সোমবার, ০৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০৩:৪৩ পূর্বাহ্ন

দেশে বসেই বিদেশের চাকরি রিমোট জব খুলে দিচ্ছে সম্ভাবনার দুয়ার

  • আপডেট সময় রবিবার, ২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

রিমোট চাকরির সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এর কাজের ধরণ অনেক নমনীয়। যেহেতু বাসা থেকেই কাজ করা যায়, তাই নিজের আরামদায়ক পরিবেশে থেকে কাজ করা সম্ভব। প্রতিদিনের যাতায়াতের ঝামেলা, যানজট কিংবা ফর্মাল পোশাক পরার বাধ্যবাধকতা—এসব নিয়ে চিন্তা করতে হয় না।

কোভিড মহামারির লকডাউনের সময়, যখন তৌহিদের অনেক সমবয়সীরা টিকটকের ভিডিও দেখে সময় কাটাচ্ছিল, তিনি তখন ওয়েব ডেভেলপমেন্ট শেখার সিদ্ধান্ত নেন। বিভিন্ন প্রোগ্রামিং ভাষার ওপর দক্ষতা অর্জনের পর, আপওয়ার্ক ও ফাইভারের মতো অনলাইন মার্কেটপ্লেসে ফ্রিল্যান্স ওয়েব ডেভেলপার হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি।

তবে ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজের অনিশ্চয়তা তাকে ভাবিয়ে তোলে। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন কাজ ও প্রকল্পের সন্ধানে থাকতে হয়, যা দীর্ঘমেয়াদে ক্লান্তিকর হতে পারে। স্থায়ী একটি চাকরির আশায় ছিলেন তৌহিদ। সৌভাগ্যবশত, আপওয়ার্কেই তার এক ক্লায়েন্ট—এক মার্কিন স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের সিইও—তাকে ফুল-টাইম রিমোট চাকরির প্রস্তাব দেন।

তৌহিদের মতো এ ধরনের রিমোট চাকরির প্রতি তরুণ বাংলাদেশি ডিজিটাল কর্মীদের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে।

বর্তমানে রিমোট জবের ক্ষেত্রও বেশ বিস্তৃত। ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, গ্রাফিক ডিজাইন, থ্রিডি ডিজাইন, প্রোডাক্ট ডিজাইন, ইউআই/ইউএক্স ডিজাইন, লেখালেখি, ভিডিও এডিটিং, ভার্চুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্সসহ আরও নানা ধরনের কাজ ঘরে বসেই করা সম্ভব।

পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকার কৌশল হিসেবে বিশ্বব্যাপী বিপুলসংখ্যক ফ্রিল্যান্সার নিয়োগ করে। এর অন্যতম কারণ হলো, নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে কাজের মজুরি তুলনামূলকভাবে কম, যা তাদের জন্য আর্থিকভাবে লাভজনক।

অন্যদিকে, এই সুবিধা কেবল নিয়োগদাতাদের জন্য নয়; নিম্ন আয়ের দেশের দক্ষ পেশাজীবীরাও উপকৃত হচ্ছেন। স্থানীয় চাকরির তুলনায় বিদেশি প্রতিষ্ঠানের রিমোট কাজ থেকে তারা অনেক বেশি পারিশ্রমিক পাচ্ছেন, যা তাদের আর্থিক স্বনির্ভরতা বাড়ানোর পাশাপাশি কর্মজীবনে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিচ্ছে।

রিমোট কাজের সুবিধা

রিমোট চাকরির সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এর কাজের ধরণ অনেক নমনীয়। যেহেতু বাসা থেকেই কাজ করা যায়, তাই নিজের আরামদায়ক পরিবেশে থেকে কাজ করা সম্ভব। প্রতিদিনের যাতায়াতের ঝামেলা, যানজট কিংবা ফর্মাল পোশাক পরার বাধ্যবাধকতা—এসব নিয়ে চিন্তা করতে হয় না।

বেশিরভাগ রিমোট চাকরির ক্ষেত্রে কাজটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ করা হলেই হয়, সকাল বা রাতে কাজ করাটা ব্যক্তির ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত প্রোগ্রামার সৈয়দ সাদমান সাব্বির বলেন, ‘প্রত্যেকেরই কাজের জন্য সবচেয়ে উৎপাদনশীল একটি সময় থাকে। কারও জন্য তা সকালে, আবার কারও জন্য বিকেলে। রিমোট চাকরির ফ্লেক্সিবিলিটির কারণে যে কেউ তার সেরা সময়টাতে কাজ করতে পারে, যা উৎপাদনশীলতা বাড়ায়’।

