শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:০৬ অপরাহ্ন

ধর্মান্তরের ফলে গারোদের সমাজব্যবস্থার অনেক পরিবর্তন ঘটেছে

  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ২৩ মে, ২০২৩

বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি মুসলিম দেশ। এদেশে অধিকাংশ বাঙালি জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। এছাড়া রয়েছে প্রায় ৫০টি ক্ষুদ্র উপজাতীয় সম্প্রদায়ের বসবাস। বাংলাদেশে সাধারণত পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা বিদ্যমান।

বাংলাদেশে শুধু গারো ও খাসিয়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা ছিল। এদেশের মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার ধারক হিসেবে এ দু’টি জনগোষ্ঠী পরিচিত। গারোরা বৃহত্তর ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইলের মধুপুর এবং গাজীপুরে বসবাস করে। খাসিয়ারা সিলেটে বসবাস করে। এরা ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গারো ও খাসিয়া পাহাড় থেকে বাংলাদেশে এসেছিল। উভয়ের আছে নিজস্ব ভাষা, ধর্ম, সমাজ ও সংস্কৃতি। আছে তাদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির নানান উপাদান।

বাংলাদেশে বসবাসরত গারো সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীরা মঙ্গোলীয় বংশোদ্ভূত। এদের আদিনিবাস চীনের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের সিন-কিয়াং প্রদেশে। পরে বিভিন্ন সমস্যায় পতিত হয়ে দেশত্যাগ করে তারা তিব্বতে দীর্ঘদিন বসবাস করে। এরপর ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের পার্বত্য এলাকায় এবং বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের কিছু এলাকায় তারা বসবাস করে। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহাড় এবং বাংলাদেশের মধুপুর গড়ের বনাঞ্চলকে কেন্দ্র করে মূলত গারোদের নিবাস গড়ে উঠেছিল। বর্তমানে গারো সম্প্রদায়ের অধিকাংশ জনগণের বসবাস ভারতের মেঘালয়ের গারো পাহাড়ে। এছাড়া বাংলাদেশের মধুপুর গড়াঞ্চলেও এদের বসবাস রয়েছে। বিশেষ করে টাঙ্গাইলের মধুপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, জামালপুর, গাজীপুরে ও ঢাকায় গারোদের বসবাস। ভারত ও বাংলাদেশÑউভয় দেশেই গারো জনগোষ্ঠী তাদের আদিধর্ম সাংসারেক থেকে বর্তমানে প্রায় শতভাগ খ্রিষ্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছে।

ঐতিহ্যগতভাবে গারোরা মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার অধিকারী ছিল। এখনও বংশীয় পদবি ব্যবহারে মাতৃসূত্রীয় সমাজ দেখা যায়। তবে বর্তমানে ধর্মান্তরের ফলে গারো সমাজ ও সংস্কৃতিতে খ্রিষ্টান ধর্মের প্রভাব বেশি। পূর্বপুরুষের আদি ধর্ম সাংসারেক ছেড়ে খ্রিষ্টান ধর্মে ধর্মান্তরের ফলে গারোদের ঐতিহ্যবাহী মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় খ্রিষ্টান ধর্ম প্রভাব বিস্তার করছে। খ্রিষ্টান ধর্মের প্রভাবে গারোদের মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা অধিকাংশ ক্ষেত্রে পিতৃতান্ত্রিকতায় রূপ নিয়েছে।

মাতৃতান্ত্রিক সমাজে পরিবারের দায়িত্ব থেকে শুরু করে পরিবার পরিচালনা, পরিবারের সিদ্ধান্ত, বংশের ধারা, পরিবারের ক্ষমতা প্রভৃতি একজন নারীর ওপর অর্পিত থাকে। মায়ের পরিবার থেকেই উত্তরাধিকার ও বংশ-পদবি নির্ধারিত হয়। প্রজš§ থেকে প্রজš§ান্তরে মাতৃগোত্রীয় বংশাণুক্রমিক ধারা অব্যাহত থাকে। সম্পত্তির মালিকানা, উত্তরাধিকার প্রথা, বিয়ে করে স্বামীকে নিজের বাড়ি নিয়ে আসা ইত্যাদি মাতৃতান্ত্রিক সমাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ঐতিহ্যের ভিত্তিতে নিঃসন্দেহে গারো সমাজ মাতৃতান্ত্রিক ছিল এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু বর্তমানে বা বিগত কয়েক দশকে গারো সমাজব্যবস্থা আর আগের মতো নেই। মাতৃতান্ত্রিকতা এখন মুখে বা বইপত্রে থাকলেও বাস্তবে তাদের সমাজ ও পরিবারে মাতৃতান্তিরকতার চর্চা দেখা যায় না। মেয়েদের থেকে পুরুষই গারো সমাজ ও পরিবারের কর্ণদ্বার হয়ে উঠছে। একটা সমাজব্যবস্থাকে জানার জন্য পরিবার প্রধান, পরিবারের সিদ্ধান্ত, ক্ষমতায়ন, সমাজের সালিশ ও বিচার ব্যবস্থা, সম্পত্তির মালিকানা, বিয়ের ধরন, বংশীয় পরিচয় ও উত্তরাধিকার প্রথা প্রভৃতি বিষয়গুলো বিবেচনা করা যেতে পারে। তাহলে সে সমাজের বিষয়ে জানতে পারব। এসব বিষয় পর্যালোচনা করলে গারো সমাজকে কোনোভাবেই মাতৃতান্ত্রিক সমাজ বলা যায় না। বরং পুরুষের প্রভাবই বেশি দেখা যায়।

