ততাও বেশি। তুলনামুলক ভাবে এরা খানিক গুরুগম্ভীর প্রকৃতির। কেউ কারো দিকে তেমন তাকায় না। নিজেদের মধ্যেই মগ্ন থাকে, নিচু স্বরে কথা বলে। ডেনমার্ক, নরওয়েতে যে কোনও রেস্তোরাঁর পাশ দিয়ে যাবার সময় উচ্চহাসি, উল্লাস শোনা গেছে। সুইডিশরা ঠিক তেমন নয়।

স্টকহোম শহরটি দুই ভাগে বিভক্ত। নতুন ও পুরনো। অনেকটা উত্তর ও দক্ষিণ কলকাতার মত।

মেট্রো রেলে চ’ড়ে এলাম ওল্ড সিটি Gamlastan এ। ‘Gamla’ অর্থ পুরনো, ‘Stan’ অর্থ টাউন।

পুরনো অংশে প্রাচীন আমলের বড় বড় বাড়ি। তাদের মাঝখান দিয়ে ছায়া ছায়া সরু গলি। সেই অঞ্চলের চেহারা ও পরিবেশ অপেক্ষাকৃত অনুজ্জ্বল।

শহরের নতুন অংশের নাম Norrmalm। এদিককার দোকানপাট, রেস্তোরাঁ অনেক বেশি ঝলমলে এবং লোকজন, বাসিন্দারাও অত্যাধুনিক পোশাক পরিহিত, চরম ফ্যাশানদুরস্ত। ক্রিস্টালের তৈরী তাক লাগানো শৌখিন সামগ্রীর ছড়াছড়ি নতুন শহরের দোকানগুলিতে।

স্কান্ডেনেভিয়ার রেস্তরাঁ ও ক্যাফেগুলির একটি বিশেষত্ব ভারি আকর্ষণীয়। প্রতিটির বাইরেই বেশির ভাগ পানাহারের ব্যবস্থা। ভিতরে গুটিকয় মানুষই বসেন। খোলা আকাশের নীচে সারি দিয়ে সাজানো টেবিলগুলিতেই ঠাসা ভীড়। শীতপ্রধান দেশ বলেই এমন চল। শীততাপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা হাতে গোনা কিছু জায়গায়। ফ্যানের অস্তিত্বই নেই।

ছুটির দিনে ছিপ ফেলে মাছ ধরা এদের অন্যতম প্রিয় নেশা, এ কথা বইতে পড়েছিলাম। আজ, রবিবার চাক্ষুষ করলাম। একটি canal এ সারি দিয়ে লোকেরা ছিপ ফেলে চুপ করে বসে আছেন মাছের আশায়।

‘FIKA’ খুব প্রচলিত একটি শব্দ স্ক্যান্ডিনেভিয়াতে। এর অর্থ ‘break’। একটানা কাজ করতে করতে যখন এরা হাঁপিয়ে ওঠেন তখন পরিবার, বন্ধুবান্ধবের সাথে কফি, নানা পানীয়, কেক ইত্যাদি নিয়ে ব’সে যান। শরীর মন চাঙ্গা ক’রে আবার কাজে ফেরা। যে কারণে অনেক ক্যাফে, রেস্তোরাঁয় ‘Fika’ শব্দটি লেখা দেখলাম।

এতো আমরা সকলেই জানি, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এখন যেমন এই দেশগুলিতে দিনের আলোর ভাগ বেশি, রাত মোটে ঘন্টা চারেক, সেপ্টেম্বরের পরেই এটি সম্পূর্ণ বিপরীত হ’য়ে যাবে। তখন দিনের আশি শতাংশ অন্ধকার, সূর্যের মুখ সাকুল্যে ঘন্টা তিন চার দেখা যাবে। যে’কথা নতুন জানলাম তা হলো, যে লম্বা সময়টা আঁধারের ভাগ বেশি, তখন নাকি এরা খুব বিষণ্ণ হ’য়ে থাকে। সূর্যের অভাব পুষিয়ে নেবার জন্যে রাস্তা, দোকান ইত্যাদিতে চড়া আলো জ্বালানো হয়। মনমরা ভাব কাটাতে বিশেষ কিছু হুল্লোড়, বিনোদনের ব্যবস্থা হয়। এখনই যে রাস্তায় হাঁটছি ফুলে ফুলে ছয়লাপ। সে সময় নাকি পথঘাট আরও উজ্জ্বল ক’রে তোলা হয় মনমেজাজ সতেজ রাখার জন্য। সূর্যের অনুপস্থিতির সময় এঁরা ক্যালেন্ডারের দিকে আকুল হ’য়ে চেয়ে থাকেন এই উষ্ণ আলোকোজ্জ্বল মাসগুলির জন্যে।

