শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৫:০৮ অপরাহ্ন
Uncategorized

দিল্লি ভ্রমণের অভিজ্ঞতা

  • আপডেট সময় সোমবার, ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২১

র্তুগালের লিসবন থেকে দুবাইয়ে ৩ দিনের সংক্ষিপ্ত ভ্রমন শেষে দেশে আসি জানুয়ারীর প্রথম সপ্তাহে। এসেই প্রথম কাজটি ছিল স্বপরিবারে ভারতীয় ভিসার আবেদন। আবেদনের সপ্তাহ খানেক পরে আমাদের তিন জনের ভিসা সহ পাসপোর্ট গ্রহণ করি কুমিল্লার ভারতীয় ভিসা আবেদন কেন্দ্র থেকে। সবার জন্য এক বছরের ভিসা আবেদন করলেও আমাকে মাত্র তিন মাসের এবং ওদের দুজনকে এক বছরের ভিসা দিয়েছে।

যদিও আমার প্রয়োজন ছিল এক বছরের মাল্টিপল ভিসা কারন আমাকে দ্বিতীয় বার যেতে হবে সেখানে। কিন্তু যাদের অন্য দেশের দীর্ঘ মেয়াদি ভিসা বা রেসিডেন্স পারমিট থাকে ভারত তাদের তিন মাসের ভিসা দেয় মাত্র। যা পেয়েছি তা দিয়ে আপাতত কাজ শুরু করে দিলাম। ছয় বছর পূর্বে কলকাতা, শিলিগুড়ি, দার্জিলিং এবং আগরতলা বেড়ানো হয়েছে। তাই এবার আগরতলা থেকে দিল্লি বিমানে যাতায়াতের পরিকল্পনা করি। আর ভিসা আবেদনের সময় কুমিল্লার বিবির বাজার হয়ে এন্ট্রি করবো বলে তা উল্লেখ করেছিলাম।

আমার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ ও হাতে পেতে মাস দুয়েক কেটে গেল। মার্চের ২ তারিখে আগরতলা থেকে দিল্লির টিকিট সংগ্রহ করি। ততদিনে করোনা ভাইরাস চীন থেকে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে ইউরোপ পৌঁছে গেছে। যদিও ৫ তারিখে আনুষ্ঠানিক ভাবে ভারতে এবং ৮ তারিখে বাংলাদেশে এই ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী সনাক্ত হয়েছে কিন্তু সীমান্ত এবং এয়ারপোর্টে তার অনেক আগ থেকেই এটির প্রতিরোধে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

মার্চ মাসের ২ তারিখে কুমিল্লার বিবির বাজার সীমান্ত দিয়ে ইন্ডিয়া প্রবেশের সময় তাদের ইমিগ্রেশন এ থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে শরীরের তাপমাত্রা পরিক্ষা করেছিল কিন্তু ৬ তারিখে দেশে ফিরার সময়ে বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন এ শুধুমাত্র মৌখিক দুয়েকটা প্রশ্ন করে করোনা ভাইরাস পরিক্ষা সমাপ্ত করেছে যা ভাইরাসটি প্রতিরোধে যথাযথ ব্যবস্থা বলে মনে হয়নি!

দুপুর ১২ঃ০৫ এর ফ্লাইটে দিল্লি রওনা দেওয়ার কথা। কিন্তু দুই দেশের ইমিগ্রেশন শেষ করতে কিছুটা সময় নষ্ট হয়ে যায়। একেক বর্ডারে ঘন্টা খানিক করে সময় নিল যা হয়তো মনোযোগ ও পেশাদারিত্বের সাথে সম্পূর্ণ করলে দশ থেকে পনের মিনিট করে লাগার কথা। সকাল ৭ টায় শুরু হয়ে প্রায় ৯ টায় সমাপ্ত হয় দুদেশের ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া। ইমিগ্রেশন অফিস থেকে বের হয়ে প্রাইভেট কার নিয়ে সীমান্তপুর থেকে সোজা আগরতলা এয়ারপোর্টে। দূরত্ব ৭৬ কিলোমিটার ভাড়া ১২ শ রুপি ও সময় প্রায় আড়াই ঘন্টা লেগেছে।

এয়ারপোর্টে পৌঁছাতে পৌঁছাতে চেকইন বন্ধ হয়ে যায়। বিষন্নতা গ্রাস করলো আমাকে ফ্লাইট মিস করবো কিনা ভেবে! চিন্তিত দেখে এগিয়ে এলেন এক কর্মকর্তা। সাথে পাঁচ বছরের বাচ্চা ও আমার স্ত্রী থাকাতে সহযোগিতা পেতে কিছুটা সহজ হলো। ঐ কর্মকর্তার অনুরোধে বোডিং পাস ইসু করে তারাতাড়ি ইমারজেন্সি সিকিউরিটি চেকইন পার করে দিল। অন্যথায় নিশ্চিত ভাবে আমাদের ফ্লাইট মিস হতো সেই দিন।

