শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:৩০ অপরাহ্ন

নতুন অভিবাসন বিল: ফ্রান্সে অনথিভুক্ত অভিবাসী কর্মীদের যত ভাবনা

  • আপডেট সময় শনিবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

ফরাসি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জেরাল্ড দারমানা প্রস্তাবিত নতুন ফরাসি অভিবাসন বিলের খসড়ায় শ্রমিক ঘাটতিতে থাকা বেশ কয়েকটি সেক্টরে কর্মরত অনিয়মিতদের বৈধতার বিধান রাখা হয়েছে। তবে নতুন বিলটি পাশ করতে সংসদে ডানপন্থিদের সমর্থন দরকার হবে বর্তমান সরকারের।

কিন্তু বিরোধী ডান দলগুলো অভিবাসন বিলের এই ধারাটির সরাসরি বিরোধিতা করছেন। যার কারণে নতুন বিলের বৈধতা দিতে ধারাটি নিয়ে রাজনৈতিক শিবিরে এক প্রকার স্থবিরতা তৈরি হয়েছে৷

অপরদিকে, নতুন অভিবাসন বিলটিকে যে কোনো মূল্যে আইনসভায় পাস করতে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছেন সরকার ও এমানুয়েল ম্যাক্রঁর রাজনৈতিক দলের বাম প্রভাবিত অংশটি৷

মূলত প্রস্তাবিত অভিবাসন বিলের ৩ অনুচ্ছেদে ‘মেতিয়ের অঁ তনসিওঁ’ বা গুরুতর শ্রমিক সংকটে থাকা সেক্টরগুলোর আওতায় অনথিভুক্তদের বিশেষ রেসিডেন্স পারমিট দেয়ার কথা বলা হয়েছে৷

ফরাসি জাতীয় সংসদে বিলটি সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে পাশ করতে বর্তমান সরকারকে বিরোধী বাম অথবা ডান যেকোন একটি শিবিরের সমর্থন লাগবে৷

প্রস্তাবিত বিল নিয়ে বিরোধী ডান রাজনৈতিক দল ‘লে রিপাবলিকান’ বা এলআর দল থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ও সিনেটররা নতুন অভিবাসন বিলের অনিয়মিতদের ফেরত পাঠানো জোরদার করার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। কিন্তু তারা একই সাথে অনিয়মিতদের বৈধতা প্রদানের প্রস্তাবের তীব্র বিরোধীতা করেছে।

তাদের মতে, আইনের এই ধারাটি পাস হলে একটি ‘অস্পষ্ট শূন্যতা’ তৈরি করবে৷ যা অবৈধ অভিবাসনকে উৎসাহিত করবে৷ অনুচ্ছেদ ৩ যুক্ত থাকলে তারাঁ আইনের পক্ষে ভোট দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে নিন্দা প্রস্তাবের হুমকি দিয়েছে৷

এল আর দলের সিনেট সদস্যদের প্রধান ব্রুনো রোতায়িও মঙ্গলবার ফরাসি গণমাধ্যম রেডিও সুদকে বলেন, “আমি এই সরকারের পতন ঘটাতে ভয় পাই না।”

তিনি জোর দিয়ে বলেন, “একজন অনথিভুক্ত শ্রমিকের ফ্রান্সে থাকার অধিকার নেই৷’’

তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেন, নতুন এই বিল উল্টো ফরাসি অভিবাসনকে অভিবাসীদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলবে।

বিরোধী ডান শিবির থেকে এমন কড়া মন্তব্য আসলেও সরকারের বাম ঘেঁষা অংশটিও চাইছে সরকারেরর ওপর চাপ সৃষ্টি করতে৷

