1. [email protected] : চলো যাই : cholojaai.net
টিকটক : তরুণ উদ্যোক্তাদের স্বপ্নের বাজার
শুক্রবার, ১০ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:১৪ অপরাহ্ন

টিকটক : তরুণ উদ্যোক্তাদের স্বপ্নের বাজার

  • আপডেট সময় রবিবার, ৫ অক্টোবর, ২০২৫

বাংলাদেশে প্রযুক্তি আর অর্থনীতির ভাষা ক্রমশ বদলে যাচ্ছে। যে তরুণরা একসময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুধু বিনোদনের খোঁজ করতেন, এখন তারা সেখান থেকেই ব্যবসার নতুন সুযোগ খুঁজে নিচ্ছেন। চীনে টিকটকের স্থানীয় সংস্করণ ‘দৌইন’ লাখ লাখ উদ্যোক্তা তৈরি করেছে। বাংলাদেশও সেই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে টিকটক এখন কেবল মজা বা বিনোদনের প্ল্যাটফর্ম নয়। এটি এক নতুন ধরনের ডিজিটাল অর্থনীতির দরজা খুলে দিয়েছে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, ফ্যাশন ডিজাইনার, হস্তশিল্পী কিংবা ফুড ভ্লগার থেকে শুরু করে সবাই এই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে নিজেদের ব্যবসাকে নতুন পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছেন।

বাংলাদেশে ইন্টারনেট বিপ্লব শুরু হয়েছিল মূলত সাশ্রয়ী দামে স্মার্টফোন ব্যবহারের মাধ্যমে। আজ দেশের প্রায় ১৩ কোটি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন। এর মধ্যে তরুণদের অংশগ্রহণ সবচেয়ে বেশি। এ কারণেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো এখন কেবল বিনোদনের ক্ষেত্র নয়, বরং ব্যবসা-বাণিজ্যেরও অন্যতম ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে।

স্ট্যাটিস্টার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ই-কমার্স খাতে ২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম বা ইউটিউবের পাশাপাশি টিকটকও এখন উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ ভূমিকা রাখছে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক ও মোবাইল সাংবাদিকতা বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ড. আব্দুল কাবিল খান জামিলের মতে, “বাংলাদেশের তরুণ সমাজকে যদি টিকটকের সঠিক ব্যবহার শেখানো যায়, তবে এটি কর্মসংস্থানের বড় সুযোগ তৈরি করবে। সরকারের উচিত এই খাতে নীতি প্রণয়ন করা। যাতে তরুণ উদ্যোক্তারা সুরক্ষিত থাকেন।

ছবিটি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স দিয়ে তৈরি

টিকটক : বিনোদন থেকে ব্যবসা

বাংলাদেশে টিকটকের জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে। টিকটকের সবশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে প্রায় ৫ কোটি সক্রিয় টিকটক ব্যবহারকারী আছেন। এর মধ্যে ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সী তরুণ-তরুণীই বেশি।

তরুণেরা টিকটকে সৃজনশীল ভিডিও আপলোডের মাধ্যমে হয়ে উঠছেন ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসসেডর। ফ্যাশন, খাদ্য, ভ্রমণ কিংবা হস্তশিল্প- সব ক্ষেত্রেই ছোট ছোট ভিডিও ব্যবসার প্রচার ও প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

চীনে টিকটকের সংস্করণ ‘দৌইন’ ইতোমধ্যে দেখিয়েছে কীভাবে এই প্ল্যাটফর্ম অর্থনীতির গতিপথ বদলে দিতে পারে। দেশটির ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা বছরে প্রায় ২১০ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করছেন। কৃষক থেকে শুরু করে শহরের উদ্যোক্তা- সবাই এই প্ল্যাটফর্মের সুযোগ নিয়ে নিজের বাজার তৈরি করছেন।

উদ্যোক্তাদের গল্প

ঢাকার মিরপুরের তরুণ উদ্যোক্তা আরিফা রহমান দুই বছর আগে অনলাইনে ব্যবসা শুরু করেন। প্রথমে শুধু ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দিতেন। তবে প্রতিযোগিতা বাড়তে থাকলে তিনি টিকটকে ছোট ছোট ভিডিও প্রচার শুরু করেন।

তিনি বলেন, “শুরুতে ভেবেছিলাম ভিডিও দেখে মানুষ কি আসলেই কিনবে? কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এটি ভালো কাজ দিয়েছে। এখন আমার প্রায় প্রতিটি ভিডিও ভাইরাল হয়। অর্ডারের চাপ এত বেশি হয়ে গেছে যে, আমাকে আলাদা টিম করতে হয়েছে।”

তার ব্র্যান্ড এখন শুধু ঢাকায় নয়, দেশের বিভিন্ন জেলায় এবং প্রবাসীদের কাছেও পৌঁছে গেছে।

রাজশাহীর বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণ মেহেদী হাসান প্রথমে শখের বশে খাবারের ভিডিও বানাতেন। টিকটকে তার ফুড রিভিউ দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে যায়। বলেন, “লোকজন রেস্টুরেন্ট খোলার সময় আমাকে ডাকেন যেন আমি ভ্লগ তৈরি করি। অনেক রেস্টুরেন্ট এখন আমাকে টাকা দিয়ে প্রমোশন করারও অফার দেয়।”

