শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ০৫:৪১ অপরাহ্ন
Uncategorized

নবরূপ পাবে কক্সবাজার

  • আপডেট সময় বুধবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১
  • চার লক্ষাধিক কোটি টাকার মেগা প্রকল্পের মহাযজ্ঞ
  • হবে পর্যটনের বৃহত্তম হাব
  • দীর্ঘ রানওয়ে সংবলিত বিমানবন্দর ও রিফুয়েলিং পয়েন্ট
  • আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট চলাচল করবে
  • রেললাইনে যুক্ত হবে মিয়ানমার

মোয়াজ্জেমুল হক/হাসান নাসির/এইচএম এরশাদ॥ বহু মেগা প্রকল্প নিয়ে সরকারের দৃষ্টি এখন সৈকতনগরী কক্সবাজারের প্রতি। নতুন রূপ পাচ্ছে বিশ্বের দীর্ঘতম সী বিচসমৃদ্ধ এই পর্যটন শহর। কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়িতে বাস্তবায়িত হচ্ছে একগুচ্ছ মেগা প্রকল্প। এর সঙ্গে কক্সবাজার শহরে বিদ্যমান বিমানবন্দরটিকে আধুনিকায়ন করে দেশের বৃহত্তম রানওয়ে সংবলিত করা হচ্ছে। ফলে এ বিমানবন্দর যুক্ত হবে আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট চলাচলে। দেশের একমাত্র গভীর সমুদ্র বন্দরটিও নির্মিত হচ্ছে মাতারবাড়িতে। এ ছাড়া দোহাজারী থেকে কক্সবাজার হয়ে নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম পর্যন্ত ট্রান্স এশিয়ান রেললাইন নির্মিত হয়ে যুক্ত হবে মিয়ানমারের সঙ্গে। মহা আনন্দে কক্সবাজারবাসী।

সরকারী সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, সরকারের কক্সবাজারভিত্তিক মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার-ঘুমধুম রেললাইন। মাতারবাড়িতে এলএনজি প্রকল্প তাপবিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্র। এ ছাড়া কক্সবাজারকে করা হবে বিশ্বের অন্যতম প্রধান ও বৃহত্তম পর্যটন হাব। মাতারবাড়ি তাপবিদ্যুত প্রকল্পটি সরকারের অগ্রাধিকার ভিত্তিক প্রকল্পের একটি। এতে ব্যয় হচ্ছে ৩৬ হাজার কোটি টাকা। যার মধ্যে জাপানী সাহায্য সংস্থা জাইকা দেবে ২৯ হাজার কোটি টাকা, ১২শ’ মেগাওয়াটের ২টি বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্র নির্মিত হচ্ছে জাপান কনসোর্টিয়ামের অন্তর্ভুক্ত তোশিবা কর্পোরেশনের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী এ কাজের শেষ হবে ২০২৩ সালে। মাতারবাড়ি ও ধলঘাটার ১৪১৪ একর জমি নিয়ে ৭ কিলোমিটার চ্যানেল খনন হচ্ছে কয়লা পরিবহনের জন্য। এলএনজি প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হচ্ছে বিওটি (বিল্ট অপারেট এ্যান্ড ট্রান্সফার) ভিত্তিতে। এই চুক্তির মেয়াদ ২০১৯ থেকে ২০৩৩ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরের জন্য। এই প্রকল্পে টার্মিনালের ধারণক্ষমতা থাকবে ১ লাখ ৩৮ হাজার ঘনমিটার তরল গ্যাস। দৈনিক ৫০ কোটি ঘনমিটার গ্যাস চট্টগ্রাম পর্যন্ত গ্যাসলাইনের মাধ্যমে মাতারবাড়ি থেকে সরবরাহের পরিকল্পনা রয়েছে। ইতোমধ্যে মহেশখালী থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত ৯০ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মিত হয়েছে।