প্রকৃতির কাছে মানুষ চিরদিনই অসহায়। তাকে জয় করতে না পারলেও নিজেদের স্বচ্ছন্দ, উৎফুল্ল রাখার আয়োজনটুকু ঠিক সাজিয়ে নেয়।

সকাল ন’টায় হোটেল থেকে বেরিয়ে দেখলাম স্টকহোমের আকাশের আজ মুখ ভার। ঘন কালো পুঞ্জ পুঞ্জ সজল মেঘে ছেয়ে আছে গোটা শহর। যে কোনও অঞ্চলের রৌদ্রোজ্জ্বল চেহারা বা মেঘাচ্ছন্ন রূপ মনের ওপর সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রভাব ফেলে। রোদ ঝলমলে দিন যেমন হাসিখুশী টগবগে তরুণ, বাদলা মেঘে ছাওয়া শহর তেমনই বিষণ্ণ, থমথমে ব্যথিত কোনও মানুষের মুখের মতোই। ভ্রমণকারীদের তো আর আবহাওয়ার ভ্রূকুটি গ্রাহ্য করলে চলে না, পরিকল্পিত সফরসূচি মাফিক চলতেই হয়। মেট্রোরেল থেকে নেমে যখন পায়ে হেঁটে লঞ্চ অভিমুখে যেতে থাকলাম প্রায় দেড় কিলোমিটার পথ, শনশনে হিমশীতল বাতাস তীক্ষ্ণ বর্শার ফলার মতো বিঁধতে লাগলো সারা শরীর। মনে করিয়ে দিতে থাকল, আমরা রয়েছি উত্তর মেরু থেকে কেবল ৩৩০০ কিলোমিটার দূরত্বে।

প্রায় জাহাজের আয়তনের বিশালাকায় লঞ্চের ডেকে পেতে রাখা মেহগিনি কাঠের চেয়ারে যখন এসে বসলাম, মনে হলো দেহের সমস্ত অস্থির ঠকঠকানি শুনতে পাচ্ছি। হাত পা অসাড় হ’য়ে যাচ্ছে কনকনে ধারালো বাতাসে। প্রত্যেক যাত্রীকে দেওয়া হলো একাধিক নরম কম্বল, একটু উষ্ণতার জন্য। রংবেরঙের কম্বলে আপাদমস্তক মুড়ি দিয়ে সার বেঁধে ব’সে রয়েছেন যাত্রীরা, সেও এক ভারি মজার দৃশ্য। হাত বের করে ছবি তোলাই যেন সহ্যশক্তির কঠিন পরীক্ষা দেওয়া। কিছু পর শুরু হয়ে গেল ঝিরঝিরে বারিশ।

একটি বিশেষ দ্বীপ দেখানো হ’ল, নাম Djugården। প্রাকৃতিক সম্পদের কারণে এই দ্বীপটি বিশেষ ভাবে সংরক্ষিত। যে কোনও সাধারণ নাগরিকের অধিকার নেই এই নিরালা দ্বীপে গৃহনির্মাণের। বিশেষ ব্যক্তিত্বশালী মানুষ ও রাজরাজারা, অতীব শৌখিন নকশাদার বাড়িগুলিতে সপ্তাহান্তে অবকাশ যাপন করেন। বিত্তবানদের বিলাসিতার কতই না উপায় পৃথিবীজুড়ে !

