বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:১৯ অপরাহ্ন

নিঃসন্তান মাসুদ এখন ১৩ সন্তানের বাবা

  • আপডেট সময় শুক্রবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০২৪

২০০২ সালে পারিবারিকভাবে বিয়ে করেন মাসুদুল ইসলাম মাসুদ ও তানজীর আলম নতুন। দাম্পত্য জীবনে সন্তান হচ্ছিল না এ দম্পতির।

সন্তানের আশায় ২০১৬ সালে চিকিৎসারত অবস্থায় একটি অস্ত্রোপচারের সময় মৃত্যু হয় নতুনের।

এর পরে স্ত্রীর স্মৃতি ধরে রাখতে মাসুদ গড়ে তোলেন ‘নতুনের শান্তি নিবাস’ নামে একটি শিশু ও বৃদ্ধাশ্রম। এ আশ্রমে বর্তমানে কোনো বয়স্ক মানুষ না থাকলেও রয়েছে সুবিধাবঞ্চিত পরিবারের ১৩ জন মেয়ে শিশু।

নিঃসন্তান মাসুদ এখন ১৩ সন্তানের বাবা। তাদের লেখাপড়া থেকে শুরু করে সব কিছুই দেখভাল করে ‘নতুনের শান্তি নিবাস’ নামে তার প্রতিষ্ঠানটি। এর সব খরচই বহন করেন মাসুদ এবং তার বন্ধু বান্ধব- শুভাকাঙ্ক্ষীরা।

পেশায় ব্যবসায়ী মাসুদুল ইসলাম মাসুদের বাড়ি রাজবাড়ী জেলা শহরের বেড়াডাঙ্গা এলাকায়। ২০১৭ সালে তিনি ফরিদপুর সদর উপজেলার শিবরামপুরে তিন একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠা করেন ‘নতুনের শান্তি নিবাস’।

মাসুদ জানান, বিয়ের ১৩ বছরেও কোনো সন্তান না হওয়ায় দেশে বিদেশে বিভিন্ন স্থানে চিকিৎসা নেন। সবশেষ ভারতের কলকাতায় ইনফারটিলিটি বিশেষজ্ঞ ডা. রাজিব আগরওয়ালের অধীনে চিকিৎসারত অবস্থায় ২০১৬ সালের ২৩ জুন কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে অস্ত্রোপচার (ল্যাপারোস্কপি) করার সময় মাত্র ৩৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন মাসুদের স্ত্রী নতুন।

এরপরই স্ত্রীর স্মৃতি ধরে রাখতে “নতুনের শান্তি নিবাস” নামে একটি চ্যারিটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন মাসুদ।

প্রতিষ্ঠানটিতে নির্মিত হয়েছে একটি নান্দনিক মসজিদ, মা ও শিশুদের জন্য আবাসস্থল, শিশুদের জন্য খেলার পার্ক, বাগান, পাঠাগার, অতিথিশালা ইত্যাদি। পুরো জায়গাটাই পরিকল্পনা মাফিক কাজে লাগানো। প্রতিষ্ঠানটি নির্মিত হয়েছে সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে।

প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনার জন্য নানান ধরনের কৃষিকাজ, মৎস্য চাষ, গরু-ছাগল-ভেড়া-কবুতর-মুরগি পালন ইত্যাদি কার্যক্রম রয়েছে।

মাসুদ বলেন, নতুনের স্মৃতি ধরে রাখতে তার নামে নিবাসটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি সম্পূর্ণ নারীদের জন্য। শান্তি নিবাসে বর্তমানে ১৩ জন মেয়ে শিশু রয়েছে। যারা সবাই ভাগ্য বা সুবিধাবঞ্চিত পরিবারের সন্তান। শান্তি নিবাসের পাশের দুটি স্কুলে ওরা লেখাপড়া করছে। পাশাপাশি নিজস্ব মক্তবে কোরআন পড়া শিখছে।

