শনিবার, ০২ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৯:৩৩ অপরাহ্ন
Uncategorized

দার্জিলিং

  • আপডেট সময় শনিবার, ৩ এপ্রিল, ২০২১

দার্জিলিং আমার অত্যন্ত পছন্দের জায়গা। হঠাৎ করে ঘাড়ের উপর এসে পড়া এই প্যান্ডেমিকটা শেষ হবার পর প্রথম সুযোগ পেলেই যে জায়গাটাতে আমি চলে যেতে চাইব, সেটা হচ্ছে দার্জিলিং। সম্পূর্ণ অদেখা এই জায়গাটার প্রতি আকর্ষণ জেগেছিল সেই ছেলেবেলায়, যখন ‘সেরা সন্দেশ’-এ ফেলুদার প্রথম গল্প ‘ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি’ পড়ি। কোন এক সুনসান দুপুরে, আমার মা যখন সবার খাবার পাট চুকিয়ে সানন্দা পত্রিকাটায় চোখ বুলোচ্ছেন, মা’র পাশে উপুড় হয়ে বুকের নিচে বালিশ দিয়ে শুয়ে আমি তখন ফেলুদা পড়তে পড়তে কল্পনায় চলে গেছি অনেক দূর। ম্যালের বেঞ্চে বসে রোদ পোহাচ্ছি, অবজার্ভেটরি হিলে বৈকালিক ভ্রমণ করছি, পাইন বনের ভেতর ঘুরে বেড়াচ্ছি, কিংবা কিচ্ছু না করে হাঁ করে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখছি।

সত্যজিৎ রায়ের নিজের অত্যন্ত পছন্দের জায়গা ছিল দার্জিলিং। তাই সত্যজিতের লেখায় ঘুরে ফিরে দার্জিলিং এসেছে অনেকবার। এমনকি সিনেমাতেও। ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ সিনেমা দেখেনি, এবং দেখে একটিবার দার্জিলিং যাবার জন্য মন উতলা হয়নি, মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তাই যদিও ২০১০-এ প্রথমবার সেখানে বেড়াতে যাই, এই শৈল-শহরে আমার মানসিক ভ্রমণ শুরু হয়েছিল আরো অনেক আগেই। অনেকবার ভেবেছি দার্জিলিংয়ে বন্ধুবান্ধব নিয়ে একটা ট্যুর দেব। কিন্তু বিভিন্ন সময় অনেক জায়গায় ঘুরে ফিরে বেড়ালেও, দার্জিলিংয়ে কোন অদ্ভুত কারণে আমার যাওয়া হয়ে ওঠেনি। এখন বুঝতে পারি মহাজাগতিক ষড়যন্ত্রটা ছিল এই যে, প্রথম কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখবার অবর্ণনীয়, অপার্থিব আনন্দটা আমাকে ভাগ করে নিতে হবে অর্ধাঙ্গিনীর সাথে। টাইগার হিলের উপর ভোরের নরম আলোকরশ্মি যখন মেঘ কেটে দিয়ে হিমালয়ে আছড়ে পড়ছে, বহ্নি হতভম্বের মত বলে উঠছে ‘ও মাই গড!’ আর বাকরুদ্ধ আমি তখন দুটো কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখছি। একটি আমার সামনে মহা প্রতাপের সাথে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আরেকটা বহ্নির মন্ত্রমুগ্ধ চোখের তারায়।
টাইগার হিলে সূর্যোদয়ের পর অপরূপ কাঞ্চনজঙ্ঘা
টাইগার হিলে সূর্যোদয়ের পর অপরূপ কাঞ্চনজঙ্ঘা

ঘটনার শুরু ২০১০ সালে। প্রতি বছর কোথাও না কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয়। কক্সবাজার অনেকবার যাওয়া হয়েছে। সেন্ট মার্টিনেও যাওয়া হয়েছে। ইংরেজ রাজধানী কোলকাতা, মোগল রাজধানী দিল্লী, রাজপুত রাজধানী জয়পুর দেখা হয়ে গেছে। সে বছর ভাবলাম দার্জিলিং গেলে কেমন হয়? এতো হাজার হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিলাম আর ঘর-হতে-শুধু-দুই-পা-ফেলিয়া এই জায়গাটা এখনো দেখিনি কেন? দার্জিলিং অবশ্য মোটেও ঘর থেকে দু’ পা ফেললেই যাওয়া যায় না। তবে কিনা অন্য যেসব জায়গায় ঘুরেছি তার তূলনায় তো অনেক কাছে। আমার একটা ব্যাপার হলো, কোথাও বেড়াবার প্ল্যান মাথায় এলে যতদিন না সেখানে যাওয়া হচ্ছে ততদিন অস্থির লাগতে থাকে। সময় যত ঘনিয়ে আসে, অস্থিরতা তত বাড়ে। জানুয়ারি মাসে দার্জিলিং যাবার প্রস্তাবটা উত্থাপন করলাম বহ্নির কাছে। বহ্নি লাফিয়ে উঠল। বলল, চলো যাই। ছেলেবেলা থেকে আমার প্রবল দার্জিলিং প্রীতির কথা সে ভাল করেই জানে। ব্যাস, আমার বুকের ভেতর ধুকপুক শুরু হয়ে গেল। পেটের ভেতর চেনা সেই গুড়গুড় শুরু হয়ে গেল। সব দিক চিন্তা করে ঠিক করলাম নভেম্বরে যাব।