এখন তিনি প্রতি মাসে প্রায় এক লাখ টাকার মতো আয় করেন।

জামালপুরের গৃহিণী আসমাউল হোসনা টিকটকের মাধ্যমে হস্তশিল্প বিক্রি শুরু করেন। ছোট ছোট ভিডিওতে তিনি দেখান কীভাবে ব্যাগ তৈরি করা হয়। ভিডিওগুলো ভাইরাল হওয়ার পর বিদেশ থেকেও অর্ডার আসতে থাকে। তিনি বলেন, “আমি কখনো ভাবিনি, বাড়িতে বসে আমার বানানো জিনিস বিদেশে বিক্রি করতে পারব।”

ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ঘরের বাজারের সেলস অ্যান্ড কাস্টমার এক্সপেরিয়েন্স বিভাগের সমন্বয়ক কাজী কাওছার সুইট বলেন, “টিকটক এখন বাংলাদেশের তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম। ছোট ছোট ভিডিওর মাধ্যমে তারা দ্রুত ব্যবসা বাড়াচ্ছেন এবং ব্র্যান্ড পরিচিতি তৈরি করছেন। সরকারের সঠিক নীতি ও নিরাপদ পেমেন্ট ব্যবস্থা থাকলে এটি আরও বড় সম্ভাবনা তৈরি করতে পারবে।”

চীনের অভিজ্ঞতায় বাংলাদেশ

চীনে দৌইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা লাইভস্ট্রিম করে সরাসরি পণ্য বিক্রি করছেন। চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে সরবরাহও নিশ্চিত করা হচ্ছে। কৃষকরা তাদের ফসল তুলে ধরছেন শহরের গ্রাহকদের কাছে। হস্তশিল্পীরা দেখাচ্ছেন হাতে তৈরি পণ্যের গল্প। আর স্থানীয় উদ্যোক্তারা তাদের তৈরি পোশাক, জুয়েলারি বা ফুড আইটেম সরাসরি গ্রাহকের হাতে পৌঁছে দিচ্ছেন।

এই মডেল কেবল আয় বাড়াচ্ছে না। বরং স্থানীয় উৎপাদনকে আন্তর্জাতিক বাজারে পৌঁছে দেওয়ার সুযোগও তৈরি করছে। চীনে এমন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে উদ্যোক্তারা কেবল দেশীয় বাজারেই নয়, বিদেশি ক্রেতার কাছেও সরাসরি পণ্য বিক্রি করছেন। এর ফলে তারা তৃতীয় পক্ষের সহায়তা ছাড়াই লাভবান হচ্ছেন।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, যদি সরকারের পক্ষ থেকে সঠিক নীতি গ্রহণ করা হয় তাহলে দেশের ডিজিটাল অর্থনীতি অল্প সময়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রসারিত হতে পারে।

তবে শুধু নীতি যথেষ্ট নয়। উদ্যোক্তাদের ডিজিটাল দক্ষতা বাড়ানো, পেমেন্ট গেটওয়ে সহজ করা এবং আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মানের নিশ্চয়তা দেওয়াও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রস্তুতি থাকলে কৃষিপণ্য, হস্তশিল্প, হোমমেড পণ্য- সবকিছুই বাংলাদেশ থেকে দেশ-বিদেশে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে।

চীনের উদাহরণ প্রমাণ করে ছোট ছোট উদ্যোগ ও উদ্যোক্তাদের সুযোগ দিলে ডিজিটাল অর্থনীতি হতে পারে দেশের সবচেয়ে বড় শক্তি। তরুণ উদ্যোক্তাদের সৃজনশীলতা, প্রযুক্তির ব্যবহার এবং আন্তর্জাতিক বাজারের সংযোগ একসাথে মিলিয়ে দেশের অর্থনীতিতে নতুন অধ্যায় শুরু হতে পারে।

ছবিটি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স দিয়ে তৈরি

সম্ভাবনার কথা

বাংলাদেশ সরকার প্রযুক্তিতে দেশকে এগিয়ে নিতে বছরজুড়ে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। টিকটক, ইউটিউব বা ফেসবুকের মতো প্ল্যাটফর্ম এই লক্ষ্য পূরণে বিশেষ ভূমিকাও রাখছে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) সহায়তায় টিকটক উদ্যোক্তাদের ব্যবসার জন্য আরও সুনির্দিষ্ট পরামর্শ দিতে পারবে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ ব্র্যান্ডিং আরও শক্তিশালী হবে।

তরুণ উদ্যোক্তা তাসলিমা আক্তার মনে করেন, শর্ট ভিডিও তৈরির মাধ্যমে ব্যবসার প্রসার বৃদ্ধিতে সরকারি প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করা যেতে পারে। একই সঙ্গে নিরাপদ অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ে নিশ্চিত করা জরুরি।

তিনি আরো বলেন, ‘‘চীনের দৌইন মডেল অনুসরণ করে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের উদ্যোক্তরা কীভাবে আরও এগিয়ে যেতে পারে তা নিয়ে উদ্যোক্তাদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে।’’

বাংলাদেশে টিকটক এখন আর কেবল বিনোদনের মাধ্যম নয়। বরং এটি অর্থনৈতিক রূপান্তরের হাতিয়ার হয়ে উঠছে। চীনের অভিজ্ঞতা দেখিয়েছে, এই প্ল্যাটফর্ম লাখ লাখ উদ্যোক্তা তৈরি করতে পারে। বাংলাদেশও যদি সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারে তবে ভবিষ্যতে টিকটক হতে পারে তরুণদের ব্যবসার অন্যতম বড় প্লাটফর্ম।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Developed By ThemesBazar.Com