বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:৩৪ অপরাহ্ন
Uncategorized

দ্বীপের নাম জামাইকা

  • আপডেট সময় শুক্রবার, ৮ অক্টোবর, ২০২১

সুদূর জামাইকায় পৌঁছেছিলাম জাহাজে চড়ে। জামাইকা ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের একটি দ্বীপ, ক্যারিবিয়ান সাগরের উপরে। জাহাজ যখন জামাইকার মাটি ছুঁল, তখন দুপুর। আকাশে ঘন মেঘ, অল্প অল্প বৃষ্টি পড়ছে। দূরে পাহাড়ের সারি। দূষণহীন বাতাসে কেমন যেন বুনো গন্ধ। জাহাজ থেকে দেখতে পাচ্ছি একটা কৃষ্ণচূড়া গাছে কত ফুল হয়ে আছে। পোর্টটির নাম এসকুইভাল। একপাশে অনেক লম্বাটে কন্টেনার রাখা আছে। এগুলোতে অ্যালুমিনা ভর্তি। পোর্টের মধ্যে দিয়ে রেল লাইন চলে গেছে। ছোট রেলগাড়িতে করে এই কন্টেনারগুলো আসে, জাহাজে চড়ে ভিনদেশে পাড়ি দেবে বলে। জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে দেখলাম দূরে সমুদ্রের রংটা নীল আর সবুজের মিশেল, ইংরেজিতে যাকে বলে সি-গ্রিন। অদ্ভুত সে রঙের মহিমা। চোখে ঘোর লেগে যায়। মনে হয় যেন কেউ সযত্নে রং-তুলি দিয়ে এঁকে দিয়েছে এই দৃশ্যপট।

পরের দিন বিকেলবেলা বেরোলাম জামাইকা ঘুরে দেখব বলে। পোর্ট থেকে বেরোনোর সময় গেটে আমাদের আলাদা অনুমতিপত্র তৈরি হল। বাইরে বেরিয়ে দেখলাম আশপাশে কোন যানবাহন তো নেই, মানুষজনও নেই বিশেষ। ঘুরতে যাব কী করে? আবার ফিরে গেলাম পোর্টের অফিসে। যিনি আমাদের অনুমতিপত্র দিয়েছিলেন, তাঁকে বলতে তিনি পোর্টের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা একটি গাড়ির ব্যাবস্থা করে দিেনল কিছু ডলারের বিনিময়ে। আমরা যাব ‘ওল্ড হারবার’।

‘তাইনু’ উপজাতিরা জামাইকার নাম রেখেছিল ‘জায়মাকা’, মানে কাঠ ও জলের দেশ যা পরবর্তীকালে বদলে হয় জামাইকা। পোর্ট থেকে ওল্ড হারবারের পথটা যেতে মিনিট পনেরো সময় লাগলো। পুরো রাস্তাটাই প্রচুর গাছপালায় ঘেরা, দেখলে জঙ্গল বলে মনে হয়। গাড়িটা আমাদের বাজার এলাকা থেকে খানিকটা দূরে ছেড়ে দিল। ড্রাইভার বলল তার বিশেষ কাজ থাকায় সে এখানে আমাদের ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে, বাজার পর্যন্ত যেতে পারছে না। আশপাশে গাছপালার মাঝে অল্প কিছু বাড়িঘর। জনবসতি খুবই কম।

কিছুক্ষণ এদিক ওদিক ঘোরাফেরার পর বাজার এলাকায় চলে এলাম। এখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দোকান ছাড়াও অনেক অফিস-কাছারি আছে। এই জায়গাটায় মানুষজনের সংখ্যাও বেশি। রাস্তার সংযোগস্থলে একটা লোহার ঘড়ি আছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রায় শুরু থেকে এটা আছে এবং এখনও নির্ভুল সময় দেখাচ্ছে।

