বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০:২৩ পূর্বাহ্ন

ঢাকার কাছে কাশফুলের খোঁজে

  • আপডেট সময় বুধবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

কাশফুলের দেখা মানেই প্রকৃতি জুড়ে চলে এসেছে শরৎকাল। সেপ্টেম্বরের শেষ থেকে শুরু করে অক্টোবরের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়টুকুতে পূর্ণাঙ্গ কাশফুলের সমারোহে সৃষ্টি হয় কাশবনের। স্বভাবতই এই সময়টাই কাশফুল দেখার জন্য শ্রেষ্ঠ সময়। কাশফুল ফুটতে দেখা যায় নদীর তীর অথবা দীগন্ত বিস্তৃত ফাঁকা বালুময় জায়গায়। শরতের মনোরম সৌন্দর্যকে প্রাণভরে দেখতে প্রতি বছরেই এরকম জায়গায় জমায়েত হন প্রকৃতিপ্রেমীরা। এমনকি ঢাকা নিবাসী ভ্রমণপিপাসুরাও রাজধানীর এই যান্ত্রিক ধূসর কোলাহলের ভেতরে আবিষ্কার করে ফেলেছেন শ্বেতশুভ্র কাশবন। চলুন, ঢাকার ভেতরে এবং আশেপাশে সেরকম কয়েকটি জায়গার কাশফুলের খোঁজ জেনে নিই।

ঢাকার কাছেই ৭টি সেরা কাশবন

দিয়াবাড়ি

উত্তরার হাউস বিল্ডিংয়ের মাস্কট প্লাজা থেকে বটতলা এলাকায় প্রবেশের পর পরই রাস্তার দু’পাশ জুড়ে চোখে পড়বে অবারিত কাশবন। কাশফুলের বাগানগুলো এত বড় যে মাথা উচু করেও ঝোপ-ঝাড়ের ওপর দিয়ে দুরে দেখা যায় না। বাগানের ভেতর দিয়ে পায়ে চলা পথ ফটোগ্রাফারদের ছবি তোলার প্রিয় বিষয়বস্তু। যারা পরিবার নিয়ে ঘুরতে যান, এই দু’পাশ কাশফুলে ছেয়ে থাকা রাস্তাগুলোর সাথে তারাও নিজেদের ফ্রেমবন্দি করে নেন।

এই শুভ্রতার ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে তুরাগ নদীর একটি শাখা, যা সংস্কারের ফলে অপরূপ একটি লেকে রূপ নিয়েছে। লেকের দুই পাশ সংযোগকৃত ছোট্ট সেতুটি জায়গাটিকে আরো মোহনীয় করে তুলেছে। লেকের পাড় ঘেষে কৃত্রিম ফুটপাতের পাশে বেশ কিছু ফুডকোর্টের ভিড় হয়। এগুলোর বিশাল ছাতার নিচে বসে বিকেলের স্ন্যাকস হাতে চারপাশের কাশফুল দেখার ব্যাপারটা বেশ লোভনীয়।

বসুন্ধরা ৩০০ ফিট

কুড়িল বিশ্বরোড থেকে বসুন্ধরার পাশ দিয়ে চলে যাওয়া পূর্বাচল হাইওয়ের ওপর দিয়ে যাবার সময় ফটোগ্রাফাররা তাদের ক্যামেরার শাটার রিলিজ বাটন থেকে আঙ্গুল সরাতে পারেন না। অনেকে আবার নিজের চোখে পুরোটা ধারণ করবেন না ফ্রেমবন্দি করে স্মৃতিতে রাখবেন তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যান। পিচঢালা রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে এটাই একমাত্র জায়গা যেখানে দু’চোখ দিয়ে দু’পাশের দিগন্তকে স্পর্শ করা যায়। আর আশ্বিন মাসের কাশফুলের মৌসুমে সেই দিগন্ত ভরে যায় অকৃত্রিম শুভ্রতায়। মেঘলা দিনগুলোতে আকাশের ঠিক কোন দিগন্তরেখায় কাশফুলের প্রান্তর গিয়ে মিশেছে তা বুঝা কঠিন হয়ে পড়ে।

শহীদ ময়েজ উদ্দিন চত্ত্বর ও নীলা মার্কেটের জন্য ভোজন রসিক ভ্রমণপিপাসুদের নিদেনপক্ষে খাবার নিয়ে চিন্তা করতে হয় না। বেশ কিছু ব্যতিক্রম ধরনের রেস্তোরা চালু হওয়ায় পরিবার নিয়ে অনেকেই এখানে চলে আসছে একটি পড়ন্ত বিকাল কাটাতে।