সরকারের ওপর চাপ বাড়াতে সংসদে আইন কমিশনের সভাপতি সাচা হোলিয়ের নেতৃত্বে সরকারি জোটের ১০ জন সংসদ সদস্য অনিয়মিত কর্মীদের বৈধতা চেয়ে যৌথ কলাম লিখেছেন৷ এই কলামে বাম জোটের (সবুজ দল, কমিউনিস্ট, সোশ্যালিস্ট, লা ফ্রঁন্স আনসুমিজ) বিপুল সংখ্যক সদস্যরা ছাড়াও মোট ৩৫ জন সাংসদ তাদের সমর্থন প্রকাশ করেছেন।

ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় সম্পাদক ফাবিয়া রুসেল, সোশ্যালিস্ট পার্টির সংসদীয় দলের নেতা বরিস ভালাউ, সবুজ দলের সাবেক কেন্দ্রীয় সম্পাদক জুলিয়া বায়ো আরেকটি আলাদা বিবৃতিতে দাবি করেছেন, “নির্মাণ খাত, হোটেল-রেস্তোরাঁ, পরিচ্ছন্নতাসহ শ্রমিক সংকটে থাকা সেক্টরগুলোতে নিয়মিতকরণ সময়ের দাবি৷ তাদের ছাড়া এসব সেক্টর কাজ করবে না৷’’

ফ্রান্সে অনথিভুক্ত অভিবাসীদের বিষয়ে কোনো সরকারি স্বীকৃত পরিসংখ্যান নেই৷ অভিবাসী তথ্য ও সহায়তা নিয়ে কাজ করা এনজিও জিসতির মতে, ফ্রান্সে আনুমানিক চার থেকে আট লাখ অনিয়মিত অভিবাসী রয়েছে৷

তাদের মধ্যে অনেকেই ফরাসি নাগরিক কিংবা বৈধ অভিবাসীদের ছেড়ে যাওয়া চাকরিগুলোর স্থান পূরণ করেন৷

লোক বা বৈধ বিদেশীদের দ্বারা খালি রেখে দেওয়া চাকরি দখল করে৷ ফ্রান্সে কর্মী নিয়োগে ব্যর্থ হওয়া খাতগুলোকে অর্থনৈতিক পরিভাষায় ‘মেতিয়ের অঁ তনসিওঁ’ বলা হয়৷

নিকোলাস সারকোজির ‘অভিবাসন’ মডেল

জিস্তির আইনজীবী ভিয়োলেন কারে বলেন, “এগুলো মূলত অ-স্থানান্তরযোগ্য পেশা যা কয়েক দশক ধরে বহু অনথিভুক্ত অভিবাসীদের মাধ্যমে চলছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব লোকেরা বৈধ কাজের চুক্তি ছাড়াই কাজ করেন এবং ন্যূনতম মজুরির চেয়ে কম বেতন পান।”

তিনি যোগ করেন, “আবার অনেকেই একজন ব্যক্তির রেসিডেন্ট পারমিট ধার নিয়ে বেনামে বা উপনামে কাজ করেন। কেউ কেউ আবার ইউরোপের অন্য দেশের রেসিডেন্ট পারমিট নিয়ে ফ্রান্সে এসব খাতে কাজ করছেন। যদিও বৈধভাবে তাদের কাজের অধিকার নেই।”

নতুন অভিবাসন বিলের ৩ অনুচ্ছেদটি মূলত সাবেক রাষ্ট্রপতি নিকোলাস সারকোজির অভিবাসন মডেল থেকে অনুপ্রাণিত। ২০০৭ সালে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ব্রিস হর্তোফো নিয়োগকর্তাদের তাদের অনথিভুক্ত কর্মচারীদের বৈধতার জন্য আবেদন করার সুযোগ দিয়ে একটি আইন পাস করেছিলেন৷

সেক্ষত্রে শর্ত ছিল শ্রমিক সংকটে থাকা শহর কিংবা সেক্টড়ে কমপক্ষে এক বছর ধরে কাজ করা৷

