শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:৪০ পূর্বাহ্ন

দার্জিলিংয়ের মনমুগ্ধকর অপরূপ সৌন্দর্য

  • আপডেট সময় সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪

চোখটা বন্ধ করে এবার ভাবুন, আপনি ছুটছেন পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ ধরে। আর মেঘ পাল্লা দিয়ে চলছে আপনার সাথে আর আপনি ছুটছেন প্রায় সাত হাজার ফুট উচ্চতার এক শহরের উদ্দেশ্যে। হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন বলছি দার্জিলিংয়ের কথা। হিমালয়ের কোল ঘেষে দাঁড়িয়ে থাকা ছবির মতো সুন্দর শহর দার্জিলিং।

মনকাড়া বা মনভোলা যাই বলি না কেন , দার্জিলিংয়ের মনমুগ্ধকর অপরূপ সৌন্দর্যর কথা শুধু কলমের সাহায্যে বুঝানোর সাধ্য আমার নেই। বলে নেওয়া ভাল যে, দার্জিলিং জেলা হল ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের জলপাইগুড়ি বিভাগের একটি জেলা। এটি রাজ্যের উত্তর অংশে অবস্থিত । দার্জিলিং জেলা মনোরম প্রকৃতির শৈলশহর ও চা এর জন্য বিখ্যাত।

দার্জিলিং এর বিখ্যাত ও সুপরিচিত ৩ টি জেলা হল , কালিম্পং, কারশিয়ং এবং শিলিগুড়ি। আমরা চেংরা বান্ধা পোর্ট দিয়ে ঢুকে শেয়ার গাড়িতে করে শিলিগুড়ি গেলাম। শিলিগুড়িতে আমরা রাত থেকে পরের দিন দার্জিলিং পথে রওনা দিব। পরের দিন শিলিগুড়িতে সকালে নাস্তা করে দার্জিলিং এর জন্য গাড়ি ঠিক করলাম। আমরা একটু নিজেদের মত জায়গায় থেমে দেখে যাব বলে গাড়ি রিজার্ভ করেছিলাম। তবে চাইলে শেয়ার গাড়িতেও কম খরচে অনায়াসে দার্জিলিং যাওয়া যায়। আমার সফরসঙ্গী এর আগে দার্জিলিং ভ্রমন করাতে গাড়ি ম্যানেজ করতে সময় লাগল না। শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং ৩ থকে ৪ ঘন্টার পথ। শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং এর পথ শুরু হতে না হতেই রাস্তার দুপাশে সবুজের সমারোহের দেখা পেলাম।

দু’পাশে চা বাগান আর মাঝপথ দিয়ে আমাদের গাড়ি চলছে। দার্জিলিং যাওয়ার পথের দৃশ্য কি যে অপরূপ সৌন্দর্যে ভরপুর তা নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবে না। প্রাকৃতিক দৃশ্য আমার ভ্রমনের আনন্দ বহুগুন বাড়িয়ে দিল। আমাদের গাড়ির ড্রাইভার দাদা ছিল নেপালি তবে বাংলা বোঝে ,বলতে পারে না হিন্দিতে কথা। এই পাহাড়ি লোকগুলো যে কতটা সহজ সরল তা তাদের আন্তরিকতার মধ্যেই বুঝা যায়। ড্রাইভার দাদা আমাদের পথের সব কিছুর সাথে পরিচিত করে দিচ্ছিলো আর বিখ্যাত সব জায়গা ও ব্যক্তিদের গল্প বলছিল। দাদা আসলে অনেক ভাল ও আন্তরিক মনের মানুষ। এখানার লোকেরা টুরিস্টদের বিনোদন দিতে কোন কার্পণ্য করেন না । আমাদের গাড়ি আঁকা বাঁকা পাহাড়ি পথ ধরে উপরে উঠছে আর আমি মুগ্ধ হয়ে শুধু দূরের ঐ নিস্তব্ধ নিরব মৌন পাহাড়ের সৌন্দর্য অবলোকন করছি। ঐ রূপের রানী পাহাড়গুলো যেন আমায় হাতছানি দিয়ে কোথায় হারিয়ে ফেলছে। তাইতো কবি সুনির্মল বসু বলেছিলেন,