এছাড়া পরিবারের সঙ্গে বেশি সময় কাটানোর সুযোগ রিমোট চাকরির আরেকটি বড় সুবিধা। যাতায়াতের ঝামেলা না থাকায় পরিবারের জন্য বাড়তি সময় বের করা যায়, পাশাপাশি পরিবহণ খরচও বাঁচে।

রিমোট চাকরি বিশ্বব্যাপী কাজের সুযোগ এনে দেয়। কেউ শহরে থাকুক বা প্রত্যন্ত গ্রামে, ইন্টারনেট সংযোগ থাকলেই বিশ্বের যেকোনো প্রতিষ্ঠানের হয়ে কাজ করা সম্ভব।

‘রিমোট চাকরিতে স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের তুলনায় সাধারণত বেশি পারিশ্রমিক দেওয়া হয়,’ বলেন সাদমান।

তৌহিদের মতে, ব্যক্তিগত পছন্দ অনুযায়ী ওয়ার্কস্পেস তৈরির সুবিধাও রিমোট চাকরির আরেকটি বাড়তি পাওনা।

তিনি বলেন, ‘আপনার স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে মানানসই একটি কর্মপরিবেশ তৈরি করলে উৎপাদনশীলতা ও দক্ষতা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়তে পারে—যা অফিসের নির্ধারিত কর্মপরিবেশে অনেক সময় পাওয়া যায় না’।

রিমোট চাকরির সীমাবদ্ধতা

রিমোট চাকরিতে অফিসের দলবদ্ধ কাজের অভিজ্ঞতা ও সহকর্মীদের সঙ্গে সরাসরি মিথস্ক্রিয়ার সুযোগ কম থাকে—যা অনেকের জন্য বিরক্তিকর বা একঘেয়ে লাগতে পারে। সহকর্মীদের সঙ্গে দৈনন্দিন আলোচনা ও আড্ডা যেমন কাজে গতি আনে, তেমনি দক্ষতা বাড়াতেও সাহায্য করে।

‘সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ কেবল স্কিল ডেভেলপমেন্টের জন্যই নয়, অনেক সময় নতুন নতুন আইডিয়া তৈরিতেও সহায়ক,’ বলেন সাদমান।

আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো সময়ের ব্যবধান। বাংলাদেশের অনেক রিমোট কর্মী এমন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করেন, যার সময় অঞ্চল দেশের তুলনায় অনেকটা পিছিয়ে। যেমন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সময়ের পার্থক্য প্রায় ১২ ঘণ্টা। ইউরোপের ক্ষেত্রেও একই রকমের পার্থক্য রয়েছে, তবে তা কিছুটা কম। ফলে অনেক সময় সারারাত জেগে কাজ করতে হতে পারে, যা অনেকের জন্য কষ্টকর।

প্রতিযোগিতাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সাদমান জানান, স্থানীয় চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতা শুধু দেশীয় কর্মীদের সঙ্গে হয়, কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে গেলে প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়ান বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দক্ষ পেশাজীবীরা।

আন্তর্জাতিক বাজারের এই কঠিন প্রতিযোগিতার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, নতুন দক্ষতা শেখা এবং আপডেট থাকা জরুরি, নইলে টিকে থাকা কঠিন হয়ে যায়।

কী কী দক্ষতা দরকার?

তৌহিদ বলেন, ‘প্রথমেই এমন একটি কাজ খুঁজতে হবে, যা আপনি করতে পছন্দ করেন এবং যেটি অনলাইনে করা সম্ভব। গ্রাফিক ডিজাইন, কনটেন্ট রাইটিং বা সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট—যে বিষয়েই আগ্রহ থাকুক, সেটি শিখুন এবং নিজের কাজের একটি পোর্টফোলিও তৈরি করুন।’

সাদমানের মতে, লিংকডইনে সক্রিয় থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ‘জব ডিসক্রিপশন বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, বাজারে কী ধরনের দক্ষতার চাহিদা আছে এবং কোন স্কিল ট্রেন্ডিংয়ে রয়েছে,’ বলেন তিনি। পাশাপাশি, এই প্ল্যাটফর্ম একই পেশার পেশাজীবীদের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরিরও ভালো মাধ্যম।

