ইচ্ছে ছিল পড়াশোনা শিখে বড় কোনো কর্মকর্তা হয়ে মানুষের সেবা করার। তবে দারিদ্রের কষাঘাতে ধুলিসাৎ হয়ে যায় সেই স্বপ্ন। অভাব অনটনের সংসারে শেষ পর্যন্ত উচ্চ মাধ্যমিকের গন্ডিটা পেরোনো হয়নি শাপলার। তার ওপর আবার এসএসসি পরীক্ষার আগেই ১৭ বছর বয়সে বাল্য বিয়ে হয়। তবুও স্বামীকে বুঝিয়ে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেন শাপলা।
পরীক্ষায় ভালো ফলও করেন। এরপর ভর্তি হন এইচএসসিতে। তবে সংসার সামলে লেখাপড়াটা আর শেষ করা হয়নি শাপলার। তার ওপর আবার বেকার স্বামী। শপাপলা আবারও নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন কিছু একটা করার। ছোটবেলায় মা ও প্রতিবেশি নারীদের কাঁথা সেলাই দেখে নিজেও মায়ের কাছ থেকে কিছুটা রেপ্ত করেছিলেন।
শাপলা জানান, ২০১৮ সালে স্থানীয় মহিলা বিষয়ক অধিদফতর থেকে প্রশিক্ষণ নেন। তারপর সেখান থেকেই ১৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে শুরু হয় শাপলার সুঁই-সুতোয় স্বপ্ন বুননের গল্প। শশুরবাড়িতে গড়ে তোলেন ‘শাপলা নকশী ঘর’। শশুর-শাশুড়ি আর স্বামীর বাঁধা উপেক্ষা করেই শুরু শাপলার উদ্যোক্তা হওয়ার যাত্রা।
প্রথমে একটা দুইটা করে নকশী কাঁথা তৈরি করে তা গ্রাম, পাড়া-মহল্লা, উপজেলা ও জেলার বিত্তবানদের কাছে বিক্রি করতেন। নকশী কাথায় তার সুনিপুণ কারুকাজ ধীরে ধারে নজর কাড়তে থাকে সমাজের সৌখিন মানুষদের। এরই মাঝে স্থানীয় মহিলা অধিদফতরের এক মেলায় নিজেকে তুলে ধরার সুযোগ পান শাপলা।
শুরু হয় শাপলার উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্প।
মহিলা অধিদফতর থেকে আবার তাকে দেওয়া হয় ৩০ হাজার টাকা ঋণ। বর্তমানে তিনি এই পেশায় একজন সফল উদ্যোক্তা হতে প্রাণপণ লড়াই করছেন। জোর দিয়েছেন নিজের শাপলা নকশী ঘর প্রতিষ্ঠানের প্রতি।
সরেজমিনে শাপলার নকশী ঘরে গিয়ে দেখা যায়, আপন মনে সেখানে সুঁই-সুতো দিয়ে নকশী কাঁথা সেলাই করছেন অনেক নারীরা। এখান তার অধীনে কাজ করছেন অন্তত ১৫০ নারী। এদের কেউ গৃহিনী, কেউবা স্বামী পরিত্যক্তা অসহায় নারী।
সেখানে কাজ করেন অনেক শিক্ষার্থীরাও। এদের প্রত্যেকেই এখন স্বাবলম্বী। প্রতিমাসে এই নকশী কাথার সুই-সুতোর ফোড়নে শাপলার আয় প্রায় ১৫ হাজার টাকা। তার অধীনে কর্মরত নারীরাও প্রতিমাসে ৩-৪ হাজার টাকা আয় করেন।
চন্দনা শর্মা নামে এক নারী জানান, ‘স্বামী কাঠমিস্ত্রির কাজ করেন। ঠিকমতো সংসার চলে না। তাই এখানে কাজ করি। প্রথমে স্বামী এই কাজে বাধা দিতেন। এখন এখান থেকে মাসে ৩-৪ হাজার টাকা আয় হয়। এখন স্বামী সন্তান নিয়ে সুখেই আছি।’
নকশী কাথা সেলাই করতে করতে একাদশ শ্রেণীর এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘লেখাপড়া করার পর অবসর সময়ে এ নকশী কাঁথা সেলাই করি। এখান থেকে যে টাকা পাচ্ছি, তাতে আমার নিজের খরচ যেমন হচ্ছে। তেমন পরিবারকে কিছু দিতে পারছি।’
শাপলা খাতুন জানান, ‘ছোটবেলাই মা ও প্রতিবেশিদের দেখে কাঁথা সেলাই শিখেছিলাম। বাবার দরিদ্রতা আর স্বামীর বেকারত্বের কারনে নকশী কাঁথায় সুঁই-সুতোর ফোড়নে নিজের ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে এই কাজ শুরু করি। প্রথমে কাঁথা সেলাই করে আমি শহরে গিয়ে বিভিন্ন দোকানে রেখে আসতাম।’
‘আর তাদের বলতাম, আমার নকশী কাঁথা আপনাদের দোকানে রাখেন; বিক্রি করতে পারলে পরে আমাকে টাকা দিয়েন। কাঁথা বিক্রি হলে তারা বিকাশে টাকা পাঠিয়ে দিতেন। আমার এ কাজ একদিন এক মহিলা কর্মকর্তা দেখেন। তিনি পরে আমাকে ফোন দিয়ে তার অফিসে ডেকে ১০টি কাঁথা কিনে নেন।’
শাপলা প্রতিমাসে অন্তত ২০-২৫ টা নকশী কাঁথা তৈরি করি। প্রতিটি নকশী কাঁথার দাম ১০০০-৩০০০ টাকা পর্যন্ত। বর্তমানে জেলা উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে এসে মানুষ এসব নকশী কাঁথা কিনে নিয়ে যায়। শাপলা জানান, ‘আমাকে একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে সহযোগিতা করছেন উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনও এবং মহিলা অধিদফতর।’
চলতি মাসে ওই দফতরের আয়োজনে আমি উপজেলার ৩০জন নারীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতর কিংবা কোনো প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা পেলে নিজ প্রতিষ্ঠানের পরিধি আরও বাড়াতে পারতাম।’
মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মুন্সী ফিরোজা সুলতানা বলেন, ‘নকশী কাঁথায় শাপলার সুনিপুণ কারুকাজ সত্যিই অসাধারণ। আমরা তার পশে আছি।’
হরিনাকুন্ডু ইউএনও সৈয়দা নাফিস সুলতানা বলেন, ‘শাপলার তৈরি নকশী কাঁথা দেখলে মন জুড়িয়ে যায়। তার অসাধারণ কারুকাজ এরই মধ্যে সবমহলে প্রশংসিত হয়েছে। তার কাছ থেকে আমি ৩টি কাঁথা কিনেছি। তিনি আরো বলেন, তাকে একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে আমরা চেষ্টা করছি। আমাদেও পক্ষ তেকে তাকে সব ধরনের সুবিধা দেওয়া হবে।’
হরিণাকুণ্ডু উপজেলা চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর হোসাইন বলেন, শাপলার মাধ্যমে উপজেলায় নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে নকশী কাঁথাসহ নানারকম হস্তশিল্পের কাজে উৎসাহিত করছি। এরইমধ্যে এসব নারীদের জন্য উপজেলায় একটি শোরুম নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। এসব নারীরা নকশী কাঁথাসহ তাদের তৈরি নানা হস্তশিল্প এখান থেকেই দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে দিতে পারবে।’