এই আইনটি পরবর্তীতে ২০২১ সালে সার্কুলার ভালস নামক একটি ডিক্রি ধারা পরিবর্তন করা হয়েছিল৷ বর্তমানে প্রতি বছর প্রায় ৩০ হাজার অভিবাসী সার্কুলা ভালসের আওতায় নিয়মিত হচ্ছেন বলে একটি অভিবাসন সূত্রে জানা গেছে৷

কিন্তু সার্কুলার ভালসের আওতায় নানা শর্ত আছে যেগুলো পুরোপুরি নিয়োগকর্তা ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর নির্ভর করে। উপরন্তু সব শর্ত পূরণ করলেও শেষ পর্যন্ত রেসিডেন্স পারমিট প্রদানের পুরো ক্ষমতা স্থানীয় প্রেফেকচুরগুলোর উপর নির্ভর করে৷

নতুন অভিবাসন বিলের খসড়ার ৩ অনুচ্ছেদে মূলত বৈধতার আবেদনের ক্ষমতা অনিয়মিত অভিবাসীদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে৷ কারণ বর্তমানে নিয়োগকর্তার অনেক প্রশাসনিক চাওয়া হয়৷ অনেক মালিক তাদের ব্যবসার গোপনীয়তা রক্ষার্থে সেগুলো দিতে চান না৷

আইনজীবী ভিয়োলেন কারে বলেন, “এটি একটি অগ্রগতি হতে পারে। তবে এখনও এগুলো সম্পূর্ণ ভণ্ডামি। অনথিভুক্ত অভিবাসীদের আনুষ্ঠানিকভাবে ফ্রান্সে কাজ করার অধিকার নেই। অপরদিকে, বৈধ হতে তাদের আবার প্রমাণ করতে হবে যে কমপক্ষে আট মাস ধরে চুক্তিতে কাজ করেছেন।”

তার মতে, সরকার এখনও অতীত যুক্তিতে রয়ে গেছে। আমরা অনথিভুক্ত অভিবাসীদের নিয়মিত করতে চাই শুধুমাত্র যখন তারা আমাদের জন্য প্রয়োজনীয়। কিন্তু যখন আমাদের আর তাদের প্রয়োজন হয় না, তখন আমরা তাদের বাড়িতে ফেরত পাঠানোর পরিকল্পনা করি। এটি আসলে আতিথেয়তার কোন বিষয় নয়। শুধুমাত্র শ্রমের ব্যবহার সম্পর্কিত বিতর্কে পরিণত হয়েছে।

তিনি ব্যাখ্যা করেন, ‘‘কারণ বিলে বৈধতার পর যে রেসিডেন্স পারমিটের কথা বলা হয়েছে সেটি শুধুমাত্র এক বছর মেয়াদি হবে। পরবর্তীতে এটি বারবার নবায়ন করতে হবে। বিদেশি কর্মীরা যদি চাকরি পরিবর্তন করেন এবং শ্রমিক সংকটে থাকা সেক্টর থেকে অন্যখাতে চলে যান সেক্ষেত্রে কী হবে সেটি নিয়ে বিলে বলা নেই৷”

দৈনিক লিবেরাশিঁওতে যৌথ কলামে সই করা সরকারি দলের সাংসদ স্টেলা দুপো বলেন, “আমাদের সামনে এগিয়ে যাওয়া জরুরি। এই শ্রমিকদের আমাদের দেশের নির্মাণ, ক্যাটারিং, পরিচর্যা, হোম সাপোর্টসহ নানা খাতে প্রয়োজন। আমাদের কাছে কোনো সমাধান না থাকায় সবাই চোখ বন্ধ করে রাখেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই মানুষগুলোই আমাদের দেশ চালায়। তারা আজ আধুনিক শোষণের শিকার। কারণ বৈধতা ছাড়া তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মধ্যে আটকে আছে৷’’

