বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ০৮:৫৮ অপরাহ্ন
Uncategorized

নানান স্বাদে ভরপুর উপজাতিদের বাহারি খাবার

  • আপডেট সময় শুক্রবার, ৮ অক্টোবর, ২০২১

পাহাড় দেখতে কে না ভালোবাসে? তাই তো সময় পেলেই আমরা ছুটে চলি পাহাড়ে। উপভোগ করি মনোরম দৃশ্য। অবাক হয়ে দেখি পাহাড়ের সৌন্দর্য। পাহাড়ের বুক জুড়ে রয়েছে সবুজ গাছ-পালা। আর দেখা যায় পরিষ্কার আকাশ ও মেঘের খেলা। পাহাড়ের গায়ে বাস করে নানা উপজাতি। সেটি তাদের  আলাদাই একটি দেশ। তাদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা, পোশাক, খাদ্যাভ্যাস। রয়েছে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি। অবাক করে তাদের জীবনযাত্রা। কিভাবে এই উঁচু-নিচু, আঁকা–বাঁকা পাহাড়ি রাস্তাগুলো হেঁটে হেঁটে পাড়ি দেয় মাইলের পর মাইল। আর আমরা শহরের সোজা রাস্তায় একটু হাটলেই ক্লান্ত হয়ে যাই। তখন প্রশ্ন জাগে কি খায় তারা? এত শক্তি আসে কোথা থেকে? পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়ার আগে আসুন জেনে নেই ভিন্ন স্বাদের খাবার উপজাতিদের ঐতিহ্যবাহী খাবার সম্পর্কে।

বাঁশ মুরগি (ব্যাম্বু চিকেন)

বাঁশ মুরগী
ছবি : সংগৃহীত

পাহাড়ি উপজাতিদের আরেকটি ঐতিহ্যবাহী খাবার হচ্ছে ব্যাম্বু চিকেন। এর রন্ধন প্রণালী হচ্ছে- মুরগির মাংস কেটে ভাল করে ধুয়ে, এরপর সাবারাং পাতা, পাহাড়ি আদা, রসুন ও মরিচ কাঁটা দিয়ে মেখে কাঁচা বাঁশের ভেতর ঢুকিয়ে দেয়া হয়। এরপর বাঁশের মুখ বন্ধ করার জন্য কলাপাতা ব্যবহার করে। এরপর বাঁশটি আগুনে দেয়া হয়। মাঝে মধ্যে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দিতে হয় বাঁশটি যেন সব দিকে ভাল মত রান্না হয়। এই ব্যাম্বু চিকেনের স্বাদ অসাধারণ। একবার খেলে স্বাদ মুখে লেগে থাকে

মুন্ডি

মুন্ডি
সংগৃহীত
পাহাড়ি স্থানীয়রা চাল দিয়ে এক ধরণের নুডুলস বানায়। সেটি দিয়ে তৈরি করা হয় মুন্ডি। মুন্ডি অনেকটা স্যুপি নুডুলসের মত। স্যুপের মত যে জিনিসটি তারা ব্যবহার করে সেটি হচ্ছে মাছ বা মুরগির স্টক। এর সাথে চালের তৈরি নুডুলস দিয়ে খান তারা। মারমাদের এটি খুব পছন্দের খাবার।

লাক্সু  বা ব্রেংআ  পার্বত্য অঞ্চলের অন্যতম মজাদার খাবার হচ্ছে লাক্সু। এটিকে আবার মুরগির চাটনিও বলা হয়। এটি অনেকটা ভর্তার মত তৈরি করা হয়। এর রন্ধন প্রণালী হচ্ছে- পাহাড়ি মুরগি ছোট ছোট করে কেটে, লবণ, আদা বাটা এবং অল্প পরিমাণের হলুদ দিয়ে পানিতে দিয়ে সিদ্ধ করে। মুরগি সিদ্ধ হয়ে গেলে চুলা থেকে নামিয়ে হাড্ডি থেকে মুরগির মাংস আলাদা করে। এরপর ঝুড়া মাংসের সাথে মরিচ, পেঁয়াজ এবং আদা কুঁচি দিয়ে ভাল করে মাখে।এভাবেই তৈরি করা হয় মজাদার লাক্সু। শেরপুরের পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাসরত গারো, কোচ এবং  হাজং উপজাতিদের মধ্যে মুরগির চাটনি ব্রেংআ নামে পরিচিত। এর রন্ধন প্রণালী একই।