আফতাব নগর

হাতিরঝিল থেকে বীর উত্তম রফিকুল ইসলাম সরণী অতিক্রম করে জহুরুল ইসলাম সরণী ধরে লোহার সেতু পেরিয়ে প্রায় আধা কিলোমিটার এগুলে চোখে পড়বে আফতাব নগর কাশবন। আফতাব নগর হাউজিং প্রোজেক্টের আওতাধীন এই জায়গাগুলো প্রতি শরতে কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই কাশফুল দখল করে বসে। এমনকি পাশ দিয়ে সরু হয়ে বয়ে যাওয়া তুরাগ নদীর মৃত অংশ রামপুরা খালের আশপাশও ছেয়ে যায় কাশফুলের ছোট ছোট ঝাড়ে।

ঢাকার ভেতরে কাশফুলের শুভ্রতা ও বৈকালী রোদের মিতালীতে নিজেকে হারিয়ে ফেলার জন্য এটি একটি আদর্শ জায়গা। আফতাব নগরের একদম পেছনের এই অংশে প্রায়ই আশপাশের আবাসিক এলাকার পাশাপাশি দূর থেকেও অনেক দর্শনার্থীদের সমাগম হয়।

কাশফুলের ঝাড়ের ওপর দিয়ে নির্দিষ্ট দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা আকাশ ছোয়া বহুতল ভবনগুলো দেখে মনে হয় যেন এই কাশবনকে ঘিরে দাঁড়িয়ে ওরা পাহাড়া দিচ্ছে।

মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ

মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধের বসিলা সড়ক ছাড়িয়ে ওয়াশপুর গার্ডেন সিটি মূলত কোন তথাকথিত দর্শনীয় স্থান নয়। প্লট বিক্রির জন্য ফাঁকা পড়ে থাকা এখানকার জায়গাগুলো সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে ভরে যায় কাশফুলে।

এছাড়া বেড়িবাঁধের পশ্চিম পাশে ঢাকা উদ্যান হাউজিংয়ের প্লটগুলো থেকে শুরু করে বুড়িগঙ্গা নদীর তীর পর্যন্ত ছেয়ে যায় কাশফুলের রাজ্যে। নীচে ইট-সুড়কির বাদামী রঙের মাঝে একটি দুটি গাছের সবুজ আর উপরে সাদা মেঘের পেছনে নীল আকাশ সেই অফুরন্ত শুভ্রতার সজ্জা সঙ্গী হয়।

পুরো জায়গাটা ঘুরতে হলে নিজস্ব গাড়ি করে যাওয়াটাই উত্তম কারণ হেটে চলার ক্লান্তি এই দীর্ঘ সৌন্দর্যকে ছাপিয়ে উঠতে পারে না। তাছাড়া রিজার্ভ গাড়ি হলে ইচ্ছে মত যেকোন জায়গায় গাড়ি থামিয়ে ছবি তোলার সুযোগটাও থাকে।

ঢাকার কাছে কাশফুল দেখার জায়গা

আমুলিয়া মডেল টাউন

আফতাব নগরের মত ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টারের পাশে এই মডেল টাউনটিও শরতকালে কাশফুলের দখলে চলে যায়। একদম প্রবেশদ্বার থেকে শুরু করে যতদূর যাওয়া যায় ততদূর কাশফুলের উন্মাদনা থেকে চোখ ফেরানো যায় না।

যখন সাদা মেঘ আকাশের নীলকে ঢেকে ফেলে তখন কাশফুলের আদিগন্ত জলসা দেখে মনে হয়, পুরো প্রকৃতি যেন সাদা ইউনিফর্ম পড়ে বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করছে। তবে রৌদ্রজ্জ্বল দিনে কালার কন্ট্রাস্টটা ভালো করে চোখে পড়ে। নীল, সাদা, ধূসরের দারুণ কারুকাজ ধরা পড়ে দৃষ্টিপটে। আর শেষ বিকেলে তার সাথে যুক্ত হয় রক্তিম লাল।

গুলিস্তান ফ্লাইওভার দিয়ে ডেমরা স্টাফ কোয়াটার থেকে রামপুরাগামী রাস্তা ধরে পৌছা যায় আমুলিয়া মডেল টাউন। আবার রামপুরা ব্রিজের ওপর দিয়ে বনশ্রী হয়ে আমুলিয়া মডেল টাউন আসা যায়।