পাহাড়ি রাস্তা চলায় অনেক রিস্ক কিন্ত এই পথের প্রত্যেক ড্রাইভাররা অত্যন্ত দক্ষ । পাহাড়ি মানুষগুলো পাহাড় কেটে কেটে রাস্তা – ঘরবাড়ি বানিয়েছেন, কিন্তু পাহাড়ের সৌন্দর্য যেন এতটুকুও নস্ট হয় নি। পাহাড়ি পথের কত দূর পর পর পথের পাশে বিশাল চা বাগান দেখে মন ভরে উঠল। এমন সময় আমার সফরসঙগী ,ড্রাইভার দাদার কে একটা চাবাগানের ঢাবিতে মানে চায়ের দোকানে দাড়াতে বললেন। আমরা একটা চা বাগানের পাশে দাড়ালাম । আমি সোজা ভিতরে গেলাম , সেখানে দেখলাম মম তৈরি হচ্ছে । আমরা তিনটা চা ও মম অর্ডার করলাম। এখানে বলে নিচ্ছি , এই পাহাড়ি এলাকাগুলিতে নারীরা কর্মঠ। নারীরাই বেশি রেস্টুরেন্ট পরিচালনা , দোকান পরিচালনা করেন। আমি ঐ দোকানের এক নারীর সাথে কথা বললাম । তিনি হিন্দিতে জানালেন দোকানের পাশের চা বাগানটার চা ই আমরা খাচ্ছি । শুনে চা খাওয়ার মজা যেন তিনগুন বেরে গেল। চা শেষ করে ঐ বাগানের চায়ের দুইটা প্যাকেট কিনে নিয়ে আমরা আবার দার্জিলিং এর পথে রওনা দিলাম।

আমাদের ট্যুরটা নভেম্বরে হওয়ায় পথে কম ঝরনার সাথে সাক্ষাত হলো। তবে আমার সফরসঙগী জুন মাসে এই পথে একটু পর পর ঝরনা দেখতে পেয়েছিল বলে জানালো। হঠাৎ করে শীত বেশি লাগতে শুরু করল। উপরে উঠছি আর মেঘ যেন আমাদের সাথে লুকোচুরি খেলছে। হাত বাড়ালে মেঘ ধরতে পাচ্ছি ,সব মিলিয়ে বার বার স্বপ্ন মনে হচ্ছে। আঁকাবাঁকা পথ আর পাহাড়ের বিশালতা কখনো অক্ষরে ফুটিয়ে তোলা যায় না। দু’চোখ যেদিকে যায় পাহাড় আর পাহাড় । আকাশ সমান উচ্চতা নিতেও কী মৌন -নীরব-গম্ভীর হয়ে আছে সে পরিবেশ তা না দেখলে বিশ্বাস করতাম না।

গাড়ি চলছে, আমরা দুপুরের খাবার দার্জিলিং এ পৌঁছানোর পর খাব। আমরা দার্জিলিং এর কাছাকাছি চলে আসছি, এমন সময় পথে একটা কাঁচা সবজি বাজার দেখে আমার সফরসঙ্গীর তাজা ফ্রেশ গাজর খেতে মন চাইল । তাই আমরা সেখানে নেমে পরলাম । ছোট বাজার কিন্ত সুন্দর সুন্দর ফ্রেশ সবজি সেখানে। মনে হচ্ছিল সব সবজি কিনে নিয়ে যাই , কিন্তু উপায় নাই । সেখান থেকে আমরা দার্জিলিং এর বাগানের সুমিষ্ট কমলা , গাজর, আর লাল মরিচ কিনেছিলাম। সত্যি বলতে এখানে আপনারা ভেজাল কিছু খুঁজে পাবেন না। এখানের মানুষ অত্যন্ত সহজ সরল ও আন্তরিক। সবসময় হাসিমুখে সব কথা বলবে আপনার সাথে।

