মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল ২০২৫, ০১:২৭ পূর্বাহ্ন

দেশে ইউনেস্কোর স্বীকৃত ৩ ঐতিহ্য

  • আপডেট সময় সোমবার, ২১ এপ্রিল, ২০২৫

প্রতি বছর ১৮ এপ্রিল পালন করা হয় বিশ্ব ঐতিহ্য দিবস। এদিন সারা বিশ্বের প্রায় সব ঐতিহ্যবাহী স্থানে নানা ধরনের অনুষ্ঠান হয় স্থানীয় কৃষ্টির কথা মাথায় রেখে।

এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অন মনুমেন্টস অ্যান্ড সাইটস বা আইসিওএমওএস। তারা ইউনেস্কোর (ইউনাইটেড নেশনস এডুকেশনাল সায়েন্টিফিক অ্যান্ড কালচারাল অর্গানাইজেশন) সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণে। একই সঙ্গে তার প্রচার ও প্রসারের কাজও তারা করে।

সারা বিশ্বে অনন্য ঐতিহ্যবাহী স্থান খুঁজে বার করে এই সংস্থা এবং তা রক্ষণাবেক্ষণে যথাসাধ্য চেষ্টা করে। বিশ্ব ঐতিহ্যস্থল, বাংলাদেশ ইউনেস্কো ২০০৯ সাল পর্যন্ত বিশ্বের প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রায় ৮৯০ টি অনন্য বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন স্থানকে বিশ্ব ঐতিহ্যস্থল হিসেবে ঘোষণা করেছে। এগুলোর মধ্যে ৬৮৯টি সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য, ১৭৬টি প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ও ২৫টি উভয় বৈশিষ্ট্য ধারণ করে।

ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটি বিশ্বের দেশগুলোকে পাঁচটি ভৌগোলিক অঞ্চলে ভাগ করেছে। এগুলো হলো- ১. আফ্রিকা ও আরব অঞ্চল (মধ্যপ্রাচ্য সহ) ২. এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল (অস্ট্রেলিয়া ও ওশেনিয়া এ অঞ্চলভুক্ত) ৩. ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা ৪. ল্যাটিন আমেরিকা ও ৫. ক্যারিবিয় অঞ্চল।

এছাড়া ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটির অনুমোদনক্রমে প্রতি বছরই নতুন নতুন ঐতিহ্য তালিকাভুক্ত হয়। আবার যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ না হলে ঘোষিত ঐতিহ্যস্থল তালিকা থেকে বাদ হয়ে যেতে পারে। ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটি বিশ্বের ২১টি দেশের প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত। কমিটি চার বছরের জন্য নির্বাচিত হয়। এ কমিটি পৃথিবীর নানা দেশে ছড়িয়ে থাকা ঐতিহ্যস্থলগুলোর ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম তদারক করে। ঘোষিত ঐতিহ্যগুলোকে ব্যবস্থাপনার জন্য ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ ফান্ড থেকে অর্থায়ন করা হয়।

অর্থায়নের এই সিদ্ধান্ত ১৯৭২ সালের ১৬ নভেম্বর ইউনেস্কোর বিশেষ সভায় গৃহীত হয়। এ পর্যন্ত বাংলাদেশসহ ১৮৬টি দেশ ‘কনসার্নিং দ্য প্রোটেকশন অব ওয়ার্ল্ড কালচারাল অ্যান্ড নেচারাল হেরিটেজ’ কনভেনশন এ স্বাক্ষর করেছে। ২০০৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের ৩টি স্থানকে বিশ্ব ঐতিহ্যস্থল হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এগুলো হলো নওগাঁর পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার, বাগেরহাটের মসজিদ শহর এবং সুন্দরবন।

পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার ও বাগেরহাট মসজিদ শহর বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যভুক্ত প্রত্নস্থল। অপরদিকে সুন্দরবন বিশ্ব প্রাকৃতিক ঐতিহ্যভুক্ত পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। পাহাড়পুর এ বৌদ্ধ বিহারের আরেক নাম সোমপুর মহাবিহার। এটি ১৯৮৫ সালে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষিত হয়। ১৮০৭-১২ সালে বুকানন হ্যামিল্টন সর্বপ্রথম এ প্রত্নক্ষেত্রটি চিহ্নিত করেন। প্রত্নতাত্ত্বিক আলেকজান্ডার কানিংহাম ১৮৭৯ সালে এ স্থান পরিদর্শন করে একে একটি হিন্দু মন্দির বলে উল্লেখ করেন।

প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন কাজ শুরু হয় ১৯২৩ সালে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া, বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটি ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এর যৌথ উদ্যোগে। ব্রিটিশ ভারত থেকে শুরু করে পাকিস্তান আমল এবং স্বাধীন বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে এ প্রত্নক্ষেত্রটিতে উৎখনন পরিচালিত হয়েছে। উৎখননের ফলে ২৭৪.১৫ মি ও ২৭৩.৭০ মি আয়তন বিশিষ্ট এক বৃহৎ বৌদ্ধবিহারের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। বিহারটিতে রয়েছে ১৭৭টি ভিক্ষু কক্ষ। প্রতিটি কক্ষের অভ্যন্তরীণ পরিমাপ ৪.২৬ মি দ্ধ ৪.১১ মি এবং কক্ষগুলোর সম্মুখভাগে রয়েছে ২.৪৩ থেকে ২.৭৪ মিটার টানা বারান্দা।

বিহার প্রাঙ্গণের মধ্যবর্তী স্থানে রয়েছে এক বৃহদাকৃতির সুউচ্চ কেন্দ্রীয় মন্দির। যেটির ধ্বংসাবশেষ এখনো ২১ মিটার উঁচু। ক্রুশাকৃতির এ মন্দির ২৭ বর্গমিটার স্থান জুড়ে বিস্তৃত। মন্দিরের প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে রয়েছে চারটি কক্ষ ও মন্ডপ। এছাড়াও রয়েছে প্রদক্ষিণ পথ। মন্দিরের প্রাচীরের অলঙ্করণে দুই হাজারেরও বেশি পোড়ামাটির ফলকচিত্রের ব্যবহার করা হয়েছিল।

এছাড়াও উৎখনন কাজের সময় আটশ’র বেশি ফলকচিত্র বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে। সোমপুর মহাবিহার, পাহাড়পুর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটি যে কয়টি মানদন্ডের ভিত্তিতে পাহাড়পুরকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে, তা হলো-এটি হিমালয়ের দক্ষিণে প্রাক-মুসলিম যুগের অনন্য এক স্থাপত্য কীর্তি।

দেশে ইউনেস্কোর স্বীকৃত ৩ ঐতিহ্য

প্রাচীন যুগের এ একক বৃহত্তম স্থাপত্য কমপ্লেক্স কেন্দ্রীয় মন্দিরের প্রস্তর ভাস্কর্য ও পাল যুগের পোড়ামাটির ফলকচিত্রের অলঙ্করণে ফুটে উঠেছে অসাধারণ নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গী। এর স্থাপত্যিক পরিকল্পনা প্রভাবিত করেছিল মিয়ানমারের পাগানের আনন্দ মন্দির এবং জাভার লর জঙ্গরাঙ্গ ও চন্ডী সিউয়ার মন্দির স্থাপত্য নকশাকে। আর এসব কারণেই এটি মানব সভ্যতার ইতিহাসে অন্যতম মাইলফলক স্থাপত্য নিদর্শন।

