দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশ থাইল্যান্ড। প্রাকৃতিক নৈসর্গে ভরপুর দেশটি প্রকৃতিপ্রেমী মেধাবীদের জন্য উচ্চশিক্ষার এক অনন্য গন্তব্য। চলুন, থাইল্যান্ডে উচ্চশিক্ষায় আবেদন, স্টুডেন্ট ভিসা, অধ্যয়ন খরচ ও স্কলারশিপ নিয়ে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক। প্রধান ভাষা থাই হলেও প্রায় সব কটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত ইংরেজি প্রোগ্রাম চালু থাকায় বিদেশি শিক্ষার্থীরা সহজেই মানিয়ে নিতে পারেন। তবে দেশটির পরিবেশের সঙ্গে তাঁদের একাত্ম হওয়ার আরও একটি কারণ হচ্ছে এখানকার মনোরম প্রকৃতি। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এখানে রয়েছে পাম বন, আদিম সাদা সৈকত ও পাহাড়ের এক দারুণ সন্নিবেশ। শত মন্দিরের দেশ আসিয়ান জোটের চতুর্থ সুখী রাষ্ট্র। হয়তো সে কারণেই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী–প্রধান দেশটির আরেক নাম ‘ল্যান্ড অব স্মাইলস’।
চুলালংকর্ন ইউনিভার্সিটি, মাহিদোল ইউনিভার্সিটি, চিয়াং মাই ইউনিভার্সিটি, থাম্মাসাত বিশ্ববিদ্যালয়, ক্যাসেতসার্ত ইউনিভার্সিটি, প্রিন্স অব সংক্লা ইউনিভার্সিটি, খন ক্যায়েন ইউনিভার্সিটি প্রভৃতি।
বিজনেস স্টাডিজ, ইঞ্জিনিয়ারিং, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ স্টাডিজ, জার্নালিজম অ্যান্ড মাস কমিউনিকেশন, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি, সোশ্যাল সায়েন্স ও ন্যাচারাল সায়েন্স।
সাধারণত দুটি মৌসুমকে কেন্দ্র করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ভর্তির কার্যক্রম চলে। একটি হচ্ছে অটাম, যার জন্য আবেদন গ্রহণ শুরু হয় মে মাস থেকে। জুলাই নাগাদ সব আবেদন নেওয়া শেষ করে ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু করা হয় আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে।
ভর্তির দ্বিতীয় ইনটেকটি হলো স্প্রিং। এ মৌসুমে ভর্তি শুরু হয় যায় জানুয়ারিতে। এর জন্য আবেদনের সময় থাকে নভেম্বর থেকে জানুয়ারি। ক্লাস শুরু হতে হতে মার্চ চলে আসে।
স্নাতক ও স্নাতকোত্তর উভয় ক্ষেত্রেই এ ইনটেকগুলো বজায় রাখা হয়। তবে মৌসুমের এই ভিন্নতা মূলত প্রোগ্রামের ওপর নির্ভর করে। এমন অনেক প্রোগ্রাম আছে, যেগুলোর জন্য শুধু একটি মৌসুমেই আবেদন নেওয়া হয়।
তাই সর্বোত্তম পন্থা হলো সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা। এতে যে শুধু নির্দিষ্ট প্রোগ্রাম সম্পর্কেই আপ-টু-ডেট থাকা যায়, তা নয়। পাশাপাশি ওপরে উল্লিখিত সাধারণ ইনটেকের বাইরে ভর্তির বিষয়েও জানা যায়। এ যোগাযোগের জন্য সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিশিয়াল ওয়েবসাইট চেক করা যেতে পারে। ভর্তির প্রক্রিয়াগুলো পরিচালিত হয় থাই ইউনিভার্সিটি সেন্ট্রাল অ্যাডমিশন সিস্টেম (https://www.mytcas.com/) বা থাইল্যান্ডের কাউন্সিল অব ইউনিভার্সিটি প্রেসিডেন্টস (https://www.cupt.net/en/)-এর মাধ্যমে।
সাধারণত আবেদন জমা দেওয়ার পর যাবতীয় কাগজপত্র যাচাই করতে ১ থেকে ৩ কর্মদিবস সময় লাগে। এরপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্তসহ ই-মেইলের মাধ্যমে পরবর্তী সময়ে করণীয় জরুরি নির্দেশনা দেওয়া হয় আবেদনকারীকে। মূলত ১০ দিনের মধ্যে আবেদন ফি পরিশোধ করতে বলা হয়। এরপর অধ্যয়ন ফির জন্য ইনভয়েস ই-মেইল করা হয়। সাধারণত সেমিস্টার শুরু হওয়ার প্রায় আড়াই মাস আগে অধ্যয়ন ফির চালান সরবরাহ করা হয়ে থাকে। এই ফি দেওয়ার পরপরই সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভর্তির আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতিপত্র (অফার লেটার) পাঠানো হয়।
