তবু ফিরতে হয়

সমুদ্র কেন জানি আমাকে ততো টানে না। যতোটা টানে পাহাড়, জঙ্গল, ঝিরি, ঝর্ণা, নদী, হাওর। তবু কী এক অমোঘ টানে সমুদ্রের কাছে দুদণ্ড বিশ্রামে এবার যাওয়া। বিশ্রাম বলতে জিরানো না, অবকাশ। সবশেষ সমুদ্রে, সুনির্দিষ্টভাবে কক্সবাজারে গিয়েছিলাম ২০০৬ বা ৭’এ। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে গিয়েছিলাম ওয়ানগালা উৎসবে পারফর্ম করতে। আমাদের ১০ জনের দলকে প্রস্তাব করা হয়েছিল যে, আমরা টাকা নিব নাকি কক্সবাজারে এক দিন এক রাত ঘুরতে যাব। আমরা দ্বিতীয়টাকেই বেছে নিয়েছিলাম। অবারিত উচ্ছ্বাসে আনন্দে সময় কেটেছিল আমাদের। সেবার আমার প্রথম সমুদ্র সঙ্গম।

এবার একা। একা বলতে যাতায়াতে একা। কক্সবাজারে গিয়ে কাছের মানুষ পেয়েছি জনা কয়েক। একা ভ্রমণের ইচ্ছা-শখ আমার বহুদিনের। পুরো মাত্রায় তাও হয়ে যাবে একদিন, যেখানে কোথাও গিয়ে পরিচিত কেউ থাকবে না, গিয়ে পরিচিত হবো, বন্ধন হবে এমন যে, বেঁধে রেখে ছেড়ে দেয়া, আবার ছেড়ে দিয়ে বেঁধে রাখা।

ভ্রমণ! আহা! ভ্রমণই আমার আনন্দের সবচেয়ে বড় উৎস, আমার জীবন দর্শন। ভ্রমণেই আমি পঞ্চানন্দ (শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ) খুঁজে পাই। আনন্দ কিন্তু সবসময় সুখকে প্রতিনিধিত্ব করে না, দুঃখেও আনন্দ আছে।

ট্যুর নয়, আমি গুরুত্ব দেই ট্রাভেলিংয়ে। আমি মূলত ট্রেকিং করি। যার কারণে ন্যূনতম খরচে সর্বোচ্চ আনন্দের স্বাদ আমি পাবার চেষ্টা করি। এবারের ভ্রমণ কিছুটা ট্যুরের মতোই হলো। ইচ্ছা করেই করলাম। তবে শরতের অবকাশে আকাশের বাঁশরীও বেজেছে, তেমনি প্রতিটি আসর জমেছেও।

ঢাকার কল্যাণপুর থেকে গ্রিন সেইন্ট মার্টিন। বাসে শারীরিক দূরত্বের বালাই সে কবেই চুকেছে। বোন জামাইয়ের সুবাদে আগেই টিকিট বুকিং ছিল। নাহলে বৃহস্পতিবার সিট পাওয়া মুশকিল। এমনিতেই করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার শুরু থেকেই বন্দিমুক্তি উৎসব চলছে। রাস্তায় গাড়ির বেশ চাপ। কুমিল্লায় যাত্রাবিরতিতে গিয়ে দেখলাম, মানুষ আর বাস সংখ্যায় পাল্লা দিচ্ছে, বাস ভাড়া করা পিকনিক পার্টিও দেখলাম।

তন্দ্রা আসে, চলেও যায়, যখন পাতার ফাঁক দিয়ে রোদের ছুরি অনবরত বিদ্ধ করতে থাকে। চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, আবার বিরতি। সাতকানিয়ায় ২০১৪ তে এসেছিলাম, চুনতিতে, দেখেছি বনের ওপর মানুষ এর অবিচার। ৬ বছরে তা আরও আগ্রাসী। এসব ভাবতে ভাবতে সমুদ্র শহরে পৌঁছতে বেলা হয়ে গেল।

