ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে চলমান শ্রম ঘাটতি দূর করতে বিভিন্ন দেশের দক্ষ ও প্রতিভাবানদের কাছে টানতে চায় ইউরোপীয় কমিশন। এজন্য নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। এ উদ্যোগের সুফল নেওয়ার সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশিদেরও।
এ উদ্যোগগুলোর মধ্যে একটি হলো– ইইউ ট্যালেন্ট পুল। এর মাধ্যমে ইউরোপীয় ইউনিয়নের চাকরিদাতা ও তৃতীয় দেশের চাকরিপ্রার্থীদের প্রত্যাশার মেলবন্ধন ঘটাতে চান তারা। ১৫ নভেম্বর ইউরোপীয় কমিশনের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এমনটাই বলা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, এটি হবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রথম অনলাইন প্ল্যাটফর্ম। এর মাধ্যমে জোটভুক্ত দেশগুলোর বাইরে থাকা চাকরিপ্রত্যাশীদের বৃত্তান্ত এবং জোটের নিয়োগকর্তাদের চাকরির শূন্যপদ একে অপরের কাছে তুলে ধরবে।
ইউরোপীয় কমিশনের স্বরাষ্ট্র ও অভিবাসন বিষয়ক কমিশনার ইলভা ইয়োহানসন বলেন, আইনি পথে অভিবাসনের সুযোগ তৈরি করা হলো ইউরোপীয় ইউনিয়নের অভিন্ন অভিবাসন ও আশ্রয় নীতিমালার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। ফলে এ উদ্যোগের মধ্য দিয়ে অ-ইউরোপীয় দেশের নাগরিকদের চাকরি খোঁজার যেমন সুযোগ তৈরি হলো, ঠিক তেমনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের চাকরিদাতারাও দক্ষ কর্মীদের নিয়োগ দিয়ে শ্রম ঘাটতি দূর করতে পারবেন।
তিনি আরও বলেন, এই পুল ইইউকে দক্ষ ও প্রতিভাবানদের জন্য আকর্ষণীয় গন্তব্যে পরিণত করতে আমাদের প্রচেষ্টাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
চাকরিপ্রত্যাশীদের খুলতে হবে প্রোফাইল
ইউরোপীয় কমিশন জানিয়েছে, তৃতীয় দেশের চাকরিপ্রার্থীরা অনলাইন প্ল্যাটফর্মে একটি প্রোফাইল তৈরি করতে পারবেন। সেই প্রোফাইলের মাধ্যমে তাদের দক্ষতা, যোগ্যতা, কাজের অভিজ্ঞতা এবং ভাষায় পারদর্শিতাসহ অন্য তথ্য সম্পর্কে জানবেন ইউরোপীয় চাকরিদাতারা। একইসঙ্গে সেই প্ল্যাটফর্মে নিজেদের শূন্যপদের বিজ্ঞাপন দেবেন ইউরোপীয় নিয়োগকর্তারা।
একবার ইইউ ট্যালেন্ট পুলের মাধ্যমে তৃতীয় দেশের কেউ নিয়োগ পেলে তিনি ইউরোপের স্থানীয় কর্মীদের মতোই অধিকার ও বাধ্যবাধকতার অধীনে থাকবেন।
যেসব খাতে কর্মী সংকট রয়েছে সেসব বিষয়ের ওপর ফোকাস করবে অনলাইন প্ল্যাটফর্মটি।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনেক দেশে বিভিন্ন খাতে দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে। ২০২২ সালে পুরো ব্লকজুড়ে চাকরির শূন্যপদের হার বেড়ে ২.৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এ হার এক দশক আগের অর্থাৎ ২০১২ সালের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি।
২০৩০ সালের মধ্যে লাখো শূন্যপদ
জনসংখ্যাগত পরিবর্তন, বয়স্ক ও অবসরে যাওয়া মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া, জন্মহার কম থাকায় ইউরোপের শ্রমবাজারের চ্যালেঞ্জ আগামীতে আরও বেড়ে যাবে বলে উদ্বেগ রয়েছে ইইউ কমিশনের।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০৩০ সালের মধ্যে ইউরোপে কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা কমে হবে ২৫ কোটি ৮০ লাখ। ২০২২ সালে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৬ কোটি ৫০ লাখে।
