ভাসমান শহরের কথা শুনলেই চোখের সামনে ভাসতে থাকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ের মানবসৃষ্ট শহর পাম দ্বীপের কথা। মূলত অবসর ও বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে এই দ্বীপটি তৈরি হলেও মালদ্বীপের নতুন ভাসমান শহরের উদ্দেশ্য একটু আলাদা।
বিশ্বে অন্যতম সৌন্দর্যের দেশগুলোর মধ্যে বহুদ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত মালদ্বীপ। এর রয়েছে সৌন্দর্যপূর্ণ অনেকগুলো দ্বীপ। মালদ্বীপ বিশ্বের সবচেয়ে নিচু দেশগুলোর মধ্যে একটি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মালদ্বীপের গড় উচ্চতা এক থেকে দেড় মিটার মাত্র। ১২০০টি দ্বীপ নিয়ে এই দ্বীপরাষ্ট্র গঠিত। ভারত মহাসাগরের বুকে প্রায় ৯০ হাজার বর্গকিলোমিটারজুড়ে মালদ্বীপের অবস্থান। মজার বিষয় হলো সমগ্র মালদ্বীপের আয়তনের ৯৯ ভাগই জলরাশি।
এদেশের স্থলভাগের পরিমাণ মাত্র ১৯৮ বর্গ কিলোমিটার। ধারণা করা হচ্ছে, চলতি শতাব্দীর শেষ নাগাদ বিশ্বে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এক মিটার বাড়বে। ফলে ডুবে যেতে পারে প্রায় পুরো মালদ্বীপ। এই কথা মাথায় রেখে নতুন পরিকল্পনা হিসেবে ভাসমান শহর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দ্বীপ দেশটির সরকার।
গত দুই দশকে ওয়াটারস্টুডিও ৩০০টিরও বেশি ভাসমান বাড়ি, অফিস, স্কুল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র ডিজাইন করেছে। মালদ্বীপের ভাসমান শহরের লেকটি রাজধানী মালের পার্শ্ববর্তী হুলেমালে শহরে করা হবে, শহরটিতে যেতে সময় লাগে রাজধানী মালে থেকে প্রায় ১০ মিনিট। শহরটির কাজ পুরোপুরি শেষ হলে অন্তত ২০ থেকে ২৫ হাজার মানুষ বসবাস করতে পারবেন।
স্থানীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যমতে, শহরটির নকশা করা হয়েছে মানুষের মস্তিষ্কের আকৃতিতে। শহরটিতে নানা রকম অবকাঠামোগত ব্যবস্থা আছে। ২০২৪ সালে ভাসমান শহরটি খুলে দেওয়া হবে। তবে এ মাসেই শহরটির প্রাথমিক অংশ উন্মোচন করা হবে। পুরো শহরের নির্মাণকাজ শেষ হবে ২০২৭ সালে।
বিদেশি আবাসন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ডাচ ডকল্যান্ডস ও মালদ্বীপ সরকারের যৌথ উদ্যোগে শহরটি নির্মিত হচ্ছে। শহরটিকে নানা রং দিয়ে সাজানো হচ্ছে। দেখলে যেন মনে হবে রংধনুর সাত রং দিয়ে সাজানো। এর প্রত্যেকটি বাড়ি বিভিন্ন রং দিয়ে আবৃত্ত করা। ফলে শহরটি দেখে মন ভরে ওঠবে স্থানীয়দের পাশাপাশি আগন্তুক পর্যটকদেরও।
ভাসমান শহরটিতে বসবাসকারী মানুষ যাতায়াতের জন্য ছোট ছোট নৌকা ব্যবহার করতে পারবেন। শহরটি মূলত নৌকা চলাচলের উপযোগী করে তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া শহরটির বালিভরা রাস্তাগুলো সাজানো হয়েছে মানুষের চলাচলের জন্য। এসব রাস্তায় বাসিন্দারা হাঁটতে এবং সাইকেল ও ইলেকট্রিক স্কুটার চালাতে পারবে।