বাগেরহাট সুন্দরবনের উত্তর প্রান্তের জেলা বাগেরহাটে রয়েছে মধ্যযুগের মসজিদ শহর খলিফতাবাদের বিভিন্ন প্রত্ননিদর্শন। এগুলোর মধ্যে উল্লেযোগ্য হলো ষাটগম্বুজ মসজিদ, বিবি বেগনি মসজিদ, চুনাখোলা মসজিদ, জিন্দাপীর মসজিদ, নয়গম্বুজ মসজিদ, রেজাখোদা মসজিদ, রণবিজয়পুর মসজিদ, সাবেকডাঙ্গা নামাজঘর, সিঙরা মসজিদ, খান জাহানের বসতবাটি, খান জাহানের সমাধি সৌধ প্রভৃতি।

ষাটগম্বুজ মসজিদ

ষাটগম্বুজ মসজিদ খলিফতাবাদ শহরের সবচেয়ে বড় স্থাপত্য নিদর্শন। বাইরের দিক থেকে মসজিদের আয়তন উত্তর-দক্ষিণে ৪৮.৭৭ মিটার এবং পূর্ব-পশ্চিমে ৩২.৯২ মিটার। ভেতরের দিকে মসজিদটির পরিমাপ ৪৩.৮৯ মি ও ২৬.৮২ মি। মসজিদে প্রবেশের জন্য পূর্ব প্রাচীরে এগারটি এবং উত্তর দক্ষিণে সাতটি করে খিলান পথ রয়েছে। পশ্চিম প্রাচীরেও রয়েছে একটি খিলানপথ। মসজিদটির চারকোণায় রয়েছে চারটি কর্নার টাওয়ার। ভেতরের দিকে মসজিদটি ছয় সারি স্তম্ভ সহযোগে উত্তর-দক্ষিণে সাতটি আইল এবং পূর্ব-পশ্চিমে এগারটি ‘বে’ তে বিভক্ত। মসজিদটিতে রয়েছে দশটি মিহরাব। নামের দিক থেকে মসজিদটি ষাটগম্বুজ হলেও মসজিদে গম্বুজের সংখ্যা ৮১টি। ছাদে গম্বুজের সংখ্যা সাতাত্তরটি আর চার কোণের কর্নার টাওয়ারে গম্বুজের সংখ্যা চারটি। ষাটগম্বুজ মসজিদের স্থাপত্য পরিকল্পনায় দামেস্কের জামে মসজিদ (৭০৫-১৫ খ্রি.) ও বাংলার আদিনা মসজিদ (১৩৭৫ খ্রি.) এর প্রভাব রয়েছে।

পরবর্তী সময়ে মসজিদটির কেন্দ্রীয় নেভের উপরে চৌচালা ভল্ট রীতির নকশার ব্যবহার ছোট সোনা মসজিদ (১৪৯৩-১৫১৯ খ্রি.) ও লট্টন মসজিদ (ষোড়শ শতকের প্রথম দিকে) এ পরিলক্ষিত হয়। এছাড়া ষাটগম্বুজ মসজিদটি একাধারে প্রশাসনিক কেন্দ্র, মাদ্রাসা ও সমাবেশ স্থল হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। এই মসজিদটি খান জাহানের নান্দনিক স্থাপত্যশৈলীর সবচেয়ে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

বিবি বেগনি মসজিদ

ষাটগম্বুজ মসজিদের কাছেই রয়েছে বিশ্ব ঐতিহ্যভুক্ত একগম্বুজ বিশিষ্ট বিবি বেগনি মসজিদ। এর পরিমাপ বাইরের দিক থেকে ১৬.১৫ বর্গমিটার। মসজিদটির চার কোণে চারটি কর্নার টাওয়ার, পূর্ব প্রাচীরে তিনটি, উত্তর ও দক্ষিণ প্রাচীরে একটি করে খিলানাকৃতির প্রবেশ পথ রয়েছে। চুনাখোলা মসজিদটিও এক গম্বুজ বিশিষ্ট এবং পরিমাপ ১২.৪৯ বর্গমিটার। বিবি বেগনি মসজিদ থেকে ৫০০ মিটার উত্তরে এ মসজিদের অবস্থান। মসজিদটির চার কোণে চারটি কর্নার টাওয়ার রয়েছে। পূর্ব প্রাচীরে তিনটি এবং উত্তর ও দক্ষিণ প্রাচীরে একটি করে খিলান দরজার অস্তিত্ব চোখে পড়ে।