গ্রিন ট্রানজিশনকে প্রত্যাশিত ধরে কমিশন জানিয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে ১০ লাখ থেকে ১২ লাখ ৫০ হাজার নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে। ডিজিটাল ট্রানজিশনের অংশ হিসেবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক দুই কোটি জনবলের মধ্যে এক কোটি ১০ লাখ মানুষের ঘাটতি রয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে এই শূন্যপদগুলো পূরণের কথা ভাবা হচ্ছে। অন্তত ৪২টি খাতে ইউরোপজুড়ে দক্ষ জনশক্তির অভাব রয়েছে। আর সেই ঘাটতি পূরণের অংশ হিসেবেই ইউরোপীয় কমিশন এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
তৃতীয় দেশের অংশীদারত্ব
ব্রাসেলস তৃতীয় দেশের অংশীদারদের সঙ্গে শ্রম অভিবাসন সহযোগিতা চুক্তি নিয়ে একটি ধারাবাহিক আলোচনা করতে চায়। এটি শুধু দক্ষ জনশক্তিকে ইউরোপমুখী করবে তা নয়, বরং তৃতীয় দেশগুলোতে দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে সহযোগিতায় আর্থিক সহায়তাও দেবে।
ইইউ ট্যালেন্ট পুল প্ল্যাটফর্মটিতে লগইন করলে প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে নিয়োগ এবং অভিবাসন পদ্ধতির তথ্যও পাওয়া যাবে। কমিশন বলেছে, ‘ন্যায্যতা এবং কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে’ শক্তিশালী সুরক্ষা ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে।
তৃতীয় দেশের সঙ্গে ইইউ’র ট্যালেন্ট পার্টনারশিপ চুক্তির অধীনে প্রশিক্ষণ নেওয়া জনশক্তি তাদের কোর্স শেষ করার পর একটি ট্যালেন্ট পার্টনারশিপ পাস পাবেন। এর মধ্য দিয়ে ওই ব্যক্তি নিজের সম্পর্কে তথ্যাদি নিয়োগকর্তাদের কাছে তুলে ধরতে পারবেন এবং তার যোগ্যতাকেও স্বীকৃতি দেওয়া হবে। এমন পদ্ধতি ইইউতে কর্মসংস্থানের পথকে সহজ করবে।
ইউরোপীয় কমিশন বর্তমানে পাঁচটি অংশীদার দেশের সঙ্গে কাজ করছে। এর মধ্যে রয়েছে– মিশর, মরক্কো, তিউনিশিয়া, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান।
যোগ্যতার স্বীকৃতি সহজ করা
এখন বিশেষ করে জার্মানির মতো দেশে দক্ষ অভিবাসীরা নিয়োগ পেলেও তাদের যোগ্যতার সম্পূর্ণ স্বীকৃতি বা সমমানের জন্য কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হয়।
ফিলিপাইনসের মতো দেশ থেকে নার্স হিসেবে যারা নিয়োগ পেয়েছেন তাদের কাজের পূর্ণ স্বীকৃতি পেতে কয়েক মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে, কারো কারো ক্ষেত্রে সেই অপেক্ষার সময়টা আরও দীর্ঘ ছিল। ওই সময় তাদের অনেককে নার্সের সহকারী হিসেবে কম বেতনে কাজ করতে হয়েছে।
জার্মান রাষ্ট্রীয় টিভির প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে বিষয়টি। কারণ অনেকে নিজ দেশের চাকরি ছেড়েও জার্মানি এসেছেন। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে তাদের অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন স্বীকার করেছে যে, ‘ইইউ-এর বাইরে অর্জিত যোগ্যতার স্বীকৃতি দক্ষ কর্মী খোঁজার কাজকে যেমন সহজ করে, তেমনি তৃতীয় দেশ থেকে ইউরোপের চাকরির বাজারে আবেদন প্রক্রিয়া ও ইউরোপীয় সমাজে একীভূত হওয়ার ক্ষেত্রেও সহায়ক হয়।’