ক্ষমতায়নের দিক থেকে গারো সমাজে বর্তমানে পুরুষের প্রভাবটাই বেশি। পুরুষই পরিবার ও সমাজের প্রধান। সালিস ও বিচারব্যবস্থা পুরুষ পরিচালনা করে থাকে। পরিবার ও সমাজে নারী-পুুরুষ উভয়ের মতামত থাকলেও পুুরুষের মতামতই চূড়ান্তরূপে গণ্য হয়। ঐতিহ্যিকভাবে মাতৃতান্ত্রিক হলেও গারো সমাজের সং নকনা (মাতব্বর বা হেডম্যান) সবসময় পুুরুষই ছিল। সমাজের সালিস ও বিচারব্যবস্থা পুুরুষই পরিচালনা করে থাকে। মাতৃতান্ত্রিক সমাজ হলেও এটা আগে থেকেই তাদের সমাজে প্রচলন ছিল। ইদানীং সালিসে নারীরাও অংশ নেয়। যেটা আগে খুব একটা ছিল না। পাড়া বা সমাজের হেডম্যান বা মাতব্বর বর্তমানেও পুুরুষরা নির্বাচিত হয়। গারো সম্প্রদায়ের শুধু হেডম্যান না  বরং তাদের পুরোহিতও (সাংশারেক ধর্মে থাকতে)  পুুরুষ। গারো জনগোষ্ঠী খ্রিষ্টান হওয়ার পর নতুন ধর্মের ধর্মযাজকও পুুরুষ। তাদের সমাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে চার্চের প্রভাব দেখা যায়। নতুন ধর্মের ফলে গির্জাভিত্তিক সমাজব্যবস্থায় ধর্মযাজকই সমাজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে পরিগণিত হয়।

সম্পত্তির মালিকানার ক্ষেত্রে আগে মেয়েরা বিশেষ করে নকনা (ছোট মেয়ে) পেলেও বর্তমানে সবাই সম্পত্তির অধিকার পায়। এক্ষেত্রে ছেলে-মেয়ে বলে কোনো ভেদাভেদ নেই। খ্রিষ্টান হওয়ার পরে তারা মনে করে সব মানুষ সমান। সবার সমান অধিকার আছে। এজন্য তারা শুধু মেয়েদের সম্পত্তি দিয়ে ছেলেদের বঞ্চিত করবে এ ধরনের মানসিকতার পরিবর্তে সবাইকে সম্পত্তি দিয়ে থাকে। তবে কোনো কোনো পরিবারে সম্পত্তির ক্ষেত্রে এখনও মেয়েরা কিছুটা বেশি পায়। ক্ষমতা থেকে শুরু করে পরিবার বা সমাজের প্রধান হওয়ার জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সম্পত্তি। আগে যেহেতু মেয়েরা সম্পত্তির মালিক হতো সেহেতু পরিবারে তাদের ক্ষমতা বেশি ছিল। কিন্তু যখনই সম্পত্তিসহ শিক্ষাগত যোগ্যতা মেয়ের তুলনায় ছেলেদের হাতে বেশি পরিমাণে ন্যস্ত হচ্ছে সেহেতু ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু পুুরুষরা দখল করতে সক্ষম হচ্ছে। যার ফলে পরিবারের প্রধান হিসেবে আগে মেয়ে নির্বাচিত হলেও বর্তমানে পুুরুষই অধিকাংশ পরিবারের প্রধান হয়। সম্পত্তি পাওয়ার পাশাপাশি শিক্ষা-দীক্ষায় পুুরুষরাই মেয়েদের থেকে অগ্রসর। এভাবে পরিবারের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা এখন পুুরুষের হাতে। তবে নারী-পুুরুষ উভয়ের মতামতের ভিত্তিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে পুুরুষ।

