স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক কখনও ভালো, কখনও টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে গেছে। গত এক দশকে বিভিন্ন ইস্যুতে সেই সম্পর্ক একেবারে তলানীতে গিয়ে ঠেকেছে। মূলত আওয়ামী লীগ সরকারের দুঃশাসন, গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় চরম ব্যর্থতা দেশটিকে বাংলাদেশ থেকে একটু একটু করে দূরে নিয়ে গেছে।
সেই দূরত্ব ঘোচাতে এবং সম্পর্কে পুনরায় গতি ফেরাতে কাজ করে যাচ্ছে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। বিশেষ করে এ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় দেশ দুটির মধ্যে সম্পর্কের নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। যার বাস্তব রূপ দেখা মিলেছে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনে, দেশ দুটির সরকারপ্রধানের মধ্যে অনুষ্ঠিত দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের মধ্য দিয়ে। বিষয়টি অত্যন্ত ‘বিরল’ বলে মন্তব্য করেছেন কেউ কেউ।
কেন বিরল— জানতে চাইলে কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কোনো দেশের শীর্ষনেতার দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের তেমন নজির নেই। যেটি হয়েছে বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এদিন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে কাছে পেয়ে বুকে টেনে নেন। হাতে হাত রেখে বলেন, ‘বাংলাদেশের সংস্কারের যে লক্ষ্য নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ঠিক করেছেন, তাকে বাস্তবে রূপ দিতে সবধরনের সহযোগিতা করবে হোয়াইট হাউস।’
প্রধান উপদেষ্টার ফেসবুক পেজে এদিন রাতেই দুই শীর্ষনেতার বিরল বৈঠকের ছবি ও সংবাদ প্রচার করা হয়েছে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনের ফাঁকে রাতে (নিউইয়র্কের স্থানীয় সময় অনুযায়ী মঙ্গলবার সকালে) বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়।
৩০ বছর পর হওয়া এমন বৈঠকে দুই দেশের (বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র) সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌঁছাবে বলে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের পেশাদার কূটনীতিকরা।
অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধানের প্রেস উইংয়ের বরাতে জানানো হয়েছে, বৈঠকে ড. ইউনূস বিগত সরকারের আমলে সবধরনের নিপীড়নের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের সাহসী ভূমিকা এবং বাংলাদেশ পুনর্গঠনে তাদের গুরুত্বপূর্ণ অবদানের কথা জো বাইডেনকে জানান। ড. ইউনূস জোর দিয়ে বলেন, ‘দেশ পুনর্গঠনে তার সরকারকে অবশ্যই সফল হতে হবে।’ এ সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন যেকোনো সাহায্যে বাংলাদেশ সরকারের পাশে থাকার আশ্বাস দেন। বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা জুলাই বিপ্লব চলাকালীন এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের আঁকা দেয়ালচিত্রের ছবি-সংবলিত ‘দ্য আর্ট অব ট্রায়াম্ফ’ শীর্ষক আর্টবুক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের হাতে তুলে দেন।
বৈঠকের পর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সেক্রেটারি শফিকুল আলম বলেন, আজকের বৈঠকটি ছিল ঐতিহাসিক। কারণ, জাতিসংঘের অধিবেশনের ফাঁকে বাংলাদেশের কোনো শীর্ষনেতার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কোনো বৈঠক হয়নি। বৈঠকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিজ থেকে বাংলাদেশে কী কী সমর্থন ও সহযোগিতা দেওয়া প্রয়োজন, সে সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি তার সরকারের পূর্ণ সমর্থন বাংলাদেশ পাবে বলে জানান।
তিনি আরও বলেন, দুই দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের বিরল ওই বৈঠকের পর বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে।
জাস্টিন ট্রুডোকে ‘আর্ট অব ট্রায়াম্ফ’ উপহার দিলেন ড. ইউনূস
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস কানাডিয়ান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোকে ‘দ্য আর্ট অব ট্রায়াম্ফ’ উপহার দিয়েছেন। তার প্রেস উইং থেকে জানানো হয়, ড. ইউনূস নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদরদপ্তরে কানাডার প্রধানমন্ত্রীর কাছে আর্ট বইটি হস্তান্তর করেন।