ফলে কমিশন স্বীকৃতির প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে এবং পুরো ব্যবস্থাকে আধুনিকীকরণ করতে চায়।
শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে গতিশীলতা
শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের গতিশীলতা বাড়ানোর ওপর নজর দিচ্ছে ইউরোপীয় কমিশন। ২০৩০ সালের মধ্যে জোটভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে অন্তত ২৫ শতাংশ গ্র্যাজুয়েট ও কারিগরি শিক্ষায় অন্তত ১৫ শতাংশ দক্ষ জনশক্তি তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। আর এই গতিশীলতার মধ্য দিয়ে তারা মনে করছে, ইউরোপকে তৃতীয় দেশের দক্ষ জনশক্তির জন্য আকর্ষণীয় গন্তব্যস্থলে পরিণত করা সম্ভব।
আন্তর্জাতিক বাজার থেকে প্রত্যাশিত জনশক্তিকে বাছাই করার প্রক্রিয়াটিকে জটিল বলেই মনে করছে ইউরোপীয় কমিশন। কারণ, অনেক চাকরিপ্রার্থীর নিজ দেশ থেকে অর্জিত দক্ষতাকে ঠিক মতো বুঝতে পারা ইউরোপীয় চাকরিদাতাদের জন্য কঠিন হতে পারে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন থাকতে পারে। ফলে, এ প্রক্রিয়ায় এটি একটি জটিলতা তৈরি করতে পারে।
আবেদন করতে পারবেন তৃতীয় দেশে বসবাসরতরা
দক্ষতা এবং যোগ্যতার স্বীকৃতির চ্যালেঞ্জগুলো আইনি অভিবাসনের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
২০২২ সালে দেওয়া ‘স্টেট অব দ্য ইউনিয়ন’ ভাষণেও ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডেয়ার লিয়েন এসব নতুন উদ্যোগ নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি বলেছিলেন, ইউরোপকে দক্ষ কর্মীদের জন্য আরও আকর্ষণীয় হতে হবে।
কমিশনের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ট্যালেন্ট পুলটি শুধু ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরে থাকা তৃতীয় দেশের চাকরিপ্রার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। আর তৃতীয়-দেশের নাগরিক যারা ইতোমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে রয়েছেন, তারা চাকরি খোঁজার জন্য ইইউআরইএস প্ল্যাটফর্ম বা পাবলিক এমপ্লয়মেন্ট পরিষেবা ব্যবহার করতে পারবেন।
অবশ্য কমিশন আশা করছে, তৃতীয় দেশের নাগরিকদের যোগ্যতার স্বীকৃতি প্রক্রিয়াকে গতিশীল এবং মসৃণ করতে সংস্থাটির দেওয়া সুপারিশগুলো গ্রহণ করবে সব সদস্য দেশ।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, এই পুল সবার জন্য উন্মুক্ত। এতে আরও বলা হয়েছে, ‘ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরে বসবাসরত যেসব ব্যক্তিরা আন্তর্জাতিক সুরক্ষার কথা ভাবছেন, তাদের যদি প্রয়োজনীয় দক্ষতা থাকে তারাও এই চাকরির জন্য আবেদন করতে পারবেন।’
অবশ্য ট্যালেন্ট পুলের মাধ্যমে চাকরির প্রস্তাব কোনো আশ্রয়ের অধিকার তৈরি করবে না।
এই প্ল্যাটফর্মের প্রস্তাবটি এখন ইউরোপীয় পার্লামেন্ট এবং কাউন্সিল পর্যায়ে আলোচনা করা হবে। কমিশনের লক্ষ্য সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে সুপারিশ বাস্তবায়নে সহায়তা করা এবং প্রস্তাবগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জাতীয় উদ্যোগ স্থাপনের তাদের রাজি করানো।
সূত্র : ইনফোমাইগ্রেন্টস