ফরাসি অর্থনীতির জন্য উপকারী

জিস্তির মতে, অনথিভুক্ত কর্মীরা রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা সহায়তা ছাড়া আর কোনো সামাজিক সহায়তা পান না। তাদের বড় একটি অংশ বেশিরভাগ সময় রাস্তায় বা স্কোয়াটে ঘুমান। বৈধতা ছাড়া তাদের পক্ষে খাদ্য, বাসস্থান, স্বাস্থ্যসেবা এবং স্বাভাবিক সামাজিক জীবনের সুবিধা খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। প্রশাসনিক গোপনীয়তা তাদের অদৃশ্য ও দুর্বল করে তোলে। আমরা এই অনিশ্চয়তা এবং অসামাজিককরণের নিন্দা জানায়।

ভিয়োলেন কারে বলেন, “অনথিভুক্তদের নিয়মিত করা হলে তারা সমাজে সম্পূর্ণরূপে একীভূত হবে এবং একটি মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপন করতে পারবে। এটি ফরাসি অর্থনীতির জন্যও উপকারী হবে। কারণ বৈধ বেতন রশিদ মানে তারা সরকারের সোশ্যাল সিকিউরিটি ও জাতীয় আয়ে ভূমিকা রাখছেন। বৈধতা পেলে তারা প্রকৃত বেতন পাবেন এবং পাশাপাশি সরকারও তার ট্যাক্স পাবে। অপরদিকে তাদেরও ক্রয় ক্ষমতা বাড়বে।”

তবে অনেক নিয়োগকর্তা অনথিভুক্ত অভিবাসীদের নিয়মিতকরণে সমর্থন করলেও এসব বিতর্কে তারা এড়িয়ে যান।

জিস্তির মতে, মালিকদের বেশিরভাগই অভিবাসীদের স্থিতাবস্থাকে স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে নেন না। কারণ সেটি মজুরি বা কাজের অবস্থার ওপর চাপ সৃষ্টি করে। সমাজে অনেক দুর্বৃত্ত নিয়োগকর্তারা আছেন।

সাংসদ স্টেলা দুপোর মতে, এমনও অনেক মালিক আছেন যারা চুপ থাকতে পছন্দ করেন। আমি এমন একজন রেস্তোরাঁ মালিকের সাথে দেখা করি যিনি কোন লোক খুঁজে পাচ্ছে না এবং একটি কঠিন পরিস্থিতিতে আছেন। তিনি আমাকে বর্তমান অবস্থা লজ্জাজনক বলে জানিয়েছেন।

এখন অভিবাসন মহলে আলোচনার বিষয় সরকার কি বিলের ৩ নং অনুচ্ছেদ বহাল রেখে অগ্রসর হবে নাকি ডান ও চরম ডানপন্থীদের চাপে নতি স্বীকার করবে?

মঙ্গলবার সরকারের মুখপাত্র অলিভিয়ে ভেরো সিনিউজ টিভিতে বলেছেন, জোটের সবাই এই বিলের সবগুলো ধারা নিয়ে একমত ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

তিনি বলেন, “যারা অভিবাসন আইনের সঙ্গে যুক্ত জনতুষ্ট বিষয়কে রাজনীতি বানিয়ে প্রচার করছে তারা আসলে মিথ্যা বলছেন। আমরা এখানে মাত্র কয়েক হাজার লোকের কথা বলছি৷”

তিনি জার্মানি এবং এমনকি ডেনমার্কের কথা উল্লেখ করে বলেন, “অনেক দেশের জন্মহার ব্যাপকভাবে কমে যাচ্ছে৷ আজকে বিদেশিদের আগমনকে যারা ভয় পাচ্ছেন তারা জানেন না অভিবাসীরা এখানে এসে চাকরি করবে এবং আমাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করবেন৷’’

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জেরাল্ড দারমানার মতে, খসড়া বিলটি নিয়ে আগামী ৬ নভেম্বর ফরাসি সিনেটে আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে৷ পরবর্তীতে সেটি ২০২৪ সালের শুরুতে সংসদে তোলা হবে৷

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com