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার ঘুমঘুম- রেললাইন প্রকল্পটি ২০০৯ সালে অনুমোদিত হয়ে ২০১১ সালে প্রকল্প কাজের ভিত্তিপ্রস্তর হয়, ২০১৮ সালে নির্মাণ কাজ শুরু হয়। এই প্রকল্পের ব্যয় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। প্রকল্পে এডিবির ঋণ হচ্ছে ১৩ হাজার ১১৫ কোটি টাকা। বাকি অর্থ সরকারী কোষাগার থেকে জোগান হবে। রেললাইনটি দোহাজারী থেকে চকরিয়া এবং চকরিয়া থেকে কক্সবাজারের রামু হয়ে ঘুমধুম পর্যন্ত যুক্ত হবে। দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত এ লাইনের দূরত্ব ১০০ কিলোমিটার। আর রামু-ঘুমধুম পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটারের রেল লাইনটি যুক্ত হবে এই প্রকল্পে যা এখনও প্রক্রিয়াধীন। তবে দোহাজারী থেকে রামু পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণের কাজ দ্রুত এগোচ্ছে। এই প্রকল্পটির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ (সিআরইসি), চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কর্পোরেশন (সিসিইসিসি)। এ ছাড়া দেশীয় তমা কনস্ট্রাকশন কোম্পানি ও ম্যাক্স ইন্সফ্রাস্ট্রাকচার।

অন্যতম বৃহত আরেকটি প্রকল্প হচ্ছে গভীর সমুদ্রবন্দর (ডিপ সী পোর্ট)। এই ডিপ সী পোর্ট বাস্তবায়ন প্রকল্প নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে সমীক্ষা চালানো হয়েছে। শেষ পর্যন্ত গভীরতার দিক দিয়ে মাতারবাড়ির পয়েন্টটি সর্বাধিক এবং উপযুক্ত হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় সরকার সেটিকে অনুমোদন প্রদান করে। এরপরই চট্টগ্রাম বন্দরের অর্থায়নে শুরু হয়েছে এ গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণযজ্ঞ। ২০২৫ সালের মধ্যে ন্যূনতমপক্ষে দুটি জেটির নির্মাণ কাজ শেষ করে জাহাজ ভেড়ানোর টার্গেট নিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।

এদিকে গত রবিবার উদ্বোধন হয়েছে কক্সবাজার বিমানবন্দর সম্প্রসারণ কাজের। এ কাজের ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে উদ্বোধন পর্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই ঘোষণা করলেন কক্সবাজারে হবে দেশের পর্যটনের বৃহত্তম হাব। এ লক্ষ্য নিয়ে কক্সবাজারের বিদ্যমান বিমানবন্দরটিকে দেশের দীর্ঘ রানওয়েতে পরিণত করা হচ্ছে। তিনি ঘোষণা দিয়েছেন প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যে যত ফ্লাইট চলাচল করে এদের রিফুয়েলিংয়ের জন্য এ বিমানবন্দর হবে সবচেয়ে সুবিধাজনক। কেননা, অতি দ্রুততম সময়ে এ বিমানবন্দরে আন্তর্জাতিক এ রুটের ফ্লাইট নেমে রিফুয়েলিং করে পুনঃ উড়ে যেতে পারবে।

সমুদ্র তীরবর্তী ভূমি পুনরুদ্ধার করে সম্প্রসারণের মাধ্যমে এ রানওয়ের দূরত্ব হবে ১০ হাজার ৭০০ ফুট। যা দেশের বৃহত্তম। নিজস্ব অর্থায়নে এ প্রকল্পটি নির্ধারিত ২০২৪ সালের মে মাসের আগেই সম্পন্ন হয়ে যাবে। অপরদিকে কক্সবাজার হবে বিশ্বের অত্যাধুনিক এবং সর্বশ্রেষ্ঠ সী-বিচসংবলিত পর্যটন কেন্দ্র। ফলে কক্সবাজার একটি আধুনিক শহরে রূপান্তর হয়ে যাবে। তিনি আরও জানান দিলেন, কক্সবাজার নিয়ে সরকারের রয়েছে আরও চিন্তা ও পরিকল্পনা। ভবিষ্যতে কক্সবাজারই হবে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান। সরকারী সূত্রে জানানো হয়েছে, সরকার এই কক্সবাজারকে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পরিণত করার লক্ষ্যে এক গুচ্ছ মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এসব প্রকল্পে ব্যয় ৪ লাখ কোটি টাকারও বেশি। হংকং, সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, দুবাইয়ের মতো কক্সবাজার হবে যোগাযোগ এবং পর্যটনের অন্যতম বৃহত্তম হাব।