দার্জিলিংয়ের অধিকাংশ নেপালী ভাষায় কথা বলে। তারা বাংলা বুঝে হিন্দিতে কথা বলে। বিট্রিশদেরও আগে দার্জিলিংয়ের একাংশ নেপাল শাসিতশ ছিল। সম্ভবত এখানে নেপালীদের পূর্বপুরুষদের বসবাস ছিল। অধিকাংশ মানুষ দেখতে হুবহু নেপালীদের মতো দেখতে। কথাও নেপালি ভাষায় বলে। জিঙাসা করলে বলে আমরা ভারতীয়।

আমরা দার্জিলিং এর কাছাকাছি চলে এসেছি। গাড়িতে বসে বসে দারজিলিংয়ের বাগানের সুমিষ্ট কমলা খাচ্ছি আর দার্জিলিং ফরেসট এর উঁচু উঁচু গাছ দেখছি।

ড্রাইভার দাদা বনের দিকে উঁচু পাইন গাছের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। এই পাইন গাছ ঘরবাড়ি রং এর পেইন্ট এর মূল উপাদান। দাদা বলল, এই বনের রাস্তাতে অনেক সময় হিংস্র পশুদের দেখা মেলে। আরও জানলাম দাদার কাছে, যাদের থাকার কোন ঘর নাই তারা বন বিভাগের প্রধানের নিকট আবেদন করলে জমিসহ ঘরবাড়ি করে দেয় বন বিভাগ। বিনিময়ে বনের গাছের সুরক্ষার দায়িতব পালন করেন গাড়ি করে যতই ওপরে উঠছি, ততই আবহাওয়া ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। একটু পর পর মনে হল দার্জিলিং বুঝি এসেই পড়েছে, সফরসঙগীকে জিজ্ঞেস করলাম আর কতক্ষণ, তিনি বললেন আরও দেড় ঘণ্টা। নতুন যারা দার্জিলিং আসে, তাদের অবস্থা এমনই হয়। এভাবে চার ঘণ্টার ভ্রমণ শেষে আমরা সত্যি সত্যিই দার্জিলিং এসে পৌঁছলাম। দার্জিলিং আমাদের বৃষ্টি ঝরিয়ে রোদ ঢেলে অভিবাদন জানাবে ভেবেছিলাম কিন্ত শীতের সময় যাওয়ার কারনে শীতের হিমেল হাওয়া শরীর কাপিয়ে অভিবাদন জানাল।

দার্জিলিং এর দর্শনীয় স্থান দেখা শুরু করব বিকেলে। সফরসঙ্গীর সাথে আগেই প্লান করেছি কোথায় কোথায় ঘুরব। দার্জিলিং জুড়ে ছোট বড় মিলিয়ে বেড়ানোর জন্য প্রায় ১৭টি আকর্ষণীয় স্থান রয়েছে। পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচুতে অবস্থিত রেলওয়ে স্টেশন রয়েছে এখানে। সমুদ্র-পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১০,০০০ ফুট উঁচু পাহাড়ের চূড়া থেকে অপূর্ব সুন্দর সূর্যোদয় দেখা যায় এখানে। পৃথিবীর বিখ্যাত প্রার্থনা-স্থান ঘুম মোনাস্ট্রি, ছবির মতো অপূর্ব সুন্দর স্মৃতিসৌধ বাতাসিয়া লুপ। বিলুপ্ত-প্রায় পাহাড়ি বাঘ স্নো লুপার্ড খ্যাত দার্জিলিং চিড়িয়াখানা,পাহাড়ে অভিযান শিক্ষাকেন্দ্র ‘হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইন্সটিটিউট’,এভারেস্ট বিজয়ী তেনজিং-রক- এর স্মৃতিস্তম্ভ, কেবল কারে করে প্রায় ১৬ কিলোমিটার এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে ভ্রমন।

দার্জিলিংয়ের প্রতিটি বাঁক যেন অষ্টাদশী তরুণীর নির্লিপ্ত চাহনি, শুধু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হবে আর তাকিয়ে শুধু ডুবে যেতে মন চাইবে। পাহাড়ের কথোপকথনের শব্দরাশি আর শত-সহস্র অভিমানী পাহাড়ি মুখশ্রীর আলিঙ্গন পাবেন দার্জিলিং জুড়ে। নিজেকে উজাড় করে রাখা এক প্রিয়তম প্রেমিক /প্রেমিকার অপর নাম দার্জিলিং।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com