সারিঘাট

ঢাকার কাছেই কেরানীগঞ্জের সারিঘাট গ্রাম্য পরিবেশে কাঁশফুল দেখার জন্য শ্রেষ্ঠ জায়গা। খালের স্বচ্ছ পানিতে বাচ্চাদের লাফিয়ে পড়া, মাছ ধরা আর মাঝিদের নৌকা পাড়াপাড়ের দৃশ্যের মাঝে শহরের তাড়না থেকে রেহাই মিলে। দু’পাশে সান্ত্রীর মত নুয়ে পড়ে গাছগুলোর মাঝ দিয়ে চলে যাওয়া পাঁকা রাস্তায় প্রতিটি কদমে সময় যেন থমকে যায়।

সুপরিচিত হবার পর থেকে জায়গাটিতে দর্শনার্থীদের ভিড় বেড়েই চলেছে। খালের পানির আয়নায় যেখানে দিনান্তে আকাশের রঙ বদলে যায়, পাশের বালিয়ারিতে সন্ন্যাসী কাশফুলের ঝুঁকে ঝুঁকে প্রার্থনা তখনো থামে না। অন্যদিকে সেই পানির আয়নায় কোন এক ভ্রমণপিপাসুর গাছের সবুজ আর মেঘের ধূসর আলাদা করার চেষ্টায় নিয়ত বাধ সেধে যায় শেষ বিকেলের স্নিগ্ধ বাতাস।

সংস্কার করার ফলে বুড়িগঙ্গার সাথে সংযোগ থাকা এই খালটিতে বছরের প্রায় সব সময়ই পানি থাকে। পুরান ঢাকা পোস্তগোলা ব্রীজ থেকে চার কিলোমিটারের পথ বসুন্ধরা রিভারভিউ আবাসিক এলাকার একদম শেষ প্রান্তের এই জায়গাটি।

ভাটি বন্দর, কাশবন

এতক্ষণ ধরে আলোচনা করা জায়গাগুলো থেকে এই জায়গাটি ঢাকা থেকে তুলনামুলকভাবে একটু বেশি দূরে এবং সবচেয়ে বেশি সুন্দর। রাজধানীর আশেপাশের কাশবনগুলোর মধ্যে এটি সবচেয়ে বড় কাশবন। ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান পানাম নগর খ্যাত নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁয়ের মোগড়া পাড়া থেকে ৫ থেকে ৭ মিনিটের পথ ভাটি বন্দর।

পুরো ভাটি বন্দর কাশবন পায়ে হেটে ভালোমত ঘুরে দেখতে প্রায় দেড় ঘণ্টা সময় লাগবে। বিস্তৃত কাশবনের সৌন্দর্য্য ভালো করে উপভোগ করার জন্য এখানে আছে বাঁশের তৈরি তিনটি ওয়াচ টাওয়ার। প্রতিটি ওয়াচ টাওয়ারের মাঝে প্রায় ২০ মিনিটের পায়ে হাটা পথ। ভাটি বন্দরে প্রবেশের ২ মিনিট হাটার পরই প্রথম ওয়াচ টাওয়ার। তৃতীয় টাওয়ার থেকে তুলার মত কাশবনের ওপারে চোখে পড়বে ফিকে আকাশের সঙ্গে মিশে যাওয়া মেঘনা নদী।

শহর থেকে একটু দূরে হওয়ায় বিকেল ৫ টার আগেই ফিরতি পথ ধরে মোগড়া পাড়ায় চলে আসা ভালো। সপ্তাহান্তে পরিবার অথবা বন্ধু-বান্ধব নিয়ে নিমেষেই একটা ডে-ট্যুর দিয়ে আসা যায় তবে একটু ভারি দলবল নিয়ে এখানে ঘুরতে যাওয়াটা সমীচীন হবে।

পরিশিষ্ট

ঢাকার কাছে কাশফুল দেখার জন্য এই সাতটি জায়গা ভ্রমণের ক্ষেত্রে কিছু বিষয়ে খেয়াল রাখা আবশ্যক। সাধারণত কাশফুলের জায়গাগুলো একটু নিরিবিলি হয় বিধায় ঘুরতে যাবার ক্ষেত্রে দলে বেশি সদস্য থাকা উচিত। বৃষ্টিতে কাশফুল ভিজে নষ্ট হয়ে যায় তাই ভ্রমণের পূর্বে আবহাওয়ার ব্যাপারে খোঁজ নেয়াটা জরুরি। কাশবনে ঘোরার সময় জামা-কাপড়ের সাথে কাশফুল জড়িয়ে যায়। এক্ষেত্রে সিন্থেটিক কাপড় পড়া যেতে পারে। এ্যালার্জি অথবা এ্যাজমার রোগীদের কাশবন যাওয়া থেকে বিরত থাকার কোন বিকল্প নেই।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com