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার মতো জলজ্যান্ত বর্তমান সমস্যার সমাধান হিসেবে শহরটি তৈরি করা হচ্ছে। এখানে খেয়ালি কোনো পরীক্ষা বা সুদূর ভবিষ্যতের উপযোগী নকশা তৈরি করা হয়নি। সমুদ্রের উচ্চতা বাড়ায় শহরটি যাতে ডুবে না যায় সেই দিকটি মাথায় রেখেই শহরটির পরিকল্পনা করা হয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়গুলো মাথায় রেখে শহরটির নকশা করা হয়েছে। শহরটি ভাসমান অবস্থায় থাকবে। সমুদ্রের উচ্চতা বাড়লে, শহরটিরও উচ্চতা বাড়বে। এটি পাঁচ লাখ মালদ্বীপবাসীকে নতুন আশা দেখাচ্ছে বলে মন্তব্য শহরটির নকশাকারী প্রতিষ্ঠানের কোয়েন ওলথুইসের। তিনি বলেন, মালদ্বীপবাসী এখন জলবায়ু উদ্বাস্তু থেকে জলবায়ু উদ্ভাবক হয়ে ওঠবে।
নতুন ভাসমান শহরটি পরিবেশবান্ধব, এমনভাবে তৈরি করা হচ্ছে যাতে ৫,০০০ প্লট ইস্যু করা যেতে পারে এবং এতে পর্যটকদের জন্যও কিছু জায়গা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মস্তিষ্ক আকৃতির প্রবালের নকশায় তৈরি ভাসমান শহরটিতে থাকবে একটি ইয়ট মেরিনা, দুটি পাঁচ তারকা রিসোর্ট এবং স্থানীয়দের জন্য ছোট পিকনিক আইল্যান্ড এবং হাসপাতাল, স্কুল, শপিংমল, কাউন্সিল, সরকারি অফিসও নির্মাণ করা হবে।
এছাড়াও শহরটিতে পানি ও বর্জ নিষ্কাশনের জন্য সুন্দর ব্যবস্থা করা হয়েছে। শহরের বাসিন্দারা এসব ব্যবহার করবে সানন্দে।শহরটিতে বাড়ি, রেস্তোরাঁ, দোকান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ ৫ হাজার ভাসমান ইউনিট থাকবে।
নির্মাতারা আশা করছেন, ২০২৪ সালের শুরুতেই এই শহরে উঠতে পারবেন বাসিন্দারা। ২০২৭ সালের মধ্যে শেষ হতে পারে পুরো প্রকল্পের কাজ।
ওয়াটারস্টুডিওর প্রতিষ্ঠাতা কোয়েন ওলথুইস মনে করেন, এই শহরটি মালদ্বীপের নাগরিকদের জন্য ‘নতুন আশা’। তিনি বলেন, এটা প্রমাণ করবে যে, সাশ্রয়ী মূল্যে ভাসমান আবাসন তৈরি সম্ভব এবং অনেক মানুষ নিয়ে একটি শহর পানির ওপরে নিরাপদে থাকতে পারে।
ওলথুইসের জন্ম নেদারল্যান্ডসে। দেশটির প্রায় এক তৃতীয়াংশ ভূমি সমুদ্রপৃষ্ঠের নীচে অবস্থিত। ফলে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে পরিস্থিতি কেমন হয় তা তিনি বেশ ভালোভাবেই জানেন।
এমনকি ভাসমান একটি শহর রয়েছে নেদারল্যান্ডসে। নেদারল্যান্ডসের রাজধানী আমস্টারডামের ওয়াটারবুর্টে এমন একটি জনবসতির দেখা পাওয়া যায় যারা ভাসমান শহরেই থাকেন। একে বলা হয় ‘ভাসমান মহল্লা’। একটি প্রশস্ত সাদা জেটি এই মহল্লার সীমানা নির্ধারণ করেছে।
২০২১ সালে বন্যায় বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রায় ৮২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি ক্ষতি হয়েছিল। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এই ক্ষতির পরিমাণ আগামী দিনগুলোতে আরও বাড়বে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ওয়ার্ল্ড রিসোর্স ইন্সটিটিউটের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে উপকূলীয় ও নদী তীরবর্তী এলাকায় বন্যার কারণে বছরে ৭০০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি ক্ষতি হবে।
এক্ষেত্রে ভাসমান শহর কিছুটা স্বস্তি দিতে পারে। যদিও এর জন্য পাড়ি দিতে হবে আরও অনেকটা পথ। মালদ্বীপের এই ভাসমান শহরের লক্ষ্য হচ্ছে, ৫ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে ২০ হাজার মানুষের জন্য আবাসস্থল তৈরি করা।
