শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৩১ অপরাহ্ন

দু’লক্ষ কোটি টাকার ব্যাঙ্কের কর্ণধার, কিন্তু আজও তিনি একশো দশ ভাগ খাঁটি বাঙালি

  • আপডেট সময় সোমবার, ২২ মে, ২০২৩

এই মুহূর্তে তিনি দেশের অন্যতম বৃহৎ বেসরকারি ব্যাঙ্কের কর্ণধার (Bandhan Bank)। যার মোট সম্পত্তির পরিমাণ ২ লক্ষ ১৭ হাজার কোটি টাকা! কতগুলো শূন্য হবে, ভাবতে পারেন? তবে দেশ তথা দুনিয়ার তাবড় ব্যাঙ্কের তুলনায় সংখ্যাটা বিশেষ চোখ কপালে তোলার মত নয়। বরং, চোখ সরু করে মেপে নেওয়ার মত। যোগ্য প্রতিযোগী বৈকি!

তিনি চন্দ্রশেখর ঘোষ (Chandra Shekhar Ghosh)। বন্ধন ব্যাঙ্কের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও। কার্যত তিনিই সেই ব্যাঙ্কের স্রষ্টা। শহরের এক পাঁচতারা হোটেলে ঘোষণা করেন নিজের ব্যাঙ্কের চতুর্থ ত্রৈমাসিকের হিসেবনিকেশ। পুরোদস্তুর বিজনেস স্যুটে। বাইরে পিচগলা রোদ্দুরে চল্লিশ ছুঁই ছুঁই আধপোড়া গরম। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কনফারেন্স রুমে সেসব বোঝার জো নেই। শীতল থেকে হিমশীতলের দিকে যাচ্ছে প্রায়। কিন্তু কলারটা একটু আলগা করে তিনি বলে ওঠেন, ‘এখানে এসিটা একটু বেশিই ঠাণ্ডা না?’

সাহেবি কেতাতেও একেবারে পুরোদস্তুর বাঙালি। বস্তুত, কর্পোরেট জগতে সম্ভবত তাঁর চেয়ে বেশি বাঙালি আর মিলবে না। সাংবাদিক সম্মেলনের শেষে দেওয়া বন্ধন ব্যাঙ্কের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতেও রয়েছে বাংলা অনুবাদ।

চন্দ্রশেখর ঘোষের ইতিবৃত্তে দেশকালের গণ্ডি মুছে যায়। জন্ম ত্রিপুরাতে। পড়াশোনায় মিশে গিয়েছে দুই বাংলা। ইস্কুলে যাওয়ার আগে বাবার মিষ্টির দোকানে কাজ করতেন। তাঁর শেকড় পূর্ববঙ্গে। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে রাশিবিজ্ঞান নিয়ে পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভাগ্য তাঁর প্রতি খুব একটা সদয় থাকেনি কোনওকালেই। আয় নামমাত্র ছিল, ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ জোগাড় করতে পারেননি, বেশি সুদে মহাজনের থেকে টাকা ধার নিতে হয়েছিল। তবু লড়ে গিয়েছেন দাঁতে দাঁত চেপে। শূন্য থেকে শুরু করেছিলেন। সাইকেলে করে ঘুরে ঘুরে মানুষের কাছে নিজের ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পের কথা নিয়ে গিয়েছেন। যাদের অধিকাংশই দরিদ্র ও গ্রামেগঞ্জে বসবাস করেন। ‘বন্ধন’ শুরু ওইভাবেই। পাশে ছিলেন স্ত্রী নীলিমা।

chandra shekhar ghosh
আজও তাঁর সবচেয়ে বড় সম্পদ তাঁর গ্রাহকরাই

আজ সাফল্যের এই শীর্ষে দাঁড়িয়েও তাঁর কথা বারবার ফিরে যায় ওই গ্রামীণ সমাজের দিকেই। সাংবাদিক সম্মেলনের শেষে একান্তে তাঁর মুখোমুখি হয়েছিল দ্য ওয়াল। প্রশ্ন করা হয়েছিল, গ্রামে গ্রামে ব্যাঙ্ক ব্যবস্থার সুফলকে পৌঁছে দিতে তো সত্তর আশির দশক থেকেই সচেষ্ট হয়েছিল ভারত সরকার। তৈরি হয়েছে আঞ্চলিক গ্রামীণ ব্যাঙ্ক, তাদের শীর্ষে ‘নাবার্ড’ বা জাতীয় কৃষি ও গ্রামোন্নয়ন ব্যাঙ্ক। তারপরেও সরকারি ব্যাঙ্ককে ছাপিয়ে বেসরকারি ব্যাঙ্ক ‘বন্ধন’-এর এই সাফল্য কীভাবে?

