কুয়াশামাখা মায়াময় রাস্তা, দূর পাহাড়ের সফেদ চূড়ার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকা, ঝর্ণার পাশে চুপ করে বসে থাকার মতো নিস্তব্ধতাময় অদ্ভুত শান্তি আর কোথাও নেই। তাই ছুটি – টাকা জমিয়ে পাহাড়ি টানে এবারের ভ্রমণ গন্তব্য হিমালয়ের কোল ঘেঁষা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অনিন্দ্য সুন্দর পাহাড়ি শহর দার্জিলিং।
শৈল শহরের রানি নামে পরিচিত পাহাড়ি শহর দার্জিলিং। প্রায় সারা বছরজুড়ে শীতলতা মাখা এই শহর মেঘের স্বর্গরাজ্য। চা-বাগান আর সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৭৪০৮ ফিট উচ্চতায় অবস্থিত দার্জিলিং হিমালয় রেলওয়ের জন্য বিখ্যাত। এপার-ওপার দুই বাংলার প্রায় প্রতিটি বাঙালিরই দার্জিলিংয়ের অনাবিল সৌন্দর্য উপভোগ যেন অমোঘ স্বপ্ন।
ঈদুল ফিতরের ছুটিকে কাজে লাগিয়ে ঢাকা টেকনিক্যাল মোড় থেকে বুড়িমারী এক্সপ্রেস (স্লিপার বাস) এর মাধ্যমে আমাদের যাত্রা শুরু হয় রাত ১০ টায়। প্রায় ১৭ ঘণ্টার লম্বা জার্নি শেষে পরদিন দুপুর ২টার দিকে আমরা পৌঁছাই বুড়িমারী/চ্যাংড়াবান্ধা বর্ডার। আগে থেকে ঠিক করে রাখা স্থানীয় এক প্রতিনিধির মাধ্যমে ট্রাভেল ট্যাক্স, পোর্ট ট্যাক্স ইত্যাদি কেটে রাখায় দুই দেশের বর্ডার পার হতে সময় লাগলো মাত্র ২০ মিনিটের মতো। তেতে উঠা রোদ আর প্রায় ৩৭ ডিগ্রি গরম মাথায় নিয়ে চ্যাংড়াবান্ধা বর্ডার থেকে দার্জিলিং অবধি ট্যাক্সি ঠিক করলাম ৩০০০ রুপি দিয়ে। ড্রাইভার সাইফুল ভাই জানালেন ঈদের পরদিন থেকে এই একই ট্রিপ হয়ে যাবে প্রায় ৪৫০০ থেকে ৫০০০ রুপিতে। অল্প-বিস্তর আলাপ আর জলপাইগুড়ির জ্যামবিহীন চারলেনের রাস্তা ধরে আমাদের যাত্রা শুরু। মূল গন্তব্যে পৌঁছুতে সময় লাগবে প্রায় ঘণ্টা চারেকের মতো। আমাদের যাত্রা রুট কার্শিয়ান হয়ে দার্জিলিংয়ের মল রোডের ট্যাক্সি স্ট্যান্ড অবধি।
ঘণ্টা দুয়েক জার্নির পর যখন কার্শিয়ানের কাছাকাছি পৌঁছই তখন বিকেল গড়াচ্ছে। দুইপাশের ঘন জঙ্গলের ভেতর থেকে কিঁচকিঁচ শব্দে ভেসে আসা পাখির অদ্ভুত ডাক আর হুট করে নামা পশলা গুড়ি বৃষ্টি নিমিষেই কমিয়ে আনল তাপমাত্রার পারদ। প্রকৃতি যেন জানান দিল- ‘শীতলতার শহরে আপনাদের স্বাগতম’। সাইফুল ভাই কার্শিয়ান শহরের খুব কাছের একটা ভিউ পয়েন্টে গাড়ি থামালেন। অপূব কার্শিয়ান শহরের গা ছুঁয়ে তখন অস্তাচল। এক পাশটায় মেঘে ঢাকা প্রসারিত পাহাড় আর অন্যপাশে কার্শিয়ান শহরের গা ছুঁয়ে বিকেল রাঙানো সূর্যাস্ত যে কি অসম্ভব সুন্দরের বর্ণনা করছিল সেটা বর্ণনাতীত। মিনিট বিশেক এমন অপরূপ বিকেল-সন্ধ্যা উপভোগ করে পাহাড়ি আকাঁবাঁকা রাস্তা দিয়ে আবার যাত্রা শুরু হয় দার্জিলিংয়ের উদ্দেশ্য।
আগে থেকে ঠিক করে রাখা হোম স্টে’র নাম পাহাড়ি সোল। মল রোড থেকে দূরত্ব ৩ কিলো’র আগে। কিছুটা নিরিবিলি আর চুপচাপ ব্যালকনিতে বসে ভোরের কাঞ্চনজঙ্ঘা উপভোগের উদ্দেশ্যেই যেটাকে ঠিক করা। হোম স্টে’তে চেকিং করে একই ট্যাক্সিযোগে যখন মল রোড পৌঁছই তখন রাত ৯টা পার। প্রায় ১৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ঠান্ডা কাঁপুনিকে গায়ে জড়িয়ে ম্যাল রোডের জমজমাট ভিড় আর গুড়িগুড়ি বৃষ্টিতে বাহারী স্ট্রিট ফুড (চিকেন স্ট্রিপ আর মমো) আর মল রোডের বিখ্যাত কফিশপ হোপ এর সামনে দাঁড়িয়ে ফটোসেশন যেন উড়িয়ে দিল প্রায় ২৪ ঘণ্টা ধরে করা লম্বা জার্নির ধকল।
ঘণ্টা দুয়েক মল রোডে কাটানোর পর হোম স্টে’র ব্যালকনিতে দাঁড়াতেই চোখে পড়লো রাতের দার্জিলিং শহর। মেঘবালিকার শরীর ছুঁয়ে যেমন করে বালক বলে উঠে- ‘প্রিয়, এবার তবে শান্ত হও; নগরে তোমার আলোকচ্ছটার ফোটাটুকু পড়ে থাকতে দাও..’ ঠিক তেমনই যেন প্রশান্তির রূপ নিস্তব্ধ শহরে। অদূর দূরে পাহাড়ি মেঘ ছাড়িয়ে কাল ভোরে যেন কাঞ্চনদা এক নজর দেখা দেয় সে আশায় প্রথম রাত্রি যাপন দার্জিলিংয়ের কোলে।
আমাদের পরের দিনের যাত্রা গন্তব্য ঘুম স্টেশন, বাতাসিয়া লুপ, দার্জিলিং হিমালয় রেলওয়ে, হিমালয়ান জুলজি পার্ক আর মাউন্টেইনারিং ইনস্টিটিউট, জাপানিজ ট্যাম্পল, পীস প্যাগোডা, রক গার্ডেন, টয় ট্রেন ভ্রমণ।