তাড়াহুড়ায় আঞ্চলিক এই বিমানবন্দরটি ভাল করে দেখা হয়নি কিন্তু যতটুকু মনে হয়েছে খুব ভাল ব্যবস্থাপনা রয়েছে এখানে। দিল্লির গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছিল অত্যাধুনিক সুযোগ সুবিধা সমৃদ্ধ আধুনিক একটি বিমানবন্দর। ব্যাংকক, কুয়ালালামপুর, দুবাই, আমস্টারডাম, রোম, প্যারিস, স্টকহোমে, মাদ্রিদ কিংবা লিসবন এয়ারপোর্টের অভিজ্ঞতা আছে আমার এবং এসব বিমানবন্দরের চেয়ে কোন অংশে কম মনে হয়নি দিল্লির গান্ধী বিমানবন্দরকে। যেমন পরিপাটি তেমন রয়েছে যাত্রী সেবায় আধুনিক সকল সুযোগ সুবিধা।

এয়ারপোর্ট থেকে বের হলে গন পরিবহন সহ সকল ধরনের পরিবহন সেবা সহজেই গ্রহণ করা যায়। আমরা মহিলা দ্বারা পরিচালিত একটি কার নিয়ে রওনা হলাম হোটেলের দিকে। পাহাড়গঞ্জ এলাকায় আগে থেকেই আমাদের হোটেল বুকিং দেওয়া ছিল। কার চালিকা মেয়েটি তার ওয়াইফাই চালু করে দিল ফলে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করে নিলাম ইন্টারনেট থেকে। ৪০/৪৫ মিনিটের সেই ভ্রমণে দিল্লি সম্পর্কে ভাল একটি অভিব্যক্তি তৈরি হল। বিশেষ করে সবাই অটোমেটিক ট্রাফিক সিগনাল মেনে গাড়ি চালাচ্ছেন এবং যানযট ও তেমন নেই।

দিল্লির ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, মেট্রোরেল, গন পরিবহন এবং ভাড়ায় চালিত অটো ও প্রাইভেট কার সবকিছুই নিদিষ্ট নিয়মমাফিক চলছে অত্যান্ত সুন্দর ভাবে। সড়কের যথাযথ স্বয়ংক্রিয় সিগন্যালের মাধ্যমে এবং তা মেনে যানবাহন গুলো চলাচল করছে। কোথাও কোন ব্যত্যয় ঘটছেনা। সময় ধরে মেট্রোরেল ও নিদিষ্ট রোডের নিদিষ্ট রং এবং নাম্বারের বাস চলছে। অটো (আমাদের দেশের সি এন জি) এবং প্রাইভেট কার চালকরা নিদিষ্ট পোশাক পরিধান সহ যাত্রী পরিবহনে সকল নিয়মকানুন মেনে চলছে। বিশেষ করে সিট বেল্ট বাধা ও অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন না করা অন্যতম।

ঢাকার সাথে তুলনা করলে দিল্লি ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা অনেক সুশৃঙ্খল ও গোছানো। সবকিছু তারা বিভিন্ন ইউরোপিয়ান শহরের আদলে গড়ে তুলেছেন। মুসলিমদের ঐতিহ্যঘেরা দিল্লি গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সড়কের নাম এখনো মুসলিম শাসকদের নামে রয়েছেন যা এক সময়ের উজ্জ্বল ইতিহাসের জানান দেয়। সদর বাজার, চাঁদনী চৌক এবং এর আশেপাশের গুটিকয়েক স্থান ছাড়া সমস্ত নয়া দিল্লিতে অনায়াসে যাতায়াত করতে পারবেন কোনরূপ যানযট বা যামেলা ছাড়াই।

দিল্লি তথা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে রয়েছে মুসলমানদের উত্থান-পতনের নানা কাহিনী। একটি প্রবাদ আছে ইন্ডিয়া দেখলে দুনিয়া দেখা হয় আর দিল্লি দেখলে ইন্ডিয়া দেখা হয়। সত্যি তাই, দিল্লির বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান, ইতিহাস ঐতিহ্য তাই বলে। লাল কেল্লা, কুতুব মিনার, ভারতীয় রাষ্টপতির ভবন, ইন্ডিয়া গেট এবং সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বেশকিছু মন্দির সহ দিল্লির পর্যটন আকষর্ণীয় স্থানে দুদিন ধরে ঘুরে বেড়ালাম। দিল্লির বেশীরভাগ দর্শনীয় স্থান এবং বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বকৃীত জায়গা সমূহ মুসলিম সম্রাজ্ঞ তথা মোগল সম্রাজ্ঞের ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে দাড়িয়ে রয়েছে।

বিশেষ করে কুতুব মিনার ও লাল কেল্লা যা ইতিমধ্যে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত। মুঘল সাম্রাজ্যের অন্যতম নিদর্শন দিল্লির রেড ফোর্ট বা লাল কেল্লা। অপূর্ব নির্মাণশৈলীর লাল রঙের বিশাল এ স্থাপনাটি ভারতের সমৃদ্ধ প্রাচীন স্থাপত্যকলার অন্যতম উদাহরণ। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসও জড়িত রয়েছে দিল্লির এ কেল্লার সাথে। লাল কেল্লা, সপ্তদশ শতাব্দীতে মুঘল সম্রাট শাহজাহান দিল্লিতে নির্মাণ করেছিলেন। এটা বিশাল প্রাচীর বিশিষ্ট একটি দুর্গ। জানা যায় ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত এই দুর্গটি ছিল মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনে। তারপর ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশরা এই দুর্গটিকে একটি সামরিক ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করেছিল।