পাজন পাজন হচ্ছে একধরণের সবজি। বিভিন্ন পদের সবজি দিয়ে এটি রান্না করা হয়। পাজন তৈরি করায় একটা মজার ব্যাপার আছে। নববর্ষের দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ মূল বিজুর দিন বৈসাবির আয়োজনে রান্না করা হয় মজার মজার খাবার। সেদিন তৈরি হয় পাজন। ২০ ধরণের সবজি দিয়ে পাজন তৈরি হয়। পাল্লা দিয়ে সবজির পদ বাড়ানো হয় পাজনে। যার পাজনে সবজির পরিমাণ যত বেশি, তার গুরুত্ব তত বেশি।  এভাবে তৈরি হয় পাজন।

তোজাহ পাহাড়িদের সুন্দর ত্বক এবং সুঠাম দেহের পেছনে কারণ হচ্ছে তাদের খ্যাদ্যাভাস এবং তাদের পরিশ্রম। শাক সবজি খেতে তারা খুব ভালবাসে। হরেক পদের পাহাড়ি সবজি দিয়ে তৈরি করা হয় এ তোজাহ। স্বাদে এবং পুষ্টিগুণে ভরপুর এ সবজি।

হাংরো শুঁটকির সাথে বিভিন্ন সবজি মিলিয়ে সাংগ্রাই উৎসবে মারমারা হাংরো রান্না করে।  এটি তাদের একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার।

বাঁশ কোড়লের সবজি

bambooshoots
সংগৃহীত ছবি 

পাহাড়ি খাবারের সাথে বাঁশের সম্পর্ক নিবিড়। বাঁশকে কখনো তারা হাঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করে। আবার কখনো বা সবজি হিসেবে খেয়ে থাকে। এত শক্ত বাঁশ কিভাবে খায় ভেবে অবাক হচ্ছেন? বাঁশে একটি কচি অংশ থাকে। যাকে বলা হয় বাঁশ কোড়ল। সেই বাঁশ কোড়ল দিয়ে নানা পদের ভাজি, সবজি বা তরকারি করা হয়। শুঁটকির সাথেও এর স্বাদ অতুলনীয়।

কাঁকড়া ভুনা

 

kakra vuna
সংগৃহীত ছবি 
বিভিন্ন পাহাড়ি মসলা ব্যবহার করে রান্না করা হয় কাঁকড়া ভুনা। স্বাদে ভরপুর এ খাবারটি সাঙ্গুর পর্যটকদের খুব পছন্দের।

বান্দরগুলা দিয়ে চিংড়ি কি অদ্ভুত নাম,তাই না? বান্দরগুলা হচ্ছে এক ধরণের পাহাড়ি সবজি। চিংড়ি মাছ দিয়ে এ সবজি রান্না করা হয়। পাহাড়ি রেস্তোরাগুলোতে এর বেশ চাহিদা রয়েছে।  খেতেও মজা এই খাবারটি।

আদাফুল দিয়ে ছোট মাছ পাহাড়ি অধিবাসীদের ছোট মাছ খুব পছন্দের। ছোট মাছ আর আদা ফুল দিয়ে এক ধরনের মজার খাবার রান্না করে তারা। যা খুবই সুস্বাদু।