নয়গম্বুজ মসজিদ

ঠাকুরদিঘির পশ্চিম তীরে নয়গম্বুজ মসজিদের অবস্থান। বর্গাকৃতির মসজিদটির পরিমাপ ১৬.৭৬ বর্গমিটার (বাইরের মাপ)। চার কোণে রয়েছে কর্নার টাওয়ার। মসজিদের পূর্ব, দক্ষিণ ও উত্তর প্রাচীরে তিনটি করে প্রবেশ পথ রয়েছে। প্রতি সারিতে দুটি করে মোট দুই সারি পাথর নির্মিত স্তম্ভ দ্বারা মসজিদের অভ্যন্তরভাগ তিনটি আইল ও তিনটি ‘বে’ এ বিভক্ত। এভাবে নয়টি ‘বে’ এর সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিটি ‘বে’ গম্বুজ আবৃত। বাংলার মসজিদ স্থাপত্যে নয়গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ এক বিরল দৃষ্টান্ত।

জিন্দাপীর মসজিদ

জিন্দাপীর মসজিদটি বিশ্ব ঐতিহ্যভুক্ত হলেও এটি সরকার কর্তৃক সংরক্ষিত ঘোষিত হয়নি। এটি একগম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ। মসজিদটি বহুলাংশে ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ার পর প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক পুনঃনির্মিত হয়। মসজিদটির চার কোণায় চারটি কর্নার টাওয়ার রয়েছে। পূর্ব দিকে তিনটিসহ উত্তর ও দক্ষিণ দিকে একটি করে খিলানপথ রয়েছে। রেজাখোদা মসজিদটি জিন্দাপীর মসজিদ থেকে ২০০ মিটার পশ্চিমে অবস্থিত। মসজিদটির কিয়দংশ বর্তমানে টিকে আছে। সম্ভবত এটি ছয় গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ ছিল। ১২.১৭ বর্গমিটার আয়তনের রণবিজয়পুর মসজিদটি একগম্বুজ বিশিষ্ট। আলোচ্য মসজিদগুলোর মধ্যে এ মসজিদটির গম্বুজ সবচেয়ে বড়। কর্নার টাওয়ারগুলো অনান্য মসজিদের মতোই নির্দিষ্ট দূরত্বে ব্যান্ড অলঙ্করণ সমৃদ্ধ।

দেশে ইউনেস্কোর স্বীকৃত ৩ ঐতিহ্য

সাবেকডাঙ্গা নামাজঘর

সাবেকডাঙ্গা নামাজঘর ষাট গম্বুজ মসজিদ থেকে পাঁচ কিলোমিটার পূর্ব দিকে সাবেকডাঙ্গা গ্রামে অবস্থিত অবস্থিত। এটি বাংলায় টিকে থাকা একমাত্র প্রাচীনতম চৌচালা রীতির স্থাপত্য নিদর্শন। সিঙরা মসজিদটি ষাটগম্বুজ মসজিদ থেকে প্রায় ১৫০ মিটার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অবস্থিত। এক গম্বুজ বিশিষ্ট এ মসজিদটির আয়তন ১২.০৪ বর্গমিটার। খান জাহানের সমাধি সৌধটি বর্গাকৃতির এবং এক গম্বুজ বিশিষ্ট। এর সঙ্গে হযরত পান্ডুয়ার একলাখী সমাধি সৌধের মিল রয়েছে। ষাটগম্বুজ মসজিদের ৩০০ মি উত্তরে খান জাহানের বসত বাড়ির অবস্থান। এটি খনন কাজের প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।