প্ল্যান মাফিক এরপর শুরু হয়ে গেল আমাদের রুটিন কাজকর্ম। যে কাজটা আমি আর বহ্নি সবসময় করে থাকি সেটা হলো, কোথাও যাবার আগে জায়গাটা সম্পর্কে ভালোমতো পড়াশোনা করা। এতে দু’টো সুবিধা হয়। প্রথমত, একটা জায়গার ইতিহাস জানা থাকলে জায়গাটার সাথে কানেক্ট করা যায়, অনেক কিছুর মানে বোঝা সহজ হয়, বেড়িয়েও আনন্দ পাওয়া যায় অনেক বেশি। দ্বিতীয়ত, হারিয়ে যাবার ভয় থাকে না, কোথাও ঠকে যাবার সম্ভাবনাটাও যায় কমে। কোন জায়গা নিয়ে সামান্য পড়ালেখাও অনেক সময় খুব কাজে দেয়। অপ্রাসঙ্গিক হলেও বলি, আগ্রার তাজমহল আমরা সবাই ঘুরতে যাই। কিন্তু ক’জন জানি যে মমতাজের আসল নাম ছিল আরজুমান্দ বানু বেগম? তাজমহলে হাঁটতে হাঁটতে হয়রান হয়ে যাওয়াটা খুব স্বাভাবিক। কেন হয়রান হই জানি কি? তাজমহলের পুরো জায়গাটার আয়তন এক লক্ষ সত্তর হাজার বর্গমিটার। ভাবা যায়? যেকোন জায়গা নিয়ে ইন্টারেনেটে ঘাঁটাঘাঁটি করার জন্য আমার কিছু পছন্দের ওয়েবসাইট আছে। একটা হচ্ছে ট্রিপ অ্যাডভাইজর (tripadvisor.com), আর একটা হচ্ছে উইকিপেডিয়া (wikipedia.com)। ট্রিপ অ্যাডভাইজরের ফোরামগুলো খুবই ভাল। এদের দার্জিলিং ফোরামে ঢুকে দেখা শুরু করলাম নভেম্বরে যেতে গেলে কী কী প্রিপারেশন আমাকে নিতে হবে। কী ধরণের জামাকাপড় নিতে হবে, কোন বিশেষ ওষুধ সাথে রাখতে হবে কি না, কোন্‌ রেস্টুরেন্টটা কোন্‌ ধরনের খাবারের জন্য ভালো, কী কী দেখবার আছে দার্জিলিং এ ইত্যাদি ইত্যাদি। তাছাড়া হোটেল বুকিংয়েরও ব্যাপার আছে। আমরা আর যাই হোক ব্যাকপ্যাকার না।

শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং যাবার রাস্তা, দূরে হাতছানি দিচ্ছে পাহাড়
শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং যাবার রাস্তা, দূরে হাতছানি দিচ্ছে পাহাড়