শুনে হাসলেন চন্দ্রশেখর। তৃপ্তভাবে বললেন, ‘প্রথম হচ্ছে, মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করা। দ্বিতীয়ত, মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়া। অফিসে বসে থেকে সার্ভিস দেওয়া যায় না। এই দুটো ক্ষেত্রে মনে হয় মানুষ আমাদের গ্রহণ করেছে, অন্তত যে সকল নাম আপনি বললেন, তাদের সঙ্গেও আমাদের রেখেছে। এর জন্য আমরা কৃতজ্ঞ তাদের কাছে।’

২০১৫ সালে দেশের বহু তাবড় পুঁজিপতি গোষ্ঠীকে ছাপিয়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের লাইসেন্স আদায় করে নিয়েছিল ‘বন্ধন মাইক্রোফিনান্স’। দেশের প্রথম ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা, যারা এই সাফল্য পেল। কলকাতায় বন্ধন ব্যাঙ্কের উদ্বোধনে এসেছিলেন খোদ তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। তখন চন্দ্রশেখর ব্যাখ্যা করেছিলেন, ‘আমাদের ব্যাঙ্কে টাকা রেখে বেশি সুদ পাবেন মানুষ। আবার সেই টাকায় কিছুটা সস্তায় ধার পাবেন গ্রামের মানুষ।’ এখনও সেই কথাতেই অনড় তিনি। সাংবাদিকদের বললেন, ‘সারা দেশেই আমরা আরও বেশি প্রসারিত করব, যা যা শাখা আছে, তাকেও আরও সম্প্রসারিত করব। আমাদের হিস্ট্রিতেই আছে, গ্রামের মানুষের জন্য কাজ করা, সেটাকেই আরও বাড়িয়ে নিয়ে যাব।’

পাশাপাশি এই অর্থবর্ষে নতুন কিছু ব্যবসাতেও পা রাখছে বন্ধন ব্যাঙ্ক। যেমন বাণিজ্যিক গাড়ি, সম্পত্তিতে ঋণ এবং সরকারের ব্যবসা। এখন বৈদ্যুতিন লেনদেনের যুগ। ইউপিআই এসে ছবিটাই পালটে দিয়েছে। চন্দ্রশেখর জানালেন, স্রেফ ইউপিআইতেই লেনদেন হয়েছে ৫৩ কোটি। গ্রাহকদের এই আগ্রহ দেখেই তাঁরা তাঁদের ব্যাঙ্কের নীতি ঠিক করেন।

chandra shekhar ghosh
বন্ধন ব্যাঙ্কের ‘ট্যাগলাইন’, আপনার ভাল, সবার ভাল

এক সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন, বাংলার জন্য নির্দিষ্ট কিছু পরিকল্পনা বা নীতি কি রয়েছে আপনার? চন্দ্রশেখর বললেন, ‘ব্যাঙ্ক হিসেবে তো আমরা সারা দেশেই কাজ করি, এটা একটা প্যান ইন্ডিয়া ব্যাঙ্ক। তো, যখন নীতি ঠিক করা হয়, তখন সারা দেশের কথা ভেবেই হয়। তবে যেহেতু এই রাজ্যেই আমাদের জন্ম, ফলে স্বাভাবিকভাবেই এই রাজ্যে আমাদের ব্যবসা অনেক বেশি প্রসারিত হয়েছে।’

তবু এটা তো সত্যি যে, স্বাধীনতার পরে এই প্রথম তো কোনও ব্যাঙ্ক খুলল পূর্ব ভারত থেকে। কলকাতা থেকে। এককালে দেশের ব্যাঙ্কিং ঠিকানাও ছিল কলকাতা। সেই নবাবি আমলে জগৎশেঠদের ব্যবসা বা উনিশ শতকে ‘ব্যাঙ্ক অফ বেঙ্গল’—কলকাতাই ছিল বাণিজ্যের রাজধানী। ১৯২১ সালে এখানেই তৈরি হয় ‘ইম্পিরিয়াল ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া’। স্বাধীনতার পরে তারই নতুন নাম হয় ‘স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া’। কিন্তু আজ তার সদর দপ্তর সরে গিয়েছে মুম্বইতে। দেশের সমস্ত সরকারি ব্যাঙ্কই মুম্বই বা দিল্লি-কেন্দ্রিক। কলকাতায় আছে শুধু ইউকো ব্যাঙ্কের সদর।