বইটিতে জুলাই-অগাস্ট মাসে ছাত্রদের নেতৃত্বে পরিচালিত বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য শহর ও নগরের দেয়ালে তরুণ শিক্ষার্থীদের আঁকা সেরা কিছু শিল্পকর্মের ছবি স্থান পেয়েছে। ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেওয়ার পরপরই তিনি সংশ্লিষ্টদের এ আর্টবুক প্রকাশের নির্দেশ দেন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। বিজয় উদ্যাপনে দেশজুড়ে নানা গ্রাফিতি ও দেয়ালচিত্র আঁকেন শিক্ষার্থীরা। রং-তুলির আঁচড়ে ফুটে ওঠে বিপ্লব, বিদ্রোহ ও বিজয়ের চিত্র। সৃজনশীল ও হৃদয়গ্রাহী স্লোগান ও কবিতার মাধ্যমে সরকারকে দেওয়া হয় শক্তিশালী নানা বার্তা।
মনের মাধুরী মিশিয়ে দেয়ালে-দেয়ালে ফুটিয়ে তোলা শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন-বাসনার এসব নান্দনিক ও নজরকাড়া চারুকলা গোটা ঢাকা শহরের চেহারা পাল্টে দেয়। এর মধ্যে অনেক গ্রাফিতি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। প্রশংসা কুড়ায় সর্বস্তরের মানুষের।
জাতিসংঘ মহাসচিবের সংবর্ধনায় ড. ইউনূস
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস আয়োজিত সংবর্ধনায় যোগ দেন। নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদরদপ্তরে স্থানীয় সময় মঙ্গলবার সকাল ৮টায় অনুষ্ঠানটি শুরু হয়। সেখানে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনে যোগদানকারী বিশ্বনেতাদের স্বাগত জানান সংস্থাটির মহাসচিব।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে অধ্যাপক ইউনূস ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা, মরিশাসের প্রেসিডেন্ট পৃথ্বিরাজ সিং রূপন এবং জাতিসংঘ মানবাধিকার সম্পর্কিত হাইকমিশনার ভলকার টুর্কসহ অন্যান্যদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন।
এদিন জাতিসংঘের সদরদপ্তরে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা ও ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনির সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন ড. ইউনূস। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের ফাঁকে এ কুশল বিনিময় হয়।
জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে বৈঠক বৃহস্পতিবার
ড. মুহাম্মদ ইউনূস আগামী ২৬ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের সঙ্গে বৈঠক করবেন। প্রধান উপদেষ্টার নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে স্থানীয় সময় দুপুর ২টা ১৫ মিনিটে জাতিসংঘের সচিবালয়ে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হবে।এ ছাড়া প্রধান উপদেষ্টা ২৫ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মুহাম্মদ শেহবাজ শরিফ ও নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা এবং ২৬ সেপ্টেম্বর নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী ডিক স্কুফের সঙ্গে বৈঠক করবেন।
চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই, ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডার লেইয়েন, জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন, জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল এবং এলডিসি, এলএলডিসি ও সিআইডিএসর উচ্চ প্রতিনিধি রাবাব ফাতিমা, জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার মহাপরিচালক গিলবার্ট এফ হাউংবো, বিশ্বব্যাংক গ্রুপের প্রেসিডেন্ট অজয় বাঙ্গা, ইউএনডিপি প্রশাসক আখিম স্টেইনার এবং ইউএসএআইডি প্রশাসক সামান্থা পাওয়ার নিউইয়র্কে অবস্থানকালে ড. ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন।
ইউএনজিএ’র ৭৯তম অধিবেশনে যোগদানের জন্য প্রধান উপদেষ্টা এবং তার সফরসঙ্গীদের নিয়ে কাতার এয়ারওয়েজের একটি বাণিজ্যিক ফ্লাইট সোমবার স্থানীয় সময় রাত ১০টা ১০ মিনিটে নিউইয়র্কের জেএফকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। এর আগে ফ্লাইটটি বাংলাদেশ সময় ভোর ৫টা ৫ মিনিটে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ছেড়ে যায়।
প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্ক সময় সকাল ১০ টায় জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ভাষণ দেবেন। এদিনই তিনি ঢাকার উদ্দেশ্যে নিউইয়র্ক ছেড়ে যাবেন বলে জানা গেছে।