‘নন-ইমিগ্র্যান্ট ভিসা টাইপ ইডি প্লাস’। এটিই হচ্ছে থাইল্যান্ডের স্টুডেন্ট ভিসা, যার মেয়াদ থাকে সিঙ্গেল এন্ট্রিতে ইস্যুর দিন থেকে সর্বোচ্চ ৩ মাস বা ৯০ দিন। এই ভিসার আবেদনের পূর্বশর্তগুলো হলো—
ভিসার তিন মাস মেয়াদ স্নাতক বা স্নাতকোত্তরের সময়ের জন্য যথেষ্ট নয়। তাই এই ভিসা নিয়ে থাইল্যান্ড যাওয়ার পর ভিসার মেয়াদ বাড়িয়ে নেওয়া যায়। শিক্ষার্থীর বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর পক্ষ থেকে ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর জন্য আবেদন করতে পারে।
‘নন-ইমিগ্র্যান্ট ভিসা টাইপ ইডি প্লাস’-এর আবেদন ফরমটি এই লিংক থেকে ডাউনলোড করা যাবে:
এটি পূরণ করে প্রিন্ট নিতে হবে। ফরমের নির্ধারিত স্থানে স্বহস্তে স্বাক্ষর করে জমা দেওয়ার জন্য অন্য দরকারি নথিপত্রের সঙ্গে সংরক্ষণ করতে হবে।
এগুলোর কোনো একটি নথি বাংলা ভাষায় থাকলে তা অবশ্যই জাতীয়ভাবে স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে নিতে হবে।
থাইল্যান্ডের স্টুডেন্ট ভিসার কাগজপত্র জমা দেওয়ার জন্য কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট বুকিংয়ের দরকার নেই। নির্দিষ্ট সময় জেনে যেকোনো কর্মদিবসে সশরীর বা নিজের কোনো প্রতিনিধির মাধ্যমে কাগজপত্র জমা দেওয়া যাবে। বাংলাদেশে থাই দূতাবাসের পক্ষ থেকে তাদের গ্লোবাল পার্টনার ভিএফএস (ভিসা ফ্যাসিলিটেশন সার্ভিসেস) আবেদন গ্রহণ করে থাকে। রাজধানী ঢাকাসহ ভিএফএস সেন্টার রয়েছে চট্টগ্রাম ও সিলেটে।
*ঢাকার ভিএফএস ঠিকানা: বোরাক মেহনুর ৫১/বি, ৮ম তলা, কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউ, বনানী-১২১৩।
*চট্টগ্রাম ভিএফএস ঠিকানা: ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার চট্টগ্রাম, (৫ম তলা) ১০২/১০৩ আগ্রাবাদ সিএ, কমার্স কলেজ রোড, চট্টগ্রাম-৪১০০।
*সিলেট ভিএফএস ঠিকানা: মার্চেন্ট টাওয়ার (লেভেল-৪), পূর্ব মিরাবাজার, সিলেট-৩১০০।
এগুলোর যেকোনোটিতে ভিসার সমুদয় কাগজপত্র জমা দিতে রোববার থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টার মধ্যে উপস্থিত হতে হবে। এই দিন নথিপত্র গ্রহণ করার পর আবেদনকারীকে আবেদন গ্রহণের স্বীকৃতিস্বরূপ একটি রসিদ প্রদান করা হবে। এটি পরবর্তী সময়ে ভিসাযুক্ত পাসপোর্ট গ্রহণের সময় সঙ্গে করে নিয়ে আসতে হবে।
‘নন-ইমিগ্র্যান্ট ভিসা টাইপ ইডি প্লাস’-এর প্রক্রিয়াকরণের সময় সাধারণত ৩ থেকে ৫ সপ্তাহ। এর মধ্যে অনলাইনে ভিসা আবেদনের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানা যাবে। এই পরিষেবাটি পেতে এই লিংকে যেতে হবে: https://www.vfsvisaonline.com/Global-Passporttracking/Track/Index?q=shSA0YnE4pLF9Xzwon/x/Mxlqhn/0KUK4Zw3AaywRsWcU5yGF1TW1zfBjg+DgS4EYjhIexVxXzJ9EEquZs7mPUzKyGgAtSfl4fZQdIakJsk=
এখানে দরকার হবে আবেদনকারীর জন্মতারিখ এবং একটি রেফারেন্স নম্বর, যেটি পাওয়া যাবে ভিএফএস থেকে প্রদান করা সেই রসিদে।
