সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ের আলোচিত স্বর্ণ ব্যবসায়ী আরাভ খান নিজেকে পরিচয় দেন বাংলাদেশি হিসেবে। কিন্তু কাগজে কলমে তিনি ভারতের বাসিন্দা।
পুলিশ বলছে, এই আরাভ খানের প্রকৃত নাম রবিউল ইসলাম। তিনি ঢাকার স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) পুলিশ ইন্সপেক্টর মামুন ইমরান খান হত্যা মামলার পলাতক আসামি। তার বাড়ি গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার আশুনিয়া গ্রামে।
জানা গেছে, ২০১৮ সালের ৮ জুলাই বনানীতে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন মামুন ইমরান খান। পরদিন তার মরদেহ গাজীপুরের উলুখোলার একটি জঙ্গলে নিয়ে পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ওই মামলার আসামি রবিউল ইসলাম ওরফে আরাভ খান সম্প্রতি আলোচনায় আসেন দুবাইয়ে “আরাভ জুয়েলার্স” নামে একটি গয়নার দোকান উদ্বোধন করে।
আরাভ তার গ্রামে একজন চোর-ছিনতাইকারী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। স্থানীয়রা বলছেন, আরাভ খান ওরফে রবিউল ইসলাম গ্রামে আসেন না। এ জন্য তারা তার সম্পর্কে বেশিকিছু জানেন না। তবে শুনেছেন, রবিউলের নামে ঢাকায় একটি হত্যা মামলাসহ একাধিক মামলা রয়েছে।
বুধবার (১৫ মার্চ) রবিউল ওরফে আরাভের গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলেছে ঢাকা ট্রিবিউন। তারা জানান, রবিউল ইসলাম আপন ওরফে সোহাগ ওরফে আরাভ খান সংযুক্ত আরব আমিরাতে একটি জুয়েলারি দোকানের মালিক এটি জেনে তারা বেশ অবাক হয়েছেন।
আরাভের ফেসবুক আইডি খোলা হয়েছে ২০২০ সালের এপ্রিলে। তার ফেসবুকে নিজের সম্পর্কে লেখা রয়েছে, তিনি ভারতের কলকাতার বাসিন্দা। থাকেন নিউইয়র্কের ব্রুকলিনে। পড়ালেখা করেছেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের কিংস কলেজে। তিনি আপন গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ এবং টাইমস অব বাংলাদেশের মালিক এবং আরভ জুয়েলার্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা।
গতকাল বুধবার তার জুয়েলারি শপের উদ্বোধন করা হয়। সেখানে বিশ্বখ্যাত ক্রিকেট তারকা ও বাংলাদেশের কয়েকজন সেলিব্রিটি উপস্থিত ছিলেন।
এ বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি আরাভ ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের একটি ভিডিও বার্তা ফেসবুকে শেয়ার করেন। ওই ভিডিওতে সাকিব আরভ জুয়েলার্সের উদ্বোধনে সবাইকে আমন্ত্রণ জানান। ভিডিওটি শেয়ার করার পর পুলিশের নজরে আসে। পরে পুলিশ খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, এই আরাভ খান হলেন পুলিশ হত্যা মামলার আসামি রবিউল ইসলাম।
বুধবার আরভ জুয়েলার্সের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, জনপ্রিয় লেখক সাদাত হোসেন, আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলম, চিত্রনায়িকা প্রার্থনা ফারদিন দীঘি, উপস্থাপক দেবাশীষ বিশ্বাস, গায়ক ইসরাত জাহান জুঁই, আরফিন আকাশ, মাইনুল আহসান নোবেল, জাহেদ পারভেজ পাবেল, বেলাল খান এবং রুবেল খন্দকার।
পুলিশ এমন একজন অপরাধীর অনুষ্ঠানে দেশিয় সেলিব্রেটিদের অংশগ্রহণকে ভালোভাবে দেখছে না। তারা বলছে, এটি দুঃখজনক। আমরা এ বিষয়ে আরও খোঁজ-খবর দিচ্ছি।
পুলিশ জানিয়েছে, ২০১৫ সালে মগবাজারে এবং ২০১৭ সালে গুলশানে- রবিউল ঢাকা পুলিশের হাতে অবৈধ অস্ত্রসহ দুইবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তবে তিনি জামিন পেয়ে যান। পরে তিনি ২০১৮ সালের ৮ জুলাই বনানীতে পুলিশ কর্মকর্তা মামুন ইমরান খান হত্যাকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন।
এই হত্যাকাণ্ড সংঘতিহ হওয়ার পরে গোপনে ভঅরতে চলে যান রবিউল ওরফে আরাভ খান। ২০২০ সালে পুলিশ ওই মামলার চার্জশিট জমা দেয়। তারপরে নিজেকে রবিউল ইসলাম দাবি করে একজন আদালতে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। পরে জানা যায়, আত্মসমর্পণকারী টাকার বিনিময়ে নিজেকে রবিউল দাবি করেছেন। আত্মসমর্পণকারী ব্যক্তির নাম আবু ইউসুফ লিমন। তিনি চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার বাসিন্দা। তিনি আদালতকে বলেন, তিনি রবিউল ইসলাম নন, প্রকৃত অভিযুক্ত ভারতে আছেন। তিনি ভুল করেছেন। পরে আদালত আবারও ডিবিকে অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন।
ডিএমপির গোয়েন্দা শাখার প্রধান হারুন অর রশিদ বলেন, “তখন আমরা তদন্ত করে দেখলাম যে আসলে এই ববিউল আসল রবিউল না। প্রকৃত রাবিউল অবৈধভাবে ভারতে চলে গেছেন। বুধবার দুবাইয়ে বড় স্বর্ণের দোকান উদ্বোধন করেন ওই ব্যক্তি। যে দোকানের লোগোতেই খরচ করা হয়েছে ৪১ কোটি টাকা।”
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, হত্যাকাণ্ডের পর রবিউল ভারতে চলে যান। সেখানে ২০২০ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি আসামে সাজেমা নাসরিন নামে এক নারীকে বিয়ে করেন। নাম পরিবর্তন করে নিজেকে আরভ খান নামে পরিচয় দেন।
কাবিননামা অনুযায়ী, আরাভ খানের বাবার নাম জাকির খান। তারা কলকাতার নরেন্দ্রপুরের কান্দারপোপুর এলাকার বাসিন্দা। বিয়ের বছরেই তিনি ভারতীয় পাসপোর্ট নেন। উড়াল দেন দুবাইতে। সেখানে ২০২১ সালের অক্টোবরে স্থানীয় এক বাসিন্দার সঙ্গে একটি কোম্পানি খোলেন।
রবিউল ওরফে আরাভ খান দুবাইতে নিজেকে বাংলাদেশি পরিচয় দেন। রবিউলের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, তাদের আধা-পাকা ঘরে তালা দেওয়া। বাড়ির আশপাশে তার আত্মীয়-স্বজনরা কাজ করছেন। তারা জানান, রবিউলের বাবা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। দুবাইয়ে বিলাসবহুল জীবনযাপন করলেও বাড়িতে তেমন উন্নতি করেননি।
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাজহারুল আলম পান্না বলেন, রবিউলের কথা গণমাধ্যম থেকে জেনেছি। আমি তার সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। তবে শুনেছি, তার বিরুদ্ধে ঢাকায় একাধিক মামলা রয়েছে।