পর্যটকদের পছন্দের শীর্ষে অবস্থানকারী জেলাগুলোর মধ্যে বান্দরবান অন্যতম। চট্টগ্রাম থেকে ৭৫ কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্বে পাহাড়ী শহর বান্দরবানের অবস্থান। এ জেলার আয়তন ৪৪৭৯ বর্গ কিলোমিটার। বান্দরবান জেলার উত্তরে রাঙ্গামাটি জেলা, দক্ষিণে আরাকান, মায়ানমার, পূর্বে, ভারতের মিজোরাম ও মায়ানমার, পশ্চিমে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলা।
বান্দরবন জেলার থানচি একটি উপজেলার নাম। এই উপজেলার একটি এলাকার নাম রেমাক্রি। এটি একটি মারমা অধ্যুষিত এলাকা। বান্দরবান জেলার যে স্থানগুলোর কারণে এই জেলাটি পর্যটকদের পছন্দের শীর্ষে থাকা জেলাগুলোর তালিকায় স্থান করে নিয়েছে তার একটি হচ্ছে ‘নাফাখুম ঝর্না’। আর এই রেমাক্রি গ্রামটিকে কেন্দ্র করেই এই নাফাখুম ঝর্নাটি অবস্থিত।
রেমাক্রি থেকে প্রায় ২:৪৫-৩ ঘন্টার হাটা দূরত্বে এই ঝর্নাটি অবস্থিত। রেমাক্রি খালের পানি প্রবাহ এই স্থানে এসে বাক খেয়ে প্রায় ৩০ ফুট নিচে পতিত হয়ে প্রকৃতির অপরূপ ছোয়ায় সৃষ্টি হয়ে অসাধারণ এই ঝর্নাটি।
ইতিহাস ও স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে জানা যায়, স্থানীয় মারমা ভাষায় ‘খুম; শব্দের অর্থ ঝর্না। এছাড়া রেমাক্রী নদীতে এক ধরনের মাছ পাওয়া যায়, যার নাম নাফা মাছ। এই মাছ সবসময় স্রোতের ঠিক বিপরীত দিকে চলে। বিপরীত দিকে চলতে চলতে মাছগুলো যখন লাফিয়ে ঝর্না পার হতে যায় ঠিক তখনই উপজাতীয়রা লাফিয়ে ওঠা মাছগুলোকে জাল বা কাপড় দিয়ে ধরে ফেলে। এ থেকে এই ঝর্নার নাম দেওয়া হয়েছে নাফাখুম ঝর্না।
নাফাখুম ঝর্নার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য
তিন্দু ও বড় পাথর
রেমাক্রী বাজার
রেমাক্রী বাজার আসলে খুব ছোট একটা বাজার। আমাদের গ্রামদেশের বাড়ির মতো মাঝখানে বড় উঠোন ও চারপাশে ঘর এমনভাবে এই বাজারের গঠন। উল্লেখ্য এই বাজারে যাদের দোকান রয়েছে তারা পরিবার-পরিজন নিয়ে দোকানের পেছনের অন্য আরেকটি ঘরেই বসবাস করেন। রেমাক্রী বাজারের পাশেই পর্যটকদের জন্য একটি রেষ্ট হাউজ রয়েছে। আর রেষ্ট হাউজের পাশেই রয়েছে বিজিবি-র একটি ক্যাম্প। রেমাক্রী বাজার হতে ২.৩০/৩ ঘন্টার মতো হাটা দুরত্বে নাফাখুম ঝর্না অবস্থিত। রেমাক্রী বাজারের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর কুল ধরে হেটে নাফাখুম ঝর্নায় যেতে হয়। এই পথের দু পাশের মনোরম দৃশ্যের কারণে পায়ের নিচের পাথুরে ও বালুকাময় পথটিও পর্যটকদের নিকট অনেক ভালো মনে হয়। এই পথ ধরে নাফাখুম ঝর্নার কাছে যেতে পর্যটকদের বার কয়েক কোমড় থেকে বুক সমান পানি পাড়ি দিতে হয়। পানিতে স্রোত থাকায় এই পথ পাড়ি দেওয়ার সময় পর্যটকদের অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। পথে যেতে যেতে পর্যটকদের টারজানের মতো গাছের লতা-পাতায় ঝুলেও পথ পাড়ি দিতে হয়। এভাবে যেতে যেতে পথে ছোট ছোট আরও ১০টির মতো ঝর্না চোখে পড়বে। শীতল ঝর্নার পানি গায়ে পড়তেই সমস্ত ক্লান্তি ঝর্নার পানির সাথে মিশে রেমাক্রী খালে গিয়ে পতিত হবে। আমাদের অনেকেরই আমাজান নদী দেখা বা পাড়ি দেওয়ার সৌভাগ্য হয় নি। তবে বলে রাখতে পারি এই পথ পাড়ি দেওয়ার সময় টিভিতে দেখা আমাজন নদীর দৃশ্যের সাথে অনেকটাই মিল পাবেন। যার ফলে ভ্রমণ আরও রোমাঞ্চকর হতে বাধ্য। এভাবে একের পর এক রোমাঞ্চকর বাধা পেরিয়ে অবশেষে দেখা মিলবে সেই পরম আকাঙ্ক্ষিত নাফাখুম ঝর্না।
যাতায়াত ব্যবস্থা
ঢাকা থেকে বান্দরবান যেতে আপনি ২/৩ টি রুট ব্যবহার করতে পারেন। ঢাকা থেকে ট্রেনে, বাসে বা প্লেনে প্রথমে চট্টগ্রাম তারপর চট্টগ্রাম থেকে সোজা বান্দরবান। বান্দরবন হতে ৭৯ কিমি. দুরে অবস্থিত থানচি। বান্দরবন হতে পাবলিক বাস অথবা জীপ অথবা চান্দের গাড়িতে করে থানচি যেতে হয়। তবে পাবলিক বাসের চাইতে জীপ অথবা চান্দের গাড়িতে করে গেলে পথের সুন্দর সুন্দর দৃশ্য উপভোগ করার সুযোগ রয়েছে। সাঙ্গু নদীর পাড়ে অবস্থিত থানচি বাজার। থানচি পৌছানোর পর সেখান থেকে যেতে হবে ক্রেমাক্রী বাজার। রেমাক্রী বাজার হতে নাফাখুম ঝর্নার কাছে যাওয়ার একমাত্র অবলম্বন সাঙ্গু নদীর নৌকা। এখানে আপ-ডাউন ইঞ্জিনচালিত নৌকা পাওয়া যায়। এই নৌকা ভাড়া করার জন্য পর্যটকদের থানচি ঘাটে অবস্থিত নৌকাচালক সমিতির সাথে কথা বলতে হয় এবং সেখান থেকে বিজিবি-র তালিকাভুক্ত একজন গাইড নিতে হয়। এই পথে ভ্রমণে গাইড নেওয়া বাধ্যতামূলক। শুধু তাই নয় নৌকাচালক সমিতির অফিসে পর্যটকদের নাম, ঠিকানা, পিতার নাম, মোবাইল নম্বর, নৌকার মাঝির নাম প্রভৃতি রেজিস্টার করে ভ্রমণের অনুমতি নিতে হয়। রেমাক্রী থেকে নাফাখুম ঝর্নায় যাওয়ার কোনো পরিবহন ব্যবস্থা নেই। অবশিষ্ট পথটুকু পর্যটকদের পায়ে হেটে পাড়ি দিতে হয়। রেমাক্রী পৌছার পর থানচি বাজার থেকে সাথে নেওয়া গাইডকে রেখে রেমাক্রী থেকে নতুন আরেকজন গাইড সাথে নিতে হয় এবং বিজিবি ক্যাম্পে পর্যটকদের নাম, ঠিকানা রেজিস্ট্রার করে ভ্রমণের অনুমতি নিতে হয়। উল্লেখ্য দিনে গিয়ে দিনেই নাফাখুম ঝর্না থেকে থানচি ফিরে আসাটা খুবই কষ্টকর। তাই আপনি চাইলে রেমাক্রীতে রাত্রি যাপন করে চারপাশটা ভালোভাবে ঘুরে ফিরে দেখে আসতে পারেন। আর যারা দিনে গিয়ে দিনেই ফিরে আসতে চান তাদেরকে ভোর ৬/৭ টার মধ্যে থানচি থেকে যাত্রা শুরু করতে হবে। রেমাক্রী বাজার হতে জোরে হাটলে ২ ঘন্টা এবং ধীর পায়ে হাটার ক্ষেত্রে নাফাখুম ঝর্নায় পৌছতে ৩ ঘন্টার মতো সময় লেগে যায়।
সাঙ্গু নদীর বর্ণনা
থানচি বাজারের পাশে সাঙ্গু নদী অবস্থিত। এই সাঙ্গু নদী ধরে রেমাক্রীর দিকে ধীরে ধীরে উপরে উঠতে হয় নৌকা বেঁয়ে। উপরে উঠতে হয় এই কারনে যে বস্তুত নদীটা রেমাক্রী হতে থানচির দিকে ধীরে ধীরে ঢালু হয়ে এসেছে আর এই কারনে এখানে সবসময় স্রোত থাকে। নদীর কিছুদূর পর পর ১-২ ফুট এমন কি কোথাও কোথাও ৪/৫ ফুট পর্যন্ত ঢালু হয়ে নিচে নেমেছে।
থাকার ব্যবস্থা
ভ্রমণে করণীয় ও পালনীয়