ভিসা আবেদনের ফি ভিএফএস সেন্টারে আবেদন জমা দেওয়ার সময় সংলগ্ন ব্যাংক কাউন্টারে নগদ জমা করতে হবে। থাই দূতাবাসের ভিএফএস সাইট অনুসারে, এই ভিসা ফি সাত হাজার টাকা। এর সঙ্গে অতিরিক্ত রয়েছে ভিএফএস সার্ভিস চার্জ এক হাজার টাকা ও ব্যাংক ফি ৬০ টাকা।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অধ্যয়নের বিষয় ও প্রোগ্রামের ওপর ভিত্তি করে পড়াশোনার খরচের মধ্যে যথেষ্ট ভিন্নতা থাকে। স্বল্প বাজেটের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গড়পড়তায় খরচ হতে পারে সর্বনিম্ন ৬০ থেকে ৯০ হাজার বাথ পর্যন্ত। ব্যয়বহুল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় পড়ার জন্য বাজেট রাখতে হবে ১ লাখ ১২ হাজার থেকে ১ লাখ ৭৫ হাজার বাথ।
এখানকার নিত্যনৈমিত্তিক জীবনধারণে আবাসন খাতে মাসিক ব্যয়ের পরিমাণ গড়ে ৮ থেকে ১৬ হাজার বাথ। খাবারের জন্য সম্ভাব্য বাজেট ১ থেকে ২ হাজার বাথ। পরিবহনের জন্য রাখতে হবে ১ হাজার ২০০ বাথ। আর সাধারণ ইউটিলিটিগুলোতে খরচ হবে ৩ হাজার ৫০০ বাথ।
তবে জীবনযাত্রার এই বাজেট আবার বিভিন্ন শহরে বদলে যায়। গ্লোবাল লিভিং কস্ট ডাটাবেজ নাম্বিওর তথ্যমতে, বাড়িভাড়া বাদে চিয়াং মাই শহরের মাসিক খরচ গড়ে ১৮ হাজার ২৯৪ বাথ। শহরের প্রাণকেন্দ্রের বাইরে থাকার ব্যবস্থা করা গেলে তাতে ভাড়া পড়বে প্রতি মাসে ৭ থেকে ১০ হাজার বাথ। পাতায়ায় এ পরিমাণটি বেড়ে হয়ে যাবে ৮ থেকে ১৫ হাজার বাথ। ভাড়া বাদে বাকি অন্য খরচ ২০ হাজার ১১২ বাথ।
ফুকেটে ভাড়া ছাড়া মাসিক খরচ ২২ হাজার ৪৩৯ বাথ। শহর থেকে একটু দূরে বাড়িভাড়া পড়বে প্রতি মাসে ১০ থেকে ৩০ হাজার বাথ। এ ক্ষেত্রে ব্যাংককের জন্য মাসিক বাজেট হচ্ছে ৭ থেকে ১৬ হাজার বাথ। আর ভাড়া ছাড়া বাকি জীবনযাত্রার ব্যয়ভার ২২ হাজার ৮১৮ বাথ।
সরকারি, বেসরকারি ও স্থানীয় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থাইল্যান্ডে আসা আন্তর্জাতিক ছাত্রছাত্রীদের স্কলারশিপের ব্যবস্থা করে। এমওপিএর (থাই মিনিস্ট্রি অব পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) অফিশিয়াল সাইট মতে, ইনবাউন্ড এক্সচেঞ্জ স্কলারশিপের মূল্যমান ৩০ হাজার থাই বাথ। এই আর্থিক সহায়তা প্রায় ১ লাখ ১১ হাজার ১৮৯ টাকার সমতুল্য। এটি মূলত খোন কাইন ইউনিভার্সিটির প্রকল্প, যেটি দেওয়া হয় শুধু বিবিএ, বিএ ও ব্যাচেলর অব কমিউনিকেশন আর্টসের শিক্ষার্থীদের।
স্কলারশিপ রোয়ারের তথ্যানুসারে, থাইল্যান্ড গভর্নমেন্ট স্কলারশিপ বিস্তৃত পরিসরে সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকে। এগুলোর মধ্যে আছে—
লিপস্কলারের তথ্যানুসারে, টিআইসিএর নিজস্ব স্কলারশিপও রয়েছে। এর আওতায় থাকে চিকিৎসা খরচ, টিউশন ফি, বিমানভাড়া, মাসিক ভাতা, আবাসন ভাতা, বই ভাতা ও সেটেলমেন্ট ভাতা। রয়্যাল থাই স্কলারশিপের মধ্যে রয়েছে টিউশন ফি, রেজিস্ট্রেশন ফি, বাসস্থান ও মাসিক ভাতা। এইউএন-এসইইডি নেট ফেলোশিপ টিউশন ফি, বিমান ভ্রমণ খরচ, মাসিক ভাতা ও গবেষণা সহায়তা দিয়ে থাকে।
থাইল্যান্ডে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের সপ্তাহে সর্বোচ্চ ২০ ঘণ্টা খণ্ডকালীন কাজ করার অনুমতি দেওয়া হয়। অতিরিক্ত উপার্জনের জন্য সামার ভ্যাকেশনসহ বিভিন্ন উৎসব ও সপ্তাহান্তগুলো বেছে নেওয়া যায়। কেননা, এ সময়গুলোয় কর্মঘণ্টার কোনো সুস্পষ্ট সীমাবদ্ধতা থাকে না বিধায় ফুলটাইম কাজ করা যায়। লিভারেজ-এডু ও লিপস্কলারের সূত্রমতে, থাইল্যান্ডের সর্বাধিক চাহিদাসম্পন্ন খণ্ডকালীন চাকরির বার্ষিক মজুরি হলো গড়ে—
তথ্যসূত্র: ইউএনবি