আমরা ঘুরতে পছন্দ করি রিল্যাক্স করার জন্য, অ্যাডভেঞ্চার করার জন্য না। যারা অ্যাডভেঞ্চার করার জন্য ঘোরে তাদেরকে আমি বিস্ময়মিশ্রিত শ্রদ্ধার চোখে দেখি। কিন্তু আমার নিজের সেই বয়স আর নেই। তাই কোথাও গেলে আগে থেকে হোটেল বুক করে যাওয়াটাকে দরকারি মনে করি। তবে যে সময়কার গল্প, তখন তো আর হোটেল বুকিংয়ের জন্য অমুক ডট কম, তমুক ডট কম ছিলনা, সরাসরি হোটেলের সাথেই যোগাযোগ করতে হতো। আমরা প্ল্যান করলাম কলকাতা যাব এয়ারে। সেখান থেকে বিখ্যাত কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসে চড়ে শিয়ালদা থেকে সোজা নিউ জলপাইগুড়ি। ভারতীয় ট্রেনের টিকিট কিভাবে কাটব এটা ভেবে ভেবে যখন হয়রান হচ্ছি, তখন এক কলিগ বলল, ঢাকা থেকেই ট্রেনের টিকিট কেটে ফেলোনা কেন? আমি অবাক হলাম। ঢাকা থেকেই কলকাতার ট্রেনের টিকিট কাটা যায়? কলিগ খোঁজ দিলেন এক ট্রাভেল এজেন্টের। গুলশান-১ শুটিং ক্লাবের উল্টোদিকের গলিতে ছোট্ট একটা অফিস। গেলাম একদিন সেখানে। টেবিলের অন্যপাশে ফর্সা করে নাদুস নুদুস চেহারার এক ভদ্রলোক চেয়ারে বসে আছেন। একগাল পান মুখে নিয়ে হাসিমুখে আমাকে বললেন, কি দরকার বলেন তাড়াতাড়ি। মাহফুজ ভাইয়ের সাথে সে-ই আমার প্রথম পরিচয়। তখনও কি জানি এই মাহফুজ ভাই-ই হয়ে উঠবেন আমার এবং আমার পরিচিত আরো অনেকের টিকিট মাস্টার?

দার্জিলিংয়ে ট্যুরিস্টদের ভিড়
দার্জিলিংয়ে ট্যুরিস্টদের ভিড়

মাহফুজ ভাই জানতে চাইলেন, কবে যেতে চাই কলকাতা থেকে দার্জিলিং। নভেম্বরে যেতে চাই শুনে হেসে ফেললেন। বললেন, এটা কি মাস বলেন? বললাম এপ্রিল। তিনি বললেন, নভেম্বরের ট্রেনের টিকিট তো এখনও ওপেন হয়নি। আমি বোকার মত তাকিয়ে থাকলাম। তিনি বুঝিয়ে দিলেন ব্যাপারটা। বললেন, কোন একটা নির্দিষ্ট তারিখের ইন্ডিয়ার ট্রেনের টিকিট সেই তারিখের দুই মাস আগে পাওয়া যায়। তার আগে টিকিট “ওপেন” হয় না, অর্থাৎ কাটার জন্য এভেইলেবল হয় না। বলেই তিনি আমাকে তার কম্পিউটারের মনিটরটা আমার দিকে ঘুরিয়ে দিলেন। বললেন, এই যে দেখুন, এটা ইন্ডিয়ান রেইলওয়ের ওয়েব সাইট। আপনি চাইলে নিজেই বাসা থেকে চেক করতে পারবেন সবকিছু। তিনি আমাকে বুঝিয়ে দিলেন কিভাবে এই ওয়েব সাইট থেকে দুটো স্টেশনের মধ্যবর্তী ট্রেন (Train Between Important Stations) দেখা যায়। কিভাবে ট্রেনের ক্লাস সিলেক্ট করতে হয়, কিভাবে ভাড়া দেখতে হয়।

আমি অবাক হয়ে মাহফুজ ভাইকে দেখছিলাম। মাত্র পাঁচ মিনিট হয়েছে তার সাথে আমার পরিচয়, অথচ এমনভাবে কথা বলছেন যেন কত দিনের চেনা! গল্পচ্ছলে জানলাম, তার এই কোম্পানি তিনি দিয়েছেন আশির দশকে। এই প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের একেবারে প্রথম দিককার ট্যুরিজম কোম্পানি। সেই থেকে মাহফুজ ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় শুরু। শুধু আমার না, আমার পরিচিত আরো অনেকের। কোন জায়গার প্লেন কিংবা ট্রেনের টিকেট কাটা দরকার? ধর মাহফুজ ভাইকে। কোন একটা ট্যুর প্ল্যান করা দরকার? ফোন দাও মাহফুজ ভাইকে। মাঝখান দিয়ে কিছুদিন যোগাযোগ কমে গিয়েছিল। অফিসের প্রয়োজনে কিছুদিন ছিলাম দেশের বাইরে। ফিরে এসে একদিন ফোন দিতেই দেখি অন্য একজন লোক ফোন ধরেছে। মাহফুজ ভাইয়ের কথা জিজ্ঞেস করায় তিনি জানালেন, মাহফুজ ভাই মারা গেছেন। ক্যান্সারে। আমি স্তব্ধ হয়ে থাকলাম। মনে পড়ে গেল তার সেই দুই আঙ্গুলে বড় সাইজের একটা পান গালে পুরে দিয়ে হাসি মুখে বলা, কি দরকার বলে ফেলেন তাড়াতাড়ি। এই হাসিমুখ টা আর দেখতে পারবনা কোনদিন।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

Like Us On Facebook

Facebook Pagelike Widget
© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com
%d bloggers like this: