শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ০৬:৪০ অপরাহ্ন
Uncategorized

টু বি অর নট টু বি ইন টরন্টো

  • আপডেট সময় রবিবার, ২২ জানুয়ারি, ২০২৩

সময় পার করা কোনো এক শহরে , আবার এটা এমনও এক সময় , আমার পরিচিতজনেরা জানতে চায় , কি করা যায় এই শহরে, যাবার জায়গাগুলো কোথায় , কিন্তু আমার চেয়ে ভালো কে জানে , আমি এসব পরামর্শের জন্য সবচেয়ে প্রস্তুত লোকটি নই , তারপর ও ভাবছি চেষ্টা করে দেখি , টরন্টো শহরকে জানবার জন্য কোনো পরামর্শ , ভালো হবে কিনা জানি না, দিতে পারি কিনা।

এমন একটা দিনে যখন আপনার তেমন কিছুই করবার নেই, কিন্তু চিন্তার খোরাক আছে অনেক, সেদিন সাবওয়েতে একেবারে লাইনের শেষ পর্যন্ত যান , এমন একটা জায়গায় , আপনার পরিচিত লোকালয় থেকে দূরে। দেখুন সুড়ঙ্গের দেয়ালগুলো কিভাবে আকাশের দিকে উঠে যায়, সুড়ঙ্গের ছাদ যেতে থাকে সরে , ঘূর্ণির মতো, এপার্টমেন্ট দেখতে দেখতে হঠাৎ উঠে আসে বাড়ি , রাস্তা পরিবর্তন হয় খোলা বাগানে, আশপাশের ভবনগুলো জায়গা ছেড়ে দেয় সুদৃশ্য প্রকৃতির কাছে । ভাবুন , নিজেদের রুটিনের বাইরে কত কম আমরা জানি, কত অজানা হতে পারে এই শহর, আমাদের অভিজ্ঞতার বাইরের যে মানচিত্র , তার উপর থরে থরে সাজানো অসীম কত জীবনের গল্প লেখা আছে এতে । রেল লাইনের উপর থেকে বৃষ্টিধোয়া সাদা আকাশে কৃতজ্ঞতা ভরে শ্বাস নিন, যেখানে আপনি শুনতে পাবেন শঙ্খচিলের ডাক, আর নিতে পারবেন বুক ভরে মহাসাগরের ঘ্রাণ ।

আবার ট্রেনে চড়ে ফিরে আসুন ঘরে , এই ব্যাপারটি আপনার কোনো সমস্যাই মেটায় নি , কিন্তু খুব চমৎকার একটা অভিজ্ঞতা, তাই না?

আরেকদিন , রেগেমেগে টরন্টোর সাবওযেতে উঠে পড়ুন , দেখবেন এমন এক জায়গায় চলে গেছেন , যেখানে আদৌ আপনি আসতে চান নি। স্টেশনে জোরে চিৎকার করুন , আপনি নিজে কিছু বুঝে উঠবার আগেই, দেখবেন কেউ বিন্দুমাত্র কেয়ার করছে না । বা দুই স্টেশনের মাঝখানে আটকে পড়েছেন , অনেকক্ষন না নড়ে থাকতে থাকতেই আপনার মনে হবে , বাইবেলে কথিত সেই বিখ্যাত ধ্বংসস্তূপ থেকে আপনি বেঁচে বেরিয়ে এসেছেন , আপনার সাথের আরোহীরাসহ, যাদের রয়েছে অসাধারণ বেঁচে থাকবার কৌশল , যারা আপনার সাথে জোট বেঁধেছে বা বিপদে পড়লে যারা একে অন্যকে চিবুতেও দুবার চিন্তা করবে না।

অথবা সচরাচর হয় না , অথচ আজকে স্কুলে বা কাজে আপনার বিরক্তিকর লম্বা একটা দিন কেটেছে , আপনি বাড়ি ফেরবার সময় সাবওয়েতে ঘুমিয়ে পড়েছেন , আপনার স্টেশনে পৌঁছুবার মাত্র কয়েক সেকেন্ড থাকতে আপনি জেগে উঠেছেন, আহ , আপনার মনে হবে, আপনি স্টেশনটা মিস করেন নি , আপনি গন্তব্যে পৌঁছেছেন , আপনার পরাজয় হয় নি ।

চলে যান , সপ্তাহের কোনো এক দিন, শেষ অপরাহ্নে, ইয়ং স্ট্রিটের ত্রি ব্রুয়ারিস বা আপনার পছন্দের কোনো রেস্তোরায় বা পানশালায়, সময় নিয়ে পান করুন এক গ্লাস মার্টিনি , এমন কাউকেও সাথে নিন যাকে আপনি খুব করে মুগ্ধ করতে চাইছেন, কিন্তু ঠিক এখনো পেরে উঠেন নি। বা প্রিয়জন যদি কেউ থাকে , তাকে নিয়ে যান , আবার একাকীও হতে পারে এই যাত্রা। যাকেই নিয়ে যান , প্রতিবার মার্টিনিটা হবে নিখুঁত, এটি হতে পারে আজকের মতো আপনার শেষ কাজ বা নাও হতে পারে। কিচ্ছু তোয়াক্কা করবেন না , জীবনের পছন্দগুলোকে নিয়ে বাঁচুন।

বা এমনও হতে পারে , খুব নামকরা একটা প্রকাশনা সংস্থা বা বিজনেস অফিসে যান বা এমন বড়ো এক শিল্প সংস্কৃতির দরোজায়, যেমন আগাখান মিউজিয়াম, বা ন্যাশনাল ব্যালে , বা এড মিরভিস থিয়েটার যেখানে তরুণ বয়েসে কাজ করবেন বলে কোনো এক সময় স্বপ্ন দেখতেন। সেখানে গিয়ে ওদের নিচতলার অভ্যর্থনা কক্ষে ভিজিটর বইয়ে স্বাক্ষর করুন , নিজেকে মনে হবে কি গুরুত্বপূর্ণ , তারপর এলিভেটরে করে উপরে যখন পৌঁছুবেন , দেখবেন , এটা তো অন্য আর দশটা অফিসের মতোই , কিউবিকল গুলো আটপৌরে , অনুজ্জ্বল আলো , একই সব জানলা আর মানুষগুলো , অন্য সবার মতো, ঘরে ফিরতে চায়।

প্রতিটি শহরের একেবারে ভেতরের কিছু রসিকতা থাকে। তাই আমাদের মেয়র ,কাউন্সিলর, এবং আরো যারা ভারিক্কি পদ পদবীর, তাদের নিয়ে রসিকতা করতে শিখুন , রসিকতা করতে শিখুন এই শহরের ট্রেন নিয়ে, আবহাওয়াই বা বাদ থাকবে কেন, এবং রাস্তা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ক্রেন, বা নির্মাণ কাজের যে মাচা (ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য স্ক্যাফোল্ডিং !), জিনিসপত্রের দ্রব্যমূল্য , বা এমনকি টরন্টো ষ্টার , বা সরকারি মিডিয়া যেমন সিবিসি , বা ড্রেক বা স্থানীয় বিনোদন জগতের অন্য কোনো সেলেব্রেটি নিয়ে, যাদের কেউই তেমন কেয়ার করে না। বা আমাদের প্রধানমন্ত্রীর মতো ট্রাস্ট ফান্ড কিড , আরো আছে টিকটকার বা সামাজিক মাধ্যমে যারা ভাইরাল, যেমন বিরোধী নেতা পিয়ের পলিয়েভ, বা আমাদের স্যুট টাই পরা সমাজতন্ত্রী জগমিত সিং । মোদ্দা কথা , এমন একটা ধারণা, কেউ ভাবতে পারেন , এখানে বাস করতে পারাটাই বিশাল একটা ব্যাপার , বা অনেকেই আছেন , ভাবেন , এখানে এই শহরে থাকা , সে তেমন আর কি।

বা প্রচন্ড শীতের এক রাতে সাবওয়ে থেকে নেমে হেঁটে বাড়ি যাচ্ছেন , আপনি ভীষণ ক্লান্ত , প্রতিটি বাড়ি আপনি অতিক্রম করছেন আর তার উষ্ণ জানালা দেখে আপনার মনে হয় , এটিই আপনার নতুন বাড়ি। ভাবছেন , অন্য সবার জীবন আপনার থেকে অনেক ভালো , অনেক সহজ , অনেক কাঙ্ক্ষিত আর অনেকই আলোকিত। গোধূলির দিগন্তরেখায় হলুদ আলোর দিকে তাকিয়ে আছেন আর এই যে শহর জুড়ে ক্ষুদ্র সব জীবন , মৌচাকের মতো একে অন্যের সাথে মাখামাখি করে আছে, আপনি ভাবছেন , এদের প্রত্যেকেই আপনার চেয়ে ভালো করছে , যাপন করছে উষ্ণতর জীবন , বানিয়ে চলেছে না জানি কতো ভালো ঘর ।

বা উৎকন্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করুন বসন্তের। বসন্তের উষ্ণতা যখন ফিরে আসবে, একদিন বেরিয়ে পড়ুন। এটি করবার জন্য আপনাকে পুরো এক শীত, তাও দুর্বিষহ শীত, কাটাতে হবে এই শহরে যাতে আপনি খিটখিটে হয়ে উঠেন , হয়ে উঠেন অলস , অন্তর্মুখী , যেমন ট্রেনের স্যাঁতসেঁতে গুহা থেকে তিক্ত বাতাসে আপনাকে বেরিয়ে আসতে হয়, ঘরে ফিরতে হয় প্রতিদিন, আবহাওয়ার কবলে পরে ক্লান্ত আপনি আর কিছু করবার তাগিদ বোধ করেন না , প্রায়ই ভুলে যান , পরতের পর পরত শীতের জামা , দস্তানা , কোট পরে আপনাকে কেমন দেখায়। বসন্তের উষ্ণতার জন্য আপনাকে ফিরে যেতে হবে , পাঁচ কি দশ বছর আগে , এমন এক সময়ে যখন ঋতুর পরিবর্তন তখনো ছিল নিশ্চিত , আঁচ করা যেত , এখনকার মতো বিভ্রম হবার সুযোগ ছিল না। তাতে দুর্যোগ এখনো কী আসে নি, সেই নিয়ে ভয় নয় , ইতোমধ্যে কী চলে এসেছে , সেই বিভ্রম নিয়ে অন্তত আমরা সবাই একমত হতে পারি। অনেক বছর আগে , মার্চ বা এপ্রিলের কোনো একদিন আপনি হাফ স্লিভ শার্ট এর উপর হালকা একটা জ্যাকেট পরে বেরিয়ে যেতে পারতেন , তারপর কিছুদূর গিয়ে মনে হতো , জ্যাকেটটা না আনলেই হতো , যেই ভাবা, সেই কাজ , জ্যাকেট খুলে আপনি ততক্ষনে হাতে নিয়ে নিয়েছেন। আর এখন? বছরের এই সময় মনে হবে প্রকৃতি আপনাকে করুনা করছে , কল্পনার সেই প্রতিশ্রুতির মতো , আপনার ভালোবাসার মানুষকে মৃত্যু কক্ষনো ছুঁতে পারে না।

শহরের কোনো ব্যাপারই কাউকে বিশেষ কিছু করে না , কারণ শহরগুলো নিজেরা ও তেমন স্পেশাল কিছু নয়। টরন্টো কেবল একটা নাম, আপনি এখানে আপনার জীবনের পরিণত সময় কাটিয়েছেন , টরন্টোয় না থেকে অন্য কোনো শহরে থাকলেও আপনি সেই শহরকে মহিমান্বিত করতেন , কোনো শহরের গল্পই পুরোপুরি সত্য নয় , মূলত শহরের গল্প আপনার নিজের কীর্তন। আমাদের নিজেদের দরকার বড়ো কিছু, আমাদের নিজেদের প্রতিষ্ঠা করবার জন্য , আমাদের গল্পগুলোকে মানে দেবার জন্য , আমাদের প্রতিদিনকার স্বভাবগুলোকে পরিচিতি দেবার জন্য , প্রতিদিন যা ঘটছে , আমাদের আকাঙ্খা , আমাদের নিরাশা ইত্যাদি ব্যাপারগুলোকে তকমা দেবার জন্যে , এসব নিয়েই তো একসাথে জীবন বুনি। মানুষ এই শহরে কেনো থাকবে , সেটি ব্যাখ্যা করা কিছুটা কষ্টসাধ্য ব্যাপার বইকি যদি কিছু সাধারণ এবং নিশ্চিত কারণগুলো বলা না হয়। যেমন একটা ভালো কাজের সুযোগ , একটা বড়ো বেতন বা এই দুটোর জন্যই একটা ভালো নেটওয়ার্ক , অথবা উল্টোটাও হতে পারে। মন্দ কপাল বা দারিদ্র্য বা প্রিয়জনের বিয়োগ বা স্বাস্থ্যহানি। স্বল্প কিছু মানুষের হয়তো সেই সুযোগ আছে , এই শহরে থাকবে কি থাকবে না , সেই পছন্দ বাছাইয়ের , অধিকাংশই এই শহরে আছে , তাদের এই শহর ছেড়ে যাবার সুযোগ নেই বলে। অবশ্য সেটিই কি সত্যি নয় , অন্য অনেকের ক্ষেত্রেও , আরো অন্য শহরে যারা বাস করছে। একটা জায়গায় থাকার মানে তাহলে সেরকম কিছুই নয় , তবুও সে বাস করাটাই একমাত্র জানি , কিভাবে করতে হয়।

তাই এমন কিছু করুন যা আপনার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ , শেষবারের মতো , আপনি বুঝে উঠবার আগেই যে এটিই আপনার শেষ সুযোগ ।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com