সন্ধে হয়ে আসছে, দোকানপাটও বন্ধ হওয়ার মুখে। আমরা একটা রেস্তরাঁয়  ঢুকলাম। কেউই খাবারের দিকে বিশেষ মন দিতে পারলাম না। কারণ অন্ধকার হয়ে আসছে, ফিরতে হবে জাহাজে। যদিও পথ বিশেষ লম্বা নয়, তবুও জায়গাটা তো পুরো অচেনা। হাঁটতে হাঁটতে আমরা পুলিশ স্টেশনের  সামনে চলে এলাম। রাস্তার ধারেই একটি শ্বেতপাথরের ফলক। আধো অন্ধকারে ভাল করে পড়া যাচ্ছে না, তবুও মন দিয়ে পড়লাম। তাতে লেখা -“১৮৪৫ সালে ‘মেইডস্টোন’ নামে একটি জাহাজ উত্তর ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ২০০জন পুরুষ, ২৮জন মহিলা (যাঁদের বয়স তিরিশের নীচে) এবং ৩৩ জন শিশুকে (যাঁরা ১২ বছরের নীচে) নিয়ে জামাইকার ওল্ড হারবারে আসে”। ফলকটার সামনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। হায়রে আমি! দশ মিনিটের অন্ধকার পথ পেোরতে হবে বলে দুশ্চিন্তায় মরছি। এই মানুষগুলো কিসের ভরসায় লক্ষ লক্ষ মাইল পেরিয়ে এসেছিল ঘরবাড়ি আপনজন সবাইকে ছেড়ে কে জানে! তারা তো আমারই দেশের মানুষ। ঘড়িতে তখন সন্ধে সাতটা, কিন্তু মনে হচ্ছে যেন কত রাত। আশপাশে বিশালদেহী মানুষেরা ঘুরছে, দুর্বোধ্য ভাষায় কথা বলছে, আড়চোখে আমাদের দেখছে। আশপাশে যদিও অনেক ট্যাক্সি যাতায়াত করছে, কিন্তু কেউই পোর্টের দিকে যেতে রাজি  নয়। অবশেষে একজন রাজি হল,আর আমরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। কিন্তু ট্যাক্সি চলতে শুরু করার পর যেই চারিদিক আরও গভীর অন্ধকারে ডুবে গেল তখন আরও ভয়ে কুঁকড়ে গেলাম – ট্যাক্সিওয়ালা ঠিক রাস্তায় যাচ্ছে তো? প্রায় দমবন্ধ করা পরিস্থিতির মধ্যে কিছুক্ষণ কাটানোর পর হঠাৎই দেখলাম জাহাজের আলোগুলো দেখা যাচ্ছে। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার পর নিজের উপর ধিক্কার জন্মাল, ছিঃ, কী অকারণেই না এই মানুষগুলোর উপর সন্দেহ হচ্ছিল।

পরের দিন বৃষ্টি আরম্ভ হল, জাহাজের মাল নামানোর কাজও বন্ধ হয়ে গেল। তাই জামাইকায় থাকার মেয়াদও বেড়ে গেল। টেলিভিশন খুললেই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে ঝড়ের সতর্কীকরণ। বারবার বলা হচ্ছে–যে মানুষদের ঘরবাড়ি ততখানি শক্তপোক্ত নয়, তারা কীভাবে ঝড়ের মোকাবিলা করবে। ভূমিকম্পেরও সতর্কীকরণ চলছে। ভূমিকম্পপ্রবণ এই দ্বীপটায় একসময় বহুতল বাড়ি বানানো নিষিদ্ধ ছিল, যদিও এখন আর নেই। ভাবতে অবাক লাগে আসুরিক শক্তিওলা এই বিশালদেহী মানুষগুলো প্রকৃতির কাছে কতটা অসহায়।