বাহারছড়া। বন্ধুর বাসা, আমার এবারের আশ্রয়। বহুদিন বাদে সাক্ষাৎ। বন্ধু বেসরকারি সংস্থায় কাজ করে। সাপ্তাহিক বন্ধের কারণে সময় দিতে পারবে বললো। হিসেবে প্রতি সপ্তাহেই পারে। নাহ পারে না। তাকেও ঢাকায় আসতে হয় পরিবারের কাছে। আমাকে বিশ্রাম নিতে বলে বন্ধু। আমি নেই না। বিশ্রাম নিলেই সময় নষ্ট। পরিস্কার হয়ে বন্ধুর বানানো নাস্তা একসাথে খেতে খেতে গল্পের ঝাঁপি খুলি আমরা। গল্প ফুরায় না। ওদিকে সময় দৌঁড়ায়। দুপুরে খেলাম কয়েক পদের সবজি ভাজি, লাল চিংড়ি ভুনা, কোরাল মাখা মাখা, মুরগি ভুনা, রূপচাঁদা ভাজা।

কথিত উন্নয়ন আর পর্যটন এর নামে কক্সবাজারেও যথেচ্ছাচার। বেহাল সড়ক আর যানজট পার করে সৈকতে পা রাখি। সেখানে জনজট, পায়ে পা লেগে যায়। এদিক সেদিক ময়লার দখল। মন মেজাজ খারাপ হয়। মন ভালো করি নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা দেখে। কোথাও নিবিড়, কোথাও ছন্নছাড়া। রবির কিরণ শেষ হাসি ছড়িয়ে উঞ্চতায় আগলে রাখছে যেন সবাইকে। কেউ কেউ সে আগল থেকে পালাতে চায়। পালানো কি যায় আদৌ? লুকানো হয়তো যায়। কথায় কথায় সবান্ধব সৈকত ধরে পা চালাই দ্বিধূম্রে, আবারও গল্পের ঝাঁপি। চর্ম চোখকে গুরুত্ব দেই বলে মুঠোফোনের চোখ পাত্তা পায় না তেমন। খেয়াল করি, পশ্চিম দিগন্তে লালিমা। সময়ের ব্যাপার, এরপর দিনমণি এক ডুবসাঁতারে চলে যাবে আরেক দেশে মহাদেশে। সন্ধ্যা নামে, একটা দুটা তারা জ্বলে। বাতি জ্বলে জলযানগুলোতে। আজ অমাবস্যা। কালিগোলা অন্ধকারে বাতিঘর হয়ে কাজ করবে আকাশের তারা আর সাগরের ফসফরাস। সৈকতের নির্জন স্থান নিরাপদ নয় বলে ইউটার্ন নেই। সেদিন আর বেড়াই না। বন্ধুর বাসাতেই গল্পে পানাহারে রাত পার।

শনিবার বিকেল অবধি আলসেমিতে। বন্ধু অফিসের কাজ করবে বলে একা বের হই। সৈকতে বোনজামাই এর সাথে খালি পায়ে হাঁটি। তিনিও এখানে চাকরি করেন। বলতে থাকেন, করোনার উচ্চকিত সময়ে সৈকতে শুধু কুকুর ঘুরে বেড়াত আর মৌসুমি জেলেরা মাছ ধরত। সৈকত ছিল পরিচ্ছন্ন, পেয়েছিল বিশ্রাম। কথায় কথায় আমরা দু’জন সাহস করে নির্জন ধরে পা ফেলি। আকাশে শুক্লপক্ষের এক ফালি প্রথমা, মেঘের কারণে ঘোলাটে। আবার ফিরি বন্ধুর বাসায়, আমার আশ্রয়।

রবিবার এ গল্প লিখে লিখেই প্রায় দিন পার করি। বিকেলে এখানে কর্মরত অন্য বন্ধু, ভাই বোনদের দেখা দিয়ে রাতের বাসে ঢাকামুখী।

আমার এখনও কেন জানি বেড়াতে গেলে ফেরার সময় মন খুব খুব খারাপ হয়। অনেকদিন থাকে তার রেশ। তবু ফিরতে হয় আমাকে। কিন্তু আমার ফেরা হয় না। ফেরা হয় না বলতে মনে মনে ফিরি না। স্থায়ী কোনো ঘর আমার নেই, আমার মতো কারও যে থাকতে নেই। আমরা ঘর ছাড়া অস্তিত্ব কিনা। তবু আমরা ফিরি। ঘুরে ফিরে ফিরি, আবার চলে যাই, আবার ফিরি।

জুয়েল থিওটোনিয়াস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

%d bloggers like this: