ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উম্মে কুলসুমের অভাবের সংসার, খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছিল কোনোভাবে। এভাবে আর কতদিন, পরিবারের জন্য কিছু করার স্বপ্ন জাগে সপ্তম শ্রেণির এই কিশোরীর। বয়স চৌদ্দ হলেও, পাসপোর্টে ২৬ বছর দেখিয়ে ২০১৯ সালের এপ্রিলে একটি বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে পারি জমায় সুদূর সৌদি আরবে। গৃহকর্মীর কাজ করে সাত মাস নিয়মিতই টাকা পাঠায়; কিন্তু হঠাৎ পরিবারের সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায় সব ধরনের যোগাযোগ।
ছয় মাস পর একদিন ফোন করে কুলসুম জানায়, সে ভালো নেই, হাসপাতালে ভর্তি। মালিক মেরে তার হাত-পা ও কোমর ভেঙে দিয়েছে। অমানুষিক নির্যাতনে নষ্ট হয়ে গেছে একটি চোখও। এরপর তার সঙ্গে কী হয়েছে, শত চেষ্টা করেও জানা যায়নি। ২০২০ সালের ১০ আগস্ট পরিবারের কাছে খবর আসে- তাদের মেয়ে আর বেঁচে নেই। এক মাস পর কফিনবন্দি হয়ে দেশে ফেরে স্বপ্নবাজ সেই কিশোরী।
কুলসুমের মতো গত পাঁচ বছরে প্রবাস থেকে পাঁচ শতাধিক নারীকর্মীর মরদেহ দেশে এসেছে। বেশির ভাগ মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে সৌদি আরবে। অনেকের সনদে লেখা থাকে ‘আত্মহত্যা’, যার কোনো প্রমাণ দেওয়া হয় না। আবার শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনসহ প্রতারণার শিকার হয়েও অনেক নারী প্রায় প্রতিদিনই দেশে ফিরছেন। বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের তথ্য বলছে, ২০২০ সালে করোনা মহামারির মধ্যেও দেশে ফিরে এসেছেন ৫০ হাজার ৬১৯ নারীকর্মী, যার মধ্যে ২২ হাজারই সৌদিফেরত।
দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। প্রায় সোয়া কোটি বাংলাদেশি বিভিন্ন দেশে কর্মরত আছেন। আগে শুধু পুরুষরাই কাজের জন্য বিদেশে যেতেন; কিন্তু গত এক দশকে অনেক নারী শ্রমিকও দেশের বাইরে যাচ্ছেন। তবে যে স্বপ্ন নিয়ে আত্মীয়স্বজন ছেড়ে প্রবাসে পাড়ি জমাচ্ছেন নারীরা, তা খুব কম সময়ের ব্যবধানেই বালির বাঁধের মতো ভেঙে যাচ্ছে। মূলত, নারী গৃহকর্মীদের সৌদি আরবগামী বিমানে তুলে দেওয়ার পর শেষ পর্যন্ত তারা দেশটির কোথায় এবং কী কাজে যুক্ত হন, সে বিষয়ে আর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। নারীকর্মী পাঠানোর পুরো প্রক্রিয়াটি এককভাবে সৌদি আরবের নিয়ন্ত্রণে। তাই শিকার হতে হচ্ছে, নানান নির্যাতন-নিপীড়নের। বেশিরভাগ পরিবার-পরিজনের কথা ভেবে কাজ করে যাচ্ছেন মুখবুজেই। অনেকে আবার দেশে ফিরতে চেয়েও পারছেন না। নির্যাতনের শিকার হয়ে কেউ দূতাবাসের স্মরণাপন্ন হলে কিংবা ভুক্তভোগীদের স্বজনরা কোনো অভিযোগ করলেই কেবল সরকার এ বিষয়ে জানতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গৃহকর্মী নিয়োগের কথা বলে তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে যৌনকর্মী হিসেবে। তারা সেখানে গিয়ে কী কাজ করছেন, কেমন আছেন, তার দেখভালও করে না দূতাবাসগুলো। আর বিদেশে যাওয়ার জন্য পাসপোর্ট থেকে শুরু করে বিমানবন্দর, এমনকি বাংলাদেশ দূতাবাসের যে ভূমিকা, তা যেন সব সময়ই শত্রুপক্ষের মতো।
সচ্ছলতার বদলে ঋণের বোঝা : নারীরা তাদের আয়ের প্রায় পুরোটাই পাঠিয়ে দেন দেশে। ব্র্যাকের এক পর্যবেক্ষণ মতে, সে হারটা প্রায় ৭০-৮০ শতাংশ। রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের তথ্য মতে, করোনাকালে যে রেমিট্যান্স এসেছে, তার বেশিরভাগটাই নারী শ্রমিকদের মাধ্যমে, যা প্রায় ৬৯ শতাংশ। অথচ এই বিশাল অংশটিকে নিয়ে বলতে গেলে একেবারেই উদাসীন দায়িত্বশীলরা।
পরিসংখ্যান বলছে, বিদেশফেরত প্রায় ৩৫ শতাংশ নারীই শারীরিক বা যৌন নির্যাতনের মতো সহিংসতার শিকার এবং ৪৪ শতাংশ নারীকে ঠিকমতো বেতন দেওয়া হতো না। বর্তমানে প্রায় ১০ লাখের মতো বাংলাদেশি নারী প্রবাসে আছেন, যাদের বেশিরভাগের কপালে জুটছে নির্যাতন আর ঋণের বোঝা। তাদেরই একজন জানান, দেড় বছর ছিলেন সৌদি আরবে। তার মধ্যে পাঁচ মাসই কাটাতে হয়েছে পুলিশ হেফাজতে। যৌন প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় টানা তিন দিন খেতে দেওয়া হয়নি। একপর্যায়ে মেরে হাত ভেঙে বাসা থেকে বের করে দেওয়া হয়। গভীর রাতে বাসার সামনে পেয়ে পুলিশ তাকে থানায় নিয়ে যায়। পরে চিকিৎসা দেওয়ার পর সেখানকার এজেন্টের মাধ্যমে ওই বাড়িতেই ফিরে যেতে বাধ্য করা হয়। এরপর তো অত্যাচার আরও বেড়ে যায়। কয়েক মাস পর অবারও বাসা থেকে বের করে দিলে পুলিশ তাকে হেফাজতে নেয়। বাবা-মা সুদে টাকা ধার নিয়ে সৌদি আরবে পাঠিয়েছিলেন। তাই সব নির্যাতন, অত্যাচার সহ্য করেই কাজ করতেন টাকার জন্য; কিন্তু টাকা চাইলেই চালানো হতো অকথ্য নির্যাতন। এক বছর কাজ করলেও শেষ পর্যন্ত দুই মাসের বেতন দেওয়া হয়। সৌদি আরবে যাওয়ার আগে দালাল অবশ্য গোপন করেছিল, তাকে গৃহকর্মীর কাজে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সংস্থার সহযোগিতায়। কোনো টাকা তো আনতেই পারেনি বরং বাড়ি থেকে আরও লাখখানেক টাকা নিতে হয়েছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিসের (বিলস) গবেষণা উপ-পরিচালক মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, দেশে ফেরত আসা প্রতি তিন নারী শ্রমিকের মধ্যে একজনের অর্থনৈতিক অবস্থা আগের থেকে অবনতি হয়েছে এবং তাদের সিংহভাগই ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। ৮৫ শতাংশ তাদের বর্তমান কাজ নিয়ে হতাশাগ্রস্ত এবং ৫৭ শতাংশ তাদের জীবন ও জীবিকা নিয়ে চিন্তিত।’
সরকারের দায়িত্বশীলরা অবশ্য এ অভিযোগ মানতে নারাজ। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন বলেন, ‘যারা বিদেশে যাচ্ছেন তাদের অধিকাংশই নির্যাতিত হওয়ার বিষয়টি সঠিক না। গত ১০ বছরে অন্তত সাত থেকে আট লাখ নারী শ্রমিক বিদেশে গেছেন; কিন্তু তাদের কতজন নির্যাতিত হয়েছেন? তাছাড়া একটি নির্যাতনের ঘটনাও আমরা সহ্য করি না।’
তিনি আরও বলেন, ‘যারা নির্যাতিত হয়েছেন কেবল তাদের বিষয়টিই হাইলাইটস করলে নারী অভিবাসন বাড়ানো সম্ভব নয়, সফলতার বিষয়গুলোও সামনে আনতে হবে। এমনিতেই সামাজিক কারণে অন্যান্য দেশ বিবেচনায় বাংলাদেশের নারী অভিবাসন খুব কম।’