স্থাপত্য নিদর্শন সমৃদ্ধ বাগেরহাট শহরটি প্রায় ছয়শ বছর পূর্বে পরবর্তী ইলিয়াসশাহী সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহ (১৪৩৬-১৪৫৯ খ্রি.) এর সমসাময়িক কালে ভৈরব নদীর তীরে সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে গড়ে তুলেছিলেন সেনাপতি উলুঘ খান জাহান (মৃত্যু ১৪৫৯ খ্রি.)। পরবর্তী সময়ে নাসিরুদ্দীন নুসরত শাহের আমলে (১৫১৯-১৫৩২ খ্রি.) এ শহরের পরিচয় পাওয়া যায় টাকশাল শহর হিসেবে। সুলতান গিয়াসউদ্দীন মাহমুদ শাহ ১৫৩৫ খ্রিস্টাব্দে শহরটির নতুন নামকরণ করেন খলিফতাবাদ-বদরপুর নামে।

ষোল শতকের পর্তুগিজ মানচিত্রেও শহরটির উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়। আঠারো শতক পর্যন্ত এই শহরের নাম ছিল হাওয়েলী খলিফতাবাদ। খান জাহানের বিস্তারিত পরিচয় সম্বন্ধে জানা না গেলেও তার তৈরি স্থাপত্যকর্মগুলো বিশেষ বৈশিষ্ট্যের পরিচয় বহন করে। স্থাপত্যকর্মগুলোর মিহরাব প্রাচীরের পোড়ামাটির অলঙ্করণ, অর্ধগোলাকৃতির গম্বুজ, চৌচালা নকশা, কর্নার টাওয়ার ইত্যাদি এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য দান করেছে যা ‘খান-ই-জাহান রীতি’ নামে পরিচিত। বাগেরহাটের স্থাপত্যকর্মগুলো মধ্যযুগের মুসলিম শহরের নিদর্শন। যেখানে রয়েছে মসজিদ, সমাধিসৌধ, দিঘি, আবাসগৃহ প্রভৃতি। এটা মধ্যযুগের টিকে থাকা একমাত্র স্থানীয় সরকারের প্রশাসনিক কেন্দ্র। এসব বিবেচনায় ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটি এই শহরকে ১৯৮৫ সালে বিশ্ব ঐতিহ্যভুক্ত করেছে।

পাহাড়পুর বিহার ও বাগেরহাট বিশ্ব ঐতিহ্যভুক্ত করার লক্ষে মনোনয়নের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরি হয় ১৯৭৩ সালে এবং এ সম্পর্কিত প্রবিধান গৃহীত হয় ১৯৮০ সালে ইউনেস্কোর ২১তম অধিবেশনে এবং ১৯৮৫ সালে বিশ্ব ঐতিহ্যস্থল হিসেবে ঘোষিত হয়। পরবর্তী সময়ে সংরক্ষণের লক্ষে পাহাড়পুরে ১৩.৬৬৯ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করা হয় এবং ১১৬০ বর্গমিটারের ওপরে জাদুঘর ও অফিস তৈরি করা হয়। বাগেরহাটে ৪.০৭ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করা হয় এবং ৯৯৪ বর্গমিটারের ওপর অফিস নির্মাণ করা হয়। পাহাড়পুর বিহার ও বাগেরহাটের প্রাচীন কীর্তিগুলো সংরক্ষণের জন্য ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রথম আন্তর্জাতিক প্রচারণা অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮৬ সালে দ্বিতীয়টি হয় ১৯৯০ সালে।