এই শহরের ডিজাইন এমনভাবে করা হয়েছে যেন মানুষ তাদের ঘরের বারান্দা থেকে সমুদ্র দেখতে পারে। পুরো শহরটিই যেহেতু পানির ওপরে তাই বাসিন্দারা সেখানে নৌকা নিয়ে ঘুরতে পারবেন। পাশাপাশি রাস্তায় হাঁটতে, সাইকেল চালাতে বা বৈদ্যুতিক স্কুটারও চালাতে পারবেন।
মালদ্বীপের রাজধানী মালে অত্যন্ত জনাকীর্ণ। সমুদ্রের দিকেও শহরটি বাড়ানোর জন্য জায়গা নেই। রাজধানীর প্রতি শহরটির ৮ বর্গ কিলোমিটারে প্রায় ২ লাখ মানুষ বসবাস করেন। জনবসতি বেশি হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই এই শহরের জমি ও ফ্ল্যাটের দাম আকাশ ছোঁয়া। সেখানে একটি স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট কিনতে খরচ করতে হয় প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার ডলার এবং পরিবারের জন্য অ্যাপার্টমেন্ট কিনতে গেলে প্রয়োজন হয় প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার ডলার।
নতুন শহরের জন্য ভাসমান ইউনিটগুলো একটি স্থানীয় শিপইয়ার্ডে নির্মিত হচ্ছে। সেখান থেকে সেগুলো নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ভাসমান শহরে। যে অংশ যেখানে থাকবে সেখানে বসিয়ে পানির নিচের একটি বড় কংক্রিট হালের সঙ্গে সংযুক্ত করা হচ্ছে। এটি টেলিস্কোপিক ইস্পাত স্টিল্টের সঙ্গে স্ক্রু দিয়ে আটকে দেওয়া হচ্ছে। ফলে, সমুদ্রের পানির তরঙ্গের সঙ্গে ইউনিটগুলো ওঠানামা করতে পারবে।
পানির বড় ঢেউয়ের ধাক্কা সামলাতে এই শহরের চারদিকে তৈরি করা হচ্ছে প্রবাল প্রাচীর। ফলে, ঢেউয়ের কারণে সেখানকার বাসিন্দাদের বড় কোনো সমস্যায় পড়তে হবে না। আর এই প্রবাল কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হচ্ছে গ্লাস ফোম থেকে। পরে যা প্রাকৃতিক প্রবাল তৈরিতে সাহায্য করবে।
এই শহরের আরেকটি লক্ষ্য থাকবে স্বাবলম্বী হওয়ার। এখানে বিদ্যুৎ থাকবে, তবে তার প্রধান উৎস হবে সৌর শক্তি। সমতলের ভূমির মতো এখানে চাষ হবে। ব্যবহৃত পানি পরিশোধনের ব্যবস্থাও থাকবে। এয়ার কন্ডিশনারের বিকল্প হিসেবে এই শহর ব্যবহার করবে গভীর সমুদ্রের শীতলতা। গভীর সমুদ্র থেকে পাম্প করে ঠান্ডা পানি তুলে আনা হবে জলাধারগুলোতে।
ভারত মহাসাগরের বুকে এক হাজার ২০০টিরও বেশি ছোট ছোট দ্বীপ নিয়ে গঠিত মালদ্বীপ। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে দেশটি ডুবে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। এই কঠোর বাস্তবতা মোকাবিলা করতেই এই শহর তৈরি উদ্যোগ নেয় মালদ্বীপ সরকার। ভাসমান এই শহরে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা নিয়ে নিশ্চিতভাবেই কমবে আতঙ্ক।
মালদ্বীপে এই প্রকল্পটি প্রত্যাশা অনুযায়ী বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে তা হয়ে উঠবে একটি মাইলফলক। বিশ্বের বেশকিছু দেশ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আংশিক বা পুরোপুরি ডুবে যাওয়ার আশংকায় রয়েছে। এমন প্রকল্প তাদেরও আশার আলো দেখাবে।
একই সঙ্গে মালদ্বীপের পর্যটনেও এই ভাসমান শহরটি নিঃসন্দেহে প্রভাব ফেলবে। একটি ভাসমান শহর দেখতে কিংবা সেখানে কয়েকটি দিন কাটিয়ে আসতে চাইবেন বিশ্বের নানা প্রান্তের ভ্রমণপ্রেমী মানুষ।