যোগাযোগ দক্ষতা রিমোট কাজের জন্য অপরিহার্য একটি ‘সফট স্কিল’। তৌহিদের ভাষ্যে, ‘আপনাকে নিয়োগদাতা ও টিমের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে। কখনো কখনো ঘণ্টার পর ঘণ্টা জুম মিটিংয়েও বসতে হতে পারে। তাই লিখিত ও মৌখিক যোগাযোগে দক্ষতা অর্জন করা জরুরি।’

সাদমানের মতে, ইংরেজিতে সাবলীল না হলে অনেক সুযোগ হাতছাড়া হতে পারে। যদি ভালোভাবে ইংরেজিতে যোগাযোগ করতে না পারেন, তাহলে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা করা কঠিন হয়ে যাবে,’যোগ করেন তিনি।

কীভাবে পাওয়া যাবে রিমোট চাকরি?

একটি সুগঠিত পোর্টফোলিও তৈরি করা, সঙ্গে একটি আকর্ষণীয় সিভি ও কাভার লেটার সংযুক্ত করা—রিমোট চাকরির খোঁজ শুরু করার প্রথম ধাপ।

‘প্রথমে ফ্রিল্যান্স মার্কেটপ্লেসে গিয়ে কিছু অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করুন। এখান থেকে ভালো কাজ করলে অনেক সময় ক্লায়েন্টই স্থায়ী চাকরির প্রস্তাব দিতে পারে, যেমনটা আমার ক্ষেত্রে হয়েছে,’ বলেন তৌহিদ।

তিনি আরও বলেন, ‘লিংকডইন, গ্লাসডোর, উই ওয়ার্ক রিমোটলি-এর মতো ওয়েবসাইটেও নিয়মিত সক্রিয় থাকলে ভালো সুযোগ পাওয়া যায়। রিমোট চাকরির জন্য অনলাইনে অসংখ্য মাধ্যম রয়েছে।’

তৌহিদের মতে, রিমোট ক্যারিয়ারের শুরুতে ইন্টার্নশিপ নেওয়াটাও দারুণ একটি কৌশল। তিনি বলেন, ‘ইন্টার্নশিপ হয়ত ফুলটাইম চাকরির মতো বেশি পারিশ্রমিক দেয় না, তবে এটি অভিজ্ঞতা অর্জন ও পোর্টফোলিও তৈরির সময় করে দেয়’।

ভাবনা-চিন্তা করে এগোন

রিমোট চাকরির মাধ্যমে তৌহিদের জীবনে বড় পরিবর্তন এসেছে। কয়েক বছর আগেও যে-সব জিনিস কেনার কথা কল্পনাতেও আসেনি, এখন সেগুলো নিজের জন্য কিনতে পারেন। পরিবারকেও আর্থিকভাবে বড়সড় সহায়তা করেছেন তিনি। এমনকি নিজের এক জটিল অসুস্থতার চিকিৎসার সম্পূর্ণ ব্যয়ও বহন করেছেন নিজের উপার্জন থেকে।

তৌহিদের গল্প শুনে অনলাইনে কাজের প্রতি আগ্রহ জন্মানো স্বাভাবিক। তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘অনলাইন মার্কেটপ্লেসে নামার আগে নিশ্চিত করুন যে প্রয়োজনীয় দক্ষতা যথেষ্ট ভালোভাবে রপ্ত করা হয়েছে।’

অনেক কোচিং সেন্টার ও অনলাইন প্ল্যাটফর্ম আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন দেয়—’তিন মাসেই হাজার ডলার আয় করুন’ কিংবা ‘এক কোর্সই যথেষ্ট’। তবে সাদমান পরামর্শ দেন, এসব লোভনীয় বিজ্ঞাপন এড়িয়ে চলার জন্য।

তিনি বলেন, ‘টাকার কথা না ভেবে বরং এমন কিছু শিখুন, যা আপনার ভালো লাগে। যে দক্ষতার প্রতি সত্যিই আগ্রহ বোধ করেন, সেটির দিকেই এগিয়ে যান।’

সাদমান আরও বলেন, ‘এটি দীর্ঘমেয়াদি পথচলা, আর এতে টিকে থাকতে হলে আগ্রহ ধরে রাখা জরুরি। শুধু বেশি আয় হবে ভেবে কোনো দক্ষতা শেখার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে একটু গবেষণা করুন। দেখুন, সেটি আপনার আগ্রহের সঙ্গে মেলে কি না।’

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com