শামুক  ঝিনুক পাহাড়ি আদিবাসীরা শামুক এবং ঝিনুক থেকে দেহের প্রোটিন বা আমিষের চাহিদা মেটায়। তারা প্রচুর পরিমানের শামুক ও ঝিনুক খায়। শামুক ও ঝিনুকের উপরের শক্ত অংশটুকু ফেলে ভিতরে থাকা নরম অংশটুকু রান্না করে খেয়ে থাকে তারা।

মিয়া হাজং, কোচ এবং গারো উপজাতিরা বাঁশের কোড়ল এবং চালের গুঁড়া দিয়ে এক ধরণের খাবার তৈরি করে। যার নাম মিয়া।

ইথিবা ইথিবা রান্না করা হয় ছোট মাছ কলাপাতায় ভরে পোড়া দিয়ে। এটি খুব মজাদার গারো খাবার।

খার মণিপুরীরা ডাল দিয়ে তৈরি একটি খাবার খেয়ে থাকে। খাবারটির নাম খার। বিভিন্ন রকমের ডালের সাথে লেবু পাতা, আদা পাতা, হলুদ পাতা, বিশেষ পদ্ধতিতে পোড়া কলাগাছের ছাই দিয়ে রান্না করা হয়। প্রাত্যাহিক জীবনে মণিপুরীরা আঠালো ভাতের সাথে সিদ্ধ সবজির সাথে খার খেয়ে থাকে। রান্নায় তারা তেল ও মসলা কম পরিমাণে ব্যবহার করে।

পালটৈ মণিপুরীরা আঠালো এক ধরনের ভাতের সাথে পালটৈ নামক সবজি তরকারি খান। মণিপুরীদের খাদ্য তালিকায় সবজি, নিরামিষ তরকারি বেশি থাকে। কারণ তারা একদম মাংস খায় না। উটি, চাগেম পমবা, চামখোঙ নামক প্রবৃত্তি নিরামিষ তরকারিও তারা খায়। চিনচু মণিপুরীদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে খাবারের পর্বকে বলা হয় বান্দারা। এটি একটি নিরামিষ ধরনের খাবার যা কলা পাতায় পরিবেশন করা হয়। এ আহার পর্বে তারা চিনচু নামক একটি সালাদ তৈরি করে।

নাগা মণিপুরী উৎসবে একটি বিশেষ ধরনের মাছের তরকারির প্রচলন রয়েছে, যা নাগা নামে পরিচিত।

উছেইর ইরলপা মনিপুরীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ খাবার ছিল উছেইর ইরলপা। এটি তৈরি করার জন্য মণিপুরীরা বাগানে তারা নিজস্ব সবজি চাষাবাদ করতেন। যেমন- ইকাইতাপি, ফাকপই, ফাতিকম, লংচাক, তকপানিকম ইত্যাদি। এগুলোকে একত্রে মারৈ বলা হয়। সিদ্ধ মারৈর সাথে কচি বাঁশ,  স্মোকড ফিশ এবং ডাল দিয়ে রান্না করা হয়।

করেইর চিনচু চাল ভাজা, মারৈ এবং শুকনো মাছ দিয়ে এক ধরনের ঝাল ছাতু তৈরি করে খায়। তারা বিকেলের নাশতায় এ খাবারটি খেয়ে থাকে। জনসংখ্যায় এদেশের সর্ববৃহত্ আদিবাসী গোষ্ঠী চাকমা। তেল ও মশলার একেবারে অল্প পরিমাণে ব্যবহার তাদের রান্নার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। তবে চাকমারা সিদ্ধ ঝাল তরকারি বেশি পছন্দ করে। এ গোষ্ঠীর প্রধান খাদ্য ভাত। শাক বা সবজি সিদ্ধ মরিচ ভর্তা দিয়ে মিশিয়ে খাওয়া হয়।

সিদল চাকমা জনগোষ্ঠীর প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় ভাত এবং সিদ্ধ ঝাল তরকারির পাশাপাশি থাকে শুঁটকি জাতীয় একটি খাবার। সেটি হচ্ছে সিদল। সিদল রান্নায় কয়েক পদের মাছের শুঁটকি একসাথে মিলিয়ে তরকারি রান্না করা হয়।