বিয়ের ক্ষেত্রেও অনেক পরিবর্তন ঘটেছে গারো সমাজে। আগে গারো সমাজে জামাই আনা হতো। স্ত্রীপক্ষ বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতো। নারীপক্ষের পছন্দ অনুযায়ী ছেলেকে জামাই আনা হতো। জামাই তার শ্বশুরবাড়িতে থাকত। সংসারের সবকিছু দেখাশোনা করত। কিন্তু বর্তমানে সেটা আগের মতো নেই। এখন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুুরুষরা বিয়ে করে নিজের বাড়িতে বউ নিয়ে আসে। নারী তার শ্বশুরবাড়িতে সংসার করে। কোনো মেয়েও আর আগের মতো স্বামী আনতে চায় না। ছেলেরাও শ্বশুরবাড়িতে জামাই হিসেবে যেতে অনিচ্ছুক। মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার ফলে গারো সমাজে বিয়ের যে কাঠামো ছিল সেটারও পরিবর্তন ঘটেছে গারো সমাজে। খ্রিষ্টান ধর্মে ধর্মান্তরের ফলে শিক্ষার অগ্রসরতার কারণে ছেলেরা আগের মতো শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে সংসার করার মানসিকতা পরিহার করেছে। বরং সবাই বউ নিয়ে আসে নিজের বাড়িতে সংসার করছে। আর এক্ষেত্রেই ক্ষমতাটা পুুরুষের হাতে চলে আসছে। আগে যখন পুুরুষ মেয়েদের বাড়ি গিয়ে সংসার করত তখন তাকে তার বউ, শ্বশুর-শাশুড়ি এবং ওই পরিবারের সবাইকে সমীহ করে চলতে হতো।

গারোদের সমাজব্যবস্থা মাতৃতান্ত্রিক বলা হলেও তা আর মাতৃতান্ত্রিকতা নেই। যেমনটা নেই তাদের আগেকার সাংসারেক ধর্ম। গারোদের পরিবার ও সমাজে মাতৃতান্ত্রিকতার চর্চা খুবই সামান্য। ধর্ম পরিবর্তনের ফলে তাদের সমাজ ও সংস্কৃতির অনেক বিষয়ের পরিবর্তন ঘটেছে। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে তাদের সমাজব্যবস্থা। মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার অনেক বিষয় মাতৃতান্ত্রিকতাকে পরিহার করে পিতৃতান্ত্রিকতার সূত্রপাত ঘটেছে। পুুরুষের প্রাধান্য কায়েম হচ্ছে। অনেক গবেষক গারো সমাজ ও সংস্কৃতির পরিবর্তনে বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতির ওপর দোষারোপ করেছেন। তাদের বয়ানে বাঙালিদের ওপর বিদ্রƒপ ও বিদ্বেষ ছড়ানোর বিষয়টি দেখা গেলেও মূল কারণ মাটিচাপা দিয়ে পড়ে থাকে। কিন্তু গারো সমাজ ও সংস্কৃতি পরিবর্তনে বাঙালি সংস্কৃতি প্রভাব বিস্তার করেনি। বরং ধর্মান্তরিত খ্রিষ্টান হওয়ার পর খ্রিষ্টান ধর্মের প্রথা-মূল্যবোধ ও পাশ্চাত্যের খ্রিষ্টান সংস্কৃতি গারো সমাজ ও সংস্কৃতির ওপর প্রভাব বিস্তার করছে।

গারো সমাজ বর্তমানে একদিকে আধুনিক পাশ্চাত্যের খ্রিষ্টান সংস্কৃতিকে গ্রহণ করছে অন্যদিকে তারা খ্রিষ্টান ধর্মের ভাবাদর্শে জীবন পরিচালনা করছে। যার ফলে মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা ক্রমান্বয়ে পিতৃতান্ত্রিকতায় রূপ লাভ করছে। এছাড়া খ্রিষ্টান হওয়ার পর তারা আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে অনেক অগ্রসর হয়েছে। আধুনিক শিক্ষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক অগ্রসর হয়েছে।

শিক্ষায় অগ্রসর হওয়ার ফলে তারা তাদের সনাতনী চিন্তাভাবনা থেকে বের হয়েছে। পুুরুষরা নারীর অধীনে থাকার মতো মানসিকতা পরিহার করে নিজেরাই পরিবার ও সমাজের প্রধান হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সাংসারেক থেকে খ্রিষ্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়া গারো জনগোষ্ঠী ঐতিহ্যবাহী মাতৃতান্ত্রিক সমাজের পরিবর্তে পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা কায়েম করছে।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com