সুন্দরবন

বাংলাদেশের সুন্দরবন একমাত্র প্রাকৃতিক বিশ্ব ঐতিহ্য। এটা পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল। এর আয়তন প্রায় ৫৭৫৯ বর্গ কিলোমিটার। বাংলাদেশের সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট জেলা জুড়ে রয়েছে সুন্দরবন। সুন্দরবনে রয়েছে চারটি প্রশাসনিক রেঞ্জ। এগুলো হলো বুড়িগোয়ালিনি, খুলনা, চাঁদপাই ও শরণখোলা। এছাড়া ব্যবস্থাপনার সুবিধার্থে নয়টি ব্লক ও পঞ্চান্নটি কম্পার্টমেন্টে ভাগ করা হয়েছে সুন্দরবনকে। সুন্দরবনের প্রায় ৩২,৪০০ হেক্টর এলাকাকে অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। প্রায় ২০০টি দ্বীপের সমাহার এই বনের মধ্যে প্রায় ৪০০ নদী-নালা, খাল-বিল ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সুন্দরবনে রয়েছে নানা প্রজাতির বৃক্ষ। এগুলোর মধ্যে প্রধান হচ্ছে সুন্দরী ও গেওয়া। এছাড়াও রয়েছে গরান, কেওড়া, বাইন, পশুর প্রভৃতি বৃক্ষরাজি। অধিকাংশ বৃক্ষের রয়েছে উর্ধ্বমুখী শ্বাসমূল। ১৯০৩ সালে ডি. প্রেইন সুন্দরবনের বৃক্ষরাজির ওপর লিখিত গ্রন্থে ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদ লিপিবদ্ধ করেন।

পৃথিবীজুড়ে বর্তমানে এক হাজার একশো একুশটি এমন ঐতিহ্যবাহী স্থান চিহ্নিত করেছে ইউনেস্কো যার মধ্যে ৮৬৯টি স্থান হলো সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যবাহী যা মূলক মানুষের তৈরি, ২১৩টি প্রাকৃতিক স্থান ও ৩৯টি স্থান এই দুইয়ের প্রভাবই রয়েছে এমন। ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় রয়েছে ভারতের ৩৮টি জায়গাও। ১৯৮২ সালে বিশ্ব ঐতিহ্যকে ধরে রাখার ব্যাপারে সারা পৃথিবী একত্রিত হয়ে সিদ্ধান্তের পৌঁছানোর পরের বছর অর্থাৎ ১৯৮৩ সালেই ভারত থেকে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় জায়গা করে নেয় অজন্তার গুহা, ইলোরার গুহা, আগ্রার দুর্গ ও তাজমহল।

তারপরের বছর অর্থাৎ ১৯৮৪ সালে এই তালিকায় যোগ হয় ওড়িশার কোণার্কের সূর্যমন্দির ও তামিলনাড়ুর মহাবলীপুরম। এগুলি সবই মানুষের সৃষ্টি। প্রাকৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় তার পরের বছর স্থান হয় ভারতের। ১৯৮৫ সালে একই সঙ্গে যুক্ত হয় তিনটি জায়গা। বাংলাদেশের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী যানবাহন রিকশা ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে।

দক্ষিণ আফ্রিকার দেশ বতসোয়ানায় ইউনেস্কোর স্পর্শাতীত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যবিষয়ক আন্তরাষ্ট্রীয় কমিটির (ইন্টার গভর্নমেন্টাল কমিটি অন ইনট্যানজিবল হেরিটেজ) ১৮তম সভায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর আগে ২০০৮ সালে বাউলসংগীত, ২০১৩ সালে জামদানি শাড়ি ও ২০১৬ সালে মঙ্গল শোভাযাত্রা ইউনেস্কোর স্পর্শাতীত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়। ২০১৭ সালে বাংলাদেশের শীতল পাটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যের ঘোষণা দেয় জাতিসংঘের শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো। ‘ঢাকার রিকশা ও রিকশাচিত্রে’র আবেদনপত্রটি বাংলা একাডেমির মাধ্যমে ইউনেস্কোর কাছে জমা দেওয়া হয়। পরে সেটিও আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পায়। এখন আমাদের উচিৎ আর্ন্তজাতিকভাবে এগুলোর প্রচার ও প্রসার ঘটানো। যাতে পর্যটককে আকর্ষণ করতে পারে। তাহলে পর্যটকে মুখরিত হয়ে উঠবে দেশ। আমরা আজকের দিনে সে আশা করতে পারি।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com