হোরবো  চাকমারা খাবারে একটু ঝাল বেশিই খেয়ে থাকে। আম, চালতা, আমড়া ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের টক জাতীয় ফলের সাথে মরিচ ভর্তা আরর সিদল মিশিয়ে বানানো হয় হোরবো।

হেবাং বা সুগুনি হেবাং শুঁটকি মাছ চাকমাদের বেশ পছন্দের খাবার। তাই বিভিন্ন শুঁটকি মাছ দিয়ে তারা হেবাং নামক তরকারি রান্না করে খায়। মারমা সম্প্রদায়েও শুঁটকির প্রচলন বেশ। যদিও তারা শুঁটকিকে নাপ্পি বলে।

বিনি চালের পিঠা বিভিন্ন উৎসবে মিষ্টান্ন হিসেবে চাকমারা বিনি চালের পিঠা তৈরি করে। চালের গুড়ার সাথে নারিকেল মিশিয়ে কলাপাতায় মুড়ে এ পিঠা বানানো হয়। এছাড়াও চাকমারা বিনি চালের গুড়া দিয়ে বড়া পিঠা ও শান্নে পিঠা নামক দুই ধরনের পিঠা তৈরি করে  থাকে।

সাং পিঠা  বান্দরবনের বমরা আমাদের বাঙ্গালীদের ভাপা পিঠার মত একটি পিঠা খেয়ে থাকে। চালের গুড়ার সাথে নারিকেল কুচি মাখিয়ে খেজুরের রস দিয়ে মাখায়। এরপর গোল গোল করে এর ভেতরে গুড় দিয়ে কলাপাতা দিয়ে মুড়ে দেয়। এরপর সেটিকে ভাপে সেদ্ধ হতে দেয়া হয় পাতিলে। কলাপাতার রঙে পরিবর্তন আসলে সিদ্ধ হয়ে যায় পিঠাটি। জুমের প্রথম চাল দিয়ে পিঠা বানানো হয় ঘরে ঘরে।  বড়দিনের উৎযাপনে এবং অতিথি আপ্যায়নেও তৈরি হয় এই পিঠা।

থাবচু ইয়াম্মা বান্দরবনের আদিবাসীরা শিমুল আলু সিদ্ধ করে লবণ দিয়ে খায়। যার নাম থা-বচু ইয়াম্মা। থাপা নামক চুলায় রান্না করে এরা। রান্নাঘর কে বলে মাই শোনো। গরম পানির ভাবে সিদ্ধ করা হয় আলু। অনেকটা ভাপা পিঠার মত করে।

সফান শ্রীমঙ্গলের খাসিয়ারা কাঁচা কাঁঠাল, ভাজা মাছ এবং মসলা দিয়ে এক ধরনের তরকারি খায়। যার নাম সফান। কাঁচা কাঁঠাল কে ছুড়ি দিয়ে কুচি কুচি করে কাটে। এরপর ভাজা মাছের সাথে রান্না করা হয়। সফান খুব সুস্বাদু।

জাগে  খাসিয়ারা জাগে নামক মোরগ পোলাও খেয়ে থাকে। আতপ চালের সাথে মুরগির মাংস, মসলা আর লেবু দিয়ে রান্না করা হয় এ জাগে। তবে এর স্বাদ মোরগ পোলাওয়ের চেয়ে ভিন্ন। এই খাবারগুলোর কথা শুনে নিশ্চিয় পেটে খিদে পেয়েছে আপনার? খেতে ইচ্ছা করছে খাবারগুলো। তাহলে ঘুরে আসতে পারেন দেশের কোন পাহাড়ি অঞ্চলে। আর খেয়ে আসুন পাহাড়িদের মজাদার এই খাবারগুলো।

লামিয়া আলম 

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com