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্যানুসারে, করোনা মহামারির আগে প্রতি বছর গড়ে প্রায় এক লাখ নারীকর্মী বিদেশে যেতেন। করোনায় ২০২০ সালে সংখ্যাটা এক-চতুর্থাংশের নিচে নামলেও, এ বছর তা ফের স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। ২০২১ সালের মে পর্যন্ত প্রায় ২৮ হাজার ৮২৪ নারী কাজের জন্য বিভিন্ন দেশে গেছেন। বেশিরভাগ মধ্যপ্রাচ্যে গেলেও এ তালিকায় রয়েছে- মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং, সাইপ্রাস, ইতালি ও যুক্তরাজ্য। তবে গৃহকর্মী হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যাওয়া অনেকেরই কাজে সামান্য সমস্যা হলে, তাদের জীবনে নেমে আসে নির্মম শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। কখনো আবার অর্থের প্রলোভন কিংবা চুরির অভিযোগে জেলে পাঠানোর হুমকি দিয়ে বাধ্য করে অনৈতিক কাজে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব রিক্রুট এজেন্সির (বায়রা) মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান বলেন, ‘সরকারের উচিত নারীশ্রমিক নির্যাতন বন্ধে সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন তৈরি এবং সংশ্লিষ্ট দূতাবাসগুলোতে মাইগ্রেন্ট সার্ভিস সেন্টার (এমএসসি) গঠন করা, যাতে পুরো বিষয়টি একটা অনলাইন প্ল্যাটফর্মে চলে আসে। পাশাপাশি শ্রমিকরা যে কোনো অভিযোগ জানাতে পারেন। আর সেটি মনিটরিং করবে মন্ত্রণালয়।’
অভিযোগ সেল ও আইন : বিদেশ থেকে যাওয়া গৃহকর্মীদের নিরাপত্তার কোনো আইন নেই সৌদিতে। বরং দেশটির আইনে গৃহকর্মীর ওপর গৃহকর্তাকে বিশেষ অধিকার দেওয়া আছে। আর দেশের ২০১৩ সালের বৈদেশিক কর্মসংস্থানবিষয়ক আইনে কেবল দেশের রিক্রুটিং এজেন্টদেরই ধরা যায়, সৌদি আরবে নির্যাতনের কোনো প্রতিকার সম্ভব নয়। আইন অনুযায়ী, কেউ যদি প্রতারণার শিকার হন, শর্তভঙ্গ হয়, নির্যাতিত হন, তাহলে দায়িত্ব হলো রিক্রুটিং এজেন্সির। অন্যদিকে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোতে (বিএমইটি) একটি অভিযোগ সেল আছে। প্রবাসীকর্মীরা নির্যাতন বা প্রতারণার শিকার হলে, সেখানে অভিযোগ করতে পারেন।
সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা অবশ্য বলেন, ‘আমাদের যে আইন আছে, তাতে বিএমইটি হয়তো ক্ষতিপূরণ আদায় করে দিতে পারে; কিন্তু নির্যাতনের বিচার তো করতে পারে না।’
এ বিষয়ে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এবং বিএমইটির মহাপরিচালক শহিদুল আলম বলেন, ‘নারী অভিবাসীদের যতটা সম্ভব সাহায্যের চেষ্টা করি। সরকার তাদের সহায়তায় ৪২৭ কোটি টাকার একটি প্রকল্পও হাতে নিয়েছে। এর আওতায় এসব নারীকর্মীদের আর্থিক সহায়তাসহ পুনর্বাসন, আইনি পরামর্শসহ সব কিছু নিশ্চিত করা হবে।’
এ প্রসঙ্গে জাতীয় গার্হস্থ্য নারীশ্রমিক ইউনিয়নের উপদেষ্টা আবুল হোসেন বলেন, ‘বিদেশে নারীদের শারীরিক, মানসিক ও যৌন সহিংসতার সিংহভাগই ঘটে মধ্যপ্রাচ্যে। সরকারের উচিত এসব দেশকে আইএলওর (আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা) আইনানুযায়ী আচরণ করতে বাধ্য করা এবং ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের জন্য ক্ষতিপূরণ দাবি করা।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন সম্প্রতি বলেছিলেন, ‘সৌদিতে আমাদের প্রায় ৩ লাখ ২০ হাজার নারীশ্রমিক কাজ করছেন। তাদের মাত্র একভাগ নির্যাতনের শিকার হন। আমরা এগুলোও বন্ধে সোচ্চার রয়েছি। আমাদের মিশনগুলো কাজ করছে। আশা করছি, প্রবাসে আমাদের নারীশ্রমিক নির্যাতনের হার কমে শূন্যের কোটায় নেমে আসবে।’