সূত্র আরও জানায়, কয়লা বিদ্যুত নির্মাণের উদ্যোগে কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বিডি লিমিটেড প্রকল্প বাস্তবায়নে নিয়োজিত হয়েছে। মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মিত হলে দেশে কার্গো হ্যান্ডলিং ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। প্রতিবেশী দেশসমূহের সঙ্গে সামুদ্রিক বাণিজ্য সহজ করার লক্ষ্যে ৮ হাজার টিইইউএস (টুয়েন্টি ইকুইভ্যালেন্ট ইউনিটস) ধারণ ক্ষমতা মাদার ভ্যাসেল ভেড়ানোই এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য। কেননা চট্টগ্রাম বন্দরে বর্তমানে সর্বোচ্চ ৯ মিটার ড্রাফটের বেশি জাহাজ প্রবেশ করানো যায় না। এতে করে বহির্নোঙ্গরে মাদার ভেসেল থেকে পণ্য লাইটারিং করতে হয়। লক্ষ্য রয়েছে ২০৪১ সালের মধ্যে দেশে কন্টেনার হ্যান্ডলিংয়ের পরিমাণ দাঁড়াবে ৫ দশমিক ৭ মিলিয়ন থেকে ৬ দশমিক ৫ মিলিয়ন টিইইউএস।

অপরদিকে কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত ৮০ কিলোমিটার মেরিন ড্রাইভ সড়কে আরও অধিকতর উন্নয়নের প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। ৩২ কিলোমিটারব্যাপী সড়কের মান উন্নয়নের ১০২১ কোটি টাকারও বেশি ব্যয়ের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।

দেশের সর্বদক্ষিণ সীমানায় অবস্থিত টেকনাফকে নিয়ে কক্সবাজার শহর জেলা সদর থেকে দূরত্ব ৮৬ কিলোমিটার। তবে মেরিন ড্রাইভ সড়কের দৈর্ঘ্য ৮০ কিলোমিটার।

এসব মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের পর বদলে যাবে কক্সবাজারের চেহারা। নবরূপে সাজবে কক্সবাজার। আমূল পরিবর্তন ঘটবে বাণিজ্যিক, পর্যটনসহ সামগ্রিক কর্মকান্ডে।

এ শহরের একদিকে পাহাড় অপরদিকে সাগর। এই সৈকত নগরীর পাশ দিয়ে মেরিন ড্রাইভ সড়কটি বিশ্বের দীর্ঘতম। সঙ্গে যুক্ত হবে টেকনাফ সমুদ্রসৈকত যা নতুন মাত্রা যোগ করবে। সাগর ও পাহাড়ের বুক চিড়ে মেরিন ড্রাইভ সড়কটি বাস্তবায়ন হবে। এ ছাড়া শহরের সারি সারি ঝাউবন আর সমুদ্রের উত্তাল গর্জন যে কোন মানুষকে আকর্ষণে নিয়ে যায়। সম্পূর্ণ বালির সৈকত নিয়ে কক্সবাজার। সাগরের ঢেউয়ের সঙ্গে ঢেউ খেলে দুধের ফেনার মতো। দূর থেকে দেখলে মনে হয় সাগরতো নয়, দুধের সাগর। এ সৈকতের রূপ বদলায় দিনজুড়ে কয়েকবার। জাগতিক নিস্তব্ধতা নিত্যনৈমিত্তিক। সাগরের গর্জন যেন স্বর্গীয় সুধা। অপরদিকে শামুকের জন্য টেকনাফ বিচটি অনন্য সুন্দর। সেখানে পর্যটকদের সমাগম শহরসংলগ্ন সী বিচের তুলনায় কম।

সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী উন্নয়নের মহাসড়কে কক্সবাজার। মাতারবাড়িতে বড় বড় অতিপ্রয়োজনীয় প্রকল্প, দোহাজারী থেকে কক্সবাজারের রামু হয়ে বান্দরবানের ঘুমঘুম পর্যন্ত ট্রান্স এশিয়ান রেললাইন নির্মিত হচ্ছে। সবশেষে কক্সবাজার বিমানবন্দরটি অত্যাধুনিকে রূপান্তর হচ্ছে। মোদ্দা কথা মেগা প্রকল্পসমূহ ও পর্যটনের পরিকল্পনায় কক্সবাজার হবে দেশের বৃহত্তম হাব। যা দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক খাতেও ব্যাপক উন্নয়নে অবদান রাখবে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। সে ধারণা নিয়ে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এগিয়ে যাচ্ছে বর্তমান সরকার।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com