প্রতিটি দ্বীপে একতল, দ্বিতল বাংলো আকৃতির খান ছয়-সাতেক বাড়ি, প্রতিটির সম্মুখে ছোট ছোট ফুলের বাগান ও ঘন সবুজ লতাগুল্মের ঝোপ। বাংলোগুলি অধিকাংশই টুকটুকে লাল বা গাঢ় নীল। ত্রিভুজাকৃতি ছাদগুলি বরফের মতো ঝকঝকে সাদা। সবুজ দ্বীপের মাঝে বাড়িগুলি যেন রূপকথার বইয়ের ছবির মতো জেগে আছে। প্রতি পরিবারের নিজস্ব ‘স্পিডবোট’ চেন দিয়ে বাইরে বাঁধা।

কাহাতক আর সহ্য করা যায় বরফঠান্ডা হাওয়া ! কাঁপতে কাঁপতে ঢুকে পড়লাম কাঁচের জানালা ঘেরা বন্ধ কেবিনের ভিতর। আরামপ্রদ উষ্ণ কেবিনের সোফায় ব’সে, এক কাপ ধোঁয়া ওঠা গরম কফিতে চুমুক দিয়ে অঙ্গ প্রতঙ্গে সাড় এল।

কেবিনের ডাইনিং-হলে পরিচয় হ’ল কফি কাপ নিয়ে আড্ডারত এক স্প্যানিশ পরিবারের সাথে। আমার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হ’য়ে উঠল সেই পরিবারের কনিষ্ঠতম সদস্য, মিছরিদানার মত মিষ্টি এক শিশুকন্যা। আদর পেয়ে খিলখিলিয়ে কি মধুর হাসি তার ঘন্টা আড়াই জলভ্রমণ সেরে যখন স্থলে ফিরলাম, ছিপছিপ বৃষ্টিতে ধুয়ে যাচ্ছে মসৃণ পথঘাট, ঠাণ্ডা আরও জাঁকিয়ে বসেছে স্টকহোম শহরের বুক জুড়ে।

আজ ঋতুদা’র চ’লে যাবার সেই বিষাদমাখা দিনটি। ২০১৩ র ৩০’শে মে ছিল এমনই এক বাদলাচ্ছন্ন দুপুর। কলকাতায় এই দিনে পর পর দু’বছর তেমনই আবহাওয়া হয়েছিল কাকতালীয় ভাবে ! আজ সুদূর উত্তর ইউরোপেও সেই মন কেমন করা মেঘলা আকাশ, ঝিরঝিরে বৃষ্টি ! প্রতিবছর পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তের আকাশ এই দিন কি এমন করেই কাঁদে?ঋতুদা-ই জানেন এমন আশ্চর্য সমাপতনের ব্যাখ্যা!!!

স্ক্যান্ডিনেভিয়া ছেড়ে এলাম। এখন যাবো ফিনল্যাণ্ড, যা Nordic Region-এর আওতায় পড়ে। এতকাল মানচিত্রে দেখে এসেছি উত্তর ইওরোপের দেশগুলি, ভাবিনি নিশীথ সূর্যের দেশের জলহাওয়া গায়ে মাখবো কোনওদিন।

এই মুহূর্তে হেলসিঙ্কি যাবার জাহাজ একটুর জন্য ফস্কে, বন্দরে মালপত্র নিয়ে ব’সে আছি পরের জাহাজের অপেক্ষায় ! সেই অবসরে লিখে নিলাম আজকের দিনলিপি।

সুইডিশদের আপাতদৃষ্টিতে খানিক উন্নাসিক মনে হলেও সহবত ও আদবকায়দায় এঁরা মন জয় ক’রে নিল অচিরেই।

হোটেলের প্রবেশপথে, লিফটের দরজা রোধ ক’রে কতো সময় ভ্যাবলামো করেছি!! পিছনে শান্ত, হাসিমুখে অপেক্ষা করেছেন যে কোনও বয়েসী নাগরিক। বিরক্ত হওয়া দূরস্থান, আমার অসুবিধার জন্য উল্টে দুঃখপ্রকাশ করেছেন, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন প্রতিবার।

আরও হাজার বছর পরেও এ হেন ধৈর্য, স্থৈর্য, সভ্যতা অর্জন করতে অপারগ র’য়ে যাব আমরা।

 

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com