ফলে আলাদা করে চন্দ্রশেখরকে আবার প্রশ্নটা করা গেল, দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী যেখানে মুম্বই, সেখানে কলকাতা থেকে এত বড়, এত সফল ব্যাঙ্ক চালানো কতটা সুবিধের? ৬২ বছরের সফল উদ্যোগপতি বললেন, ‘করোনার পরে কিন্তু এই প্রশ্নটার উত্তর আর দিতে হয় না। কারণ মানুষ ঘরে বসে এখন সারা পৃথিবীর ব্যবসা করছে। আমি যদি কলকাতায় বসে সারা ভারতবর্ষে ব্যবসা করি, সেটা অস্বাভাবিক কেন হবে? আমি তো খুব গর্ববোধ করি যে, আমি এখানে বসে এত কিছু করতে পারছি’।

chandra shekhar ghosh
কলকাতায় বন্ধন ব্যাঙ্কের সূচনায় তৎকালীন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি এবং রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র

এত কিছু করছেন, কিন্তু আজও একেবারে মাটির কাছাকাছি রয়েছেন তিনি। সাংবাদিক সম্মেলনের শেষে পোড়খাওয়া সাংবাদিকরা ঘিরে ধরলেন তাঁকে। হাজারও প্রশ্ন বাকি। রীতিমতো খাতা পেন নিয়ে হিসেব করতে বসলেন তাঁরা। সানন্দে তাঁদের সঙ্গে একটা টেবিলে বসে পড়লেন চন্দ্রশেখর। পাশে ডেকে নিলেন বন্ধন ব্যাঙ্কের ‘চিফ ফিনান্সিয়াল অফিসার’ সুনীল সামদানিকে। শুরু হল ধৈর্য ধরে সব প্রশ্নের খুঁটিনাটি জবাব। জবাবের মাঝেই একেবারে সরল বাংলায় বোঝাচ্ছিলেন অর্থনীতির নানা জটিল শব্দ। সবটাই চলছে বাংলায়, মাঝেমধ্যে ইংরেজি। ক্ষেত্রবিশেষে পরিচিত সাংবাদিকদের সঙ্গে হাসিঠাট্টাও করছেন। এত গুরুগম্ভীর পরিবেশে এই দৃশ্য দেখে মনে হবে, যেন বসেছে বাঙালির চিরকালের সেই কফিহাউসের আড্ডা।

দ্য ওয়ালের তরফে প্রশ্ন করা হয়েছিল, মার্কিন শীর্ষ ব্যাঙ্ক ‘ফেডারেল রিজার্ভ’ বা ‘ফেড’ যেভাবে বেঞ্চমার্ক ওভারনাইট ইন্টারেস্ট রেট বাড়াচ্ছে বা ভারতেও গত দুই বছরে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক রেপো রেট বাড়িয়েছে। মুদ্রাস্ফীতির সংকোচনই প্রাথমিক লক্ষ্য। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধ এখনও চলছে, আমদানি-রফতানিতেও অস্থিরতা রয়েছে। ব্যাঙ্কের জন্য কতটা সুখবর বা খারাপ খবর? চন্দ্রশেখর জবাবে বেশ আশার কথা শোনালেন। বললেন, ‘আমাদের মুদ্রাস্ফীতি এখন যে স্তরে রয়েছে, অনেকটাই কিন্তু আশানুরূপের চাইতে কমে গিয়েছে। তো, আমার মনে হয় না যে, জিওপলিটিক্যাল পরিস্থিতি পুরোপুরি প্রভাব ফেলবে। ভারত এত বড় দেশ, ফলে বিশ্বরাজনীতিতে প্রভাব তো সবসময়েই থাকে। আমাদেরও নজর রাখতে হয়। কিন্তু আদতে সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের সিদ্ধান্ত মনে হয় আমাদের ভালর দিকেই যাবে।’

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com