ওল্ড হারবার থেকে কিছুটা দূরে কোলবেক ক্যাসেল। বহুবছর ধরে এটি জামাইকার সবচেয়ে বড় বাড়ি ছিল। রহস্যময় বাড়িও বলা হত। এই বাড়িটি ছিল জন কোলবেকের। ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীর কর্নেল ছিলেন জন। আমরা শুধু এখন বাড়িটির ধ্বংসাবশেষ দেখতে পেলাম। ঐতিহাসিকরা দাবি করেন যে এই বাড়ি একসময় তিনতলা সমান উঁচু ছিল, চারিপাশে ছিল পরিখা আর মাটির অনেক নীচে ছিল ঘর যেখানে ক্রীতদাসদের রাখা হত।

ক্রিস্টোফার কলম্বাস এই দ্বীপে এসেছিলেন সোনার খোঁজে যদিও তা পাওয়া যায়নি। স্পেনের রাজা পুরো দ্বীপটাই তাঁদের নামে লিখে দেন। কলম্বাসের ছেলে এই জামাইকাতেই বসবাস শুরু করে। স্পেন সরকার যখন বুঝল এই দ্বীপের কী অপরিসীম বাণিজ্যিক গুরুত্ব তখন ১৬২০ সালে এই দ্বীপ অধিগ্রহণ করেন।

এদের পরে আসে ইংরেজরা। এদেশে আফ্রিকানদের ক্রীতদাস বানিয়ে আনা হত। এখন নব্বই শতাংশ মানুষই আফ্রিকান বংশোদ্ভূত। জামাইকার প্রতিটি ক্ষেত্রে আফ্রিকানদের প্রভাব দেখতে পাওয়া যায়। নাচ এদের সংস্কৃতির বড় অঙ্গ এবং এগুলি বেশির ভাগটাই এসেছে ক্রীতদাসদের কাছ থেকে। এই গল্পগুলো শুনতে বেশ ভালই লাগছিল পিটারের কাছ থেকে। পিটার আমাদের গাইড, জাহাজের ক্যাপ্টেনের অনুরোধে এখানকার এজেন্ট ঠিক করে দিয়েছেন। পিটার খুব গর্বের সঙ্গে জানাল সারা পৃথিবীতে, ক্যালিপসো সঙ্গীতের গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে।

জাহাজের থাকার মেয়াদ বেড়ে যাওয়ায় আমরা কিংসটন যাব ঠিক করলাম। ওল্ড হারবার থেকে এই শহরের দূরত্ব মাত্র ৩৩ কিমি। কিংসটন শহরের মোটামুটি দুটি ভাগ আছে, এক দিকটা পুরনো, অন্য দিকটা নতুন, পুরনো অংশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দেখলাম অনেক ঐতিহাসিক বাড়ি। জনবসতিও খুব বেশি। ফুটপাতে খুব ভিড়। নিউ কিংসটন অংশটি গড়ে উঠেছে ব্লু মাউন্টেনকে পেছনে রেখে।

ব্লু মাউন্টেনে পর্যটকরা হেঁটে বা বাইকে করে ওঠেন। ভারী সুন্দর রাস্তা পাহাড়কে সরীসৃপের মতো পাক দিয়ে উঠেছে। এই পাহাড়ে খুব অল্প হলেও জনবসতি আছে। যেতে যেতে পথের গাছগাছালি ও পাখিদের আওয়াজ মন ভাল করে দেয়। সাত হাজার চারশো ফিটের উচ্চতার এই পাহাড়ের কফি খুব বিখ্যাত। পথে যেতে যেতে সুন্দর ঝরনাও চোখে পড়ল। সময়ের অভাবে পুরো পথটা উঠতে পারলাম না। তিন থেকে চার ঘণ্টা সময় লাগে চূড়ায় উঠতে। তবে যতটুকু উঠেছিলাম তাতে যা ছবির মতো দৃশ্য দেখেছি,তাতে মন ভরে যেতে বাধ্য। সবুজ গাছগাছালির মধ্যে চোখে পড়ে সুন্দর ঝর্না। অনেকেই রাতে হাঁটা আরম্ভ করেন, ভোরবেলা চূড়ায় উঠে সূর্যোদয় দেখবেন বলে।  ঘুরতে ঘুরতে বেশ দেরি হয়ে গেল। পিটার ফেরার জন্য খুব তাড়া দিচ্ছিল। ব্লু মাউন্টেনের গায়ে একটা দুর্গ, আগে এখানে ব্রিটিশদের সৈন্য সামন্তরা থাকত।