মেয়েদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ইনসানা আক্তার (১৬)। বাবা হারা ইনসানা সাত বছর আগে এই নিবাসে আসে। সে এবার এসএসসি পরীক্ষা দেবে। অন্য মেয়েদের মধ্যে দুজন প্রথম শ্রেণিতে, দুজন দ্বিতীয় শ্রেণিতে, একজন তৃতীয় শ্রেণিতে, চারজন ষষ্ঠ শ্রেণিতে, দুজন সপ্তম শ্রেণিতে এবং একজন অষ্টম শ্রেণিতে লেখাপড়া করছে।

মেয়েদের লেখাপড়া এবং অন্যান্য বিষয় দেখাশোনার জন্য ১০ জন কর্মচারী রয়েছে। তারাও সমাজের সুবিধাবঞ্চিত পরিবার থেকে আসা।

মাসুদ বলেন, ‘মেয়েরা সবাই আমাকে বাবা বলে ডাকে। ব্যবসার পাশাপাশি নতুনের শান্তি নিবাস ও মেয়েদের নিয়ে আমার সময় ভালোই কেটে যায়। আসলে এমন কাজের তৃপ্তি এবং প্রশান্তি বলে বোঝানো কঠিন। ’

মেয়েদের লেখাপড়ার পাশাপাশি ঘর গৃহস্থালির কাজও শেখানো হচ্ছে। ওদের মাছ, ছাগল, ভেড়া, মুরগি এবং কুকুরের লালন-পালনের দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া আছে। লেখাপড়ার পাশাপাশি নিয়মিত এসব দেখাশোনার কাজ করে ওরা। এ থেকে যে আয় আসে তা এই প্রতিষ্ঠানেই ব্যয় করা হয়।

মাসুদ জানান ‘ভবিষ্যতে শান্তি নিবাসে মেয়ের সংখ্যা আরও কিছু বাড়বে। ইচ্ছে আছে এখানে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করবো, মেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করবো। এখান থেকেই মেয়েদের বিয়ে দেওয়া হবে। বিয়ের পর এখানেই তারা বেড়াতে আসবে। কারণ এটাই তাদের পৈত্রিক বাড়ি। প্রতিটা মেয়ের জন্য ভবিষ্যতে স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট তৈরির পরিকল্পনা আছে প্রতিষ্ঠানটির। ’

নতুনের শান্তি নিবাস ঘুরে দেখা গেল মেয়েদের আবাস, ডাইনিং, পড়ালেখা, খেলাধুলার স্থান সব কিছু ভীষণ ছিমছাম, সুন্দর করে সাজানো। ভবনের বিভিন্ন কক্ষ মাসুদ এবং নতুনের বাবা মায়ের নামে নামকরণ করা। মেয়েগুলোও শহরের মধ্যবিত্ত পরিবারের সংস্কৃতিতে গড়ে ওঠা। নম্র-ভদ্র এবং বেশ উচ্ছ্বসিত। অনেকটা ক্যাডেট কলেজের মতো কড়া নিয়ম-কানুনে আবদ্ধ সবকিছু।

সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য এমন সুন্দর পরিবেশ দেশে সত্যিই বিরল। মাসুদের মতে বিত্তবানরা এলোমেলোভাবে জনসেবা না করে নতুনের শান্তি নিবাসের মতো সেবামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে কিছু মানুষের দায়িত্ব নিয়ে নিজেরাই দেখাশোনা করলে একদিকে যেমন মানসিক প্রশান্তি আসবে অন্যদিকে সমাজে এর অনেক বড় ধনাত্মক প্রভাব আসবে। প্রতিষ্ঠানটিকে মানব সেবার একটি পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে বর্ণনা করেছেন প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা মাসুদুল ইসলাম।

ফরিদপুরের শিবারামপুরের প্রধান সড়ক থেকে সামান্য ভেতরে গেলেই প্রতিষ্ঠানটি। এর পরিবেশ এতটাই মনোরম যে কারো ভালো লাগতে বাধ্য। প্রতিষ্ঠানটি ভ্রমণে সবার জন্য উন্মুক্ত। যে কেউ যেকোনো সময় দেখে আসতে পারেন, কাটিয়ে আসতে পারেন বেশ কিছু সুন্দর সময়।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com