কুতুব মিনার দিল্লীতে অবস্থিত ইসলামি নিদর্শনের আরেকটি স্তম্ভ বা মিনার, যা বিশ্বের সর্বোচ্চ ইটনির্মিত মিনার হিসেবেও পরিচিত। এটি কুতুব কমপ্লেক্সের মধ্যে অবস্থিত। কথিত আছে প্রাচীন হিন্দু মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের পাথর দিযে কুতুব মিনার নির্মান করা হয়েছে। মিনারের আশে পাশে আরও বেশ কিছু প্রচীন এবং মধ্যযুগীয় স্থাপনা এবং ধ্বংসাবশেষ রয়েছে, যা একত্রে কুতুব কমপ্লেক্স হিসেবে পরিচিত। ইসলামিক স্থাপত্য এবং শিল্পকৌশলের নিদর্শন হিসাবে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের মর্যাদা লাভ করে স্থানটি। এটি দিল্লীর অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন আকর্ষনীয় স্থান।

সাম্প্রতিক সময়ের দিল্লিতে ঘঠে যাওয়া হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার কোন প্রভাব শহরে লক্ষ করা যায়নি। সবকিছু খুবই স্বাভাবিক এখানে। ঘঠনাটি নিদিষ্ট যে এলাকায় সংগঠিত হয়েছে শুধুমাত্র সেখানেই এর কিছু প্রভাব রয়েছে বলে জেনেছি। যদিও পরিবার নিয়ে কিছুটা আতংকের মধ্যে দিল্লি ভ্রমনের সিন্ধান্ত নিয়েছিলাম ব্যক্তিগত বিশেষ কাজে। কিন্তু দিল্লি পৌছানোর দুই দিন পরে খবর আসলো আসল আতঙ্কের, মানে করোনা ভাইরাস! ৫ তারিখে প্রথম এখানে করোনা রোগী সনাক্ত করা হয়।

তুলনামূলক ভাবে দিল্লির চলাফেরা ও জীবন যাপনের ব্যয় স্বাভাবিক মনে হয়েছে। একটি প্রাইভেট কার সকাল ১০ টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত ৭/৮ টি পর্যটন আকর্ষনীয় স্থানে ঘুরে বেড়িয়েছেন এবং ভাড়া মাত্র ১৫শ রুপি যা সত্যিই অবিশ্বাস ছিল আমার কাছে। তাছাড়া দুপুর ও রাতের খাবার জন প্রতি দুই থেকে পাঁচ শত টাকার মধ্যে ভাল মানের খাবার পাওয়া যায়। পাহাড়গঞ্জের আরাগাছা রোডে ঢাকাই হোটেল নামে রেস্তোরাঁ রয়েছে যেখানে আরো সূলভ মূল্যে দেশীয় খাবার পাওয়া যায়।

আমার মূলত ভারত সফর ছিল পর্তুগালের পারিবারিক ভিসা আবেদন জমা দিতে যেহেতু ঢাকাতে এই সুবিধা নেই। আগে থেকেই পরিকল্পনা মাফিক সব গোছানো ছিল শুধুমাত্র ৪ তারিখে নিদিষ্ট সময়ে তা জমা দিয়ে আবার ঘুরতে বেড়িয়ে পড়লাম। এবার যাত্রা ছিল চাঁদনী চৌক মার্কেট যা দিল্লির এক ঐতিহাসিক মার্কেট। এখানে সল্প মধ্য ও উচ্চবর্গের বিভিন্ন পন্য পাওয়া যায়। বিশেষ করে কাপড়চোপড়, ইন্ডিয়ান শাড়ী, লেহেঙ্গা সহ সকল ধরনের বাহারি পন্য।

করোনা আতঙ্কে ৫ তারিখে আগ্রা ভ্রমন বাতিল করেছিলাম। দিল্লি থেকে কোলকাতা হয়ে আগরতলা দিয়ে আবার বাড়ী ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা করি। সন্ধ্যা ৬ টায় আগরতলা পৌছায় এবং সকাল অবধি এখানে কাটাতে হয়। স্থল বন্দর গুলোতে বিকাল ৫/৬ টায় ইমিগ্রেশন কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায় তা জানা ছিল না। সব সময় বিমান যাত্রা এবং এয়ারপোর্ট দিয়ে ইমিগ্রেশন ক্রস করার ফলে এই বিষয়টি অজানা ছিল। যার মাসুল হিসেবে আগরতলা একটি রাত্রি বিসর্জন দিতে হল।

পর্তুগাল প্রবাসী লেখক ও সাংবাদিক

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com