বর্তমানে এটি ফৌজিদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। পাহাড়ে উঠতে উঠতে প্রশিক্ষণরত ফৌজিদের দেখতে পেলাম। কিংসটনের রাস্তায় দুটো জিনিস দেখলাম – প্রচুর পরিমাণে ফল বিক্রি হচ্ছে প্রায় সব জায়গাতে, যেমন কলা, আখ, কাঁঠাল, বেরি জাতীয় আরও কিছু ফল যেগুলির নাম জানি না। আর ফেরিওয়ালারা পসরা সাজিয়ে বসেছে হাজার রকমের হাতের কাজের জিনিস দিয়ে। নীল জল আর সাদা বালির বিচ লাইমকেও ঘুরে এলাম। ছুটির দিনে এই দ্বীপে প্রচুর মানুষের ভিড় হয় বলে শুনলাম। আমাদের গাইড  বেশ অমায়িক। কিংসটন যাওয়ার পথে নিজের দেশ সম্বন্ধে অনেক গল্প শুনিয়েছে। জামাইকান হিসেবে নিজের দেশ নিয়ে খুব গর্বিত সে। সে বলল গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে জামাইকার নাম আছে প্রতি বর্গমাইলে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক চার্চ থাকার জন্য, যদিও এদেশে হিন্দু, মুসলমান, ইহুদি সব জাতির মানুষই বাস করেন। এদেশে আর একটি ধর্ম আছে যার অনুগামীদের বলা হয় রাস্টাফারিয়ান। এই ধর্ম মূলত কৃষ্ণবর্ণ মানুষদের ধর্ম। এরা ইথিওপিয়ার রাজা হায়লে সেলাসি অথবা রাসতেফারিকের উপাসনা করেন। এই ধর্মাবলম্বী পুরুষেরা চুল ও দাড়ি আঁচড়ায়না। গাইডের কাছেই শোনা একটা মজার কথা, আমাদের যেমন মুখে ভাত বা পৈতে হয় এঁরা সেরকম পবিত্র অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মারিজুয়ানা সেবন করেন। অবশ্য এই নেশার সামগ্রীটিকে ওষুধ হিসেবেও ব্যবহার করেন।

জাহাজের কাজ শেষ মানে আমাদেরও থাকার মেয়াদ ফুরল। একদিন ভোঁ বাজিয়ে জাহাজ পাড়ি দিল অন্য দেশে। জাহাজের ব্রিজ ডেকে (সব থেকে উঁচু ডেক) দাঁড়িয়ে দেখলাম নারকেল গাছে ঘেরা সবুজ দ্বীপটা ক্যারিবিয়ান সাগরের গায়ে ঠিক যেন মানচিত্রের মতো লেপ্টে আছে। পরের গন্তব্য আবার নতুন কোনও জায়গা, নতুন কোনও দেশ।

কীভাবে যাবেন

কলকাতা থেকে জামাইকার সরাসরি উড়ান নেই, ইউরোপ বা আমেরিকা হয়েই যেতে হয়। বিমান সংস্থাগুলোই সব ব্যবস্থা করে দেয়। বিভিন্ন ভ্রমণ সংস্থা আছে যারা প্যাকেজ ট্যুর করায়

কোথায় থাকেবন

কিংসটনে বিভিন্ন দামের হোটেল আছে, পাঁচতারা থেকে শুরু করে, সাধারণ মাপের হোটেলও – প্রত্যেকটিই খুব ভাল।

কী নেবেন

ভাল জুতো। ছাতা, টুপি, টর্চ, জলের বোতল এবং হালকা কিছু খাবার।

কখন যাবেন

নভেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় জামাইকা যাওয়ার জন্য সবথেকে ভাল। এই সময়ে আবহাওয়া খুব ভাল থাকে।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com