ভ্রমণপিপাসু বন্ধুদের জন্য আজ জানাব দারুণ জাপানিজ লোকজ সংস্কৃতির কথা। আমার এক জাপানের বন্ধু হিলাই মিকিতো, সে জাপানে পড়াশোনা করা বিদেশি ছাত্রদের নিয়ে নানা ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠান আয়োজন করে এবং বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ নিয়ে যায়। এ জন্য সে জাপান সরকারের কাছ থেকে সহযোগিতা পায়। কারণ সে জাপানিজ সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য বিদেশিদের মাঝে তুলে ধরে। এর মাধ্যমে বিকশিত হয় জাপানের পর্যটন খাত। ডক্টরেট করার সময় আমি মিকিতো আয়োজিত অনেক অনুষ্ঠানে যোগদান করেছি। তার মধ্যে একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে গিয়ে আমি মুগ্ধ হয়েছি। চলুন পাঠক, জেনে নিই সেই অনিন্দ্যসুন্দর অনুষ্ঠানটি সম্পর্কে।
জাপানের কিছু কিছু অঞ্চলে একটি লোকজ ঐতিহ্য রয়েছে, সেটি হলো ধান কাটা উৎসব। এই ধান কাটা উৎসবে জাপানি ছেলেমেয়েদের বিয়ের অনুষ্ঠানও আয়োজন করা হয়। জাপানের নগর সরকার (বাংলাদেশে আমরা জেলা বোঝাতে পারি) এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানের সমস্ত ব্যয়ভার বহন করে স্থানীয় নগর সরকার। স্থানীয় নগর সরকার প্রতিবছর সেপ্টেম্বরে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। আগে থেকেই তাদের ওয়েবসাইটে অনুষ্ঠানটির বিজ্ঞাপন দেওয়া থাকে এবং বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এই অনুষ্ঠানের প্রচার-প্রচারণা চলে। কারা কারা এই অনুষ্ঠানে যোগদান করবে, তাদের আগে থেকেই রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। কাদের বিয়ে অনুষ্ঠানে সম্পন্ন হবে, তাদেরও আগে থেকেই ঠিক করা হয়ে থাকে। ধান কাটার ক্ষেত এবং অনুষ্ঠানের আয়োজন অনুযায়ী রেজিস্ট্রেশনের সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়। অনুষ্ঠান আয়োজনস্থলে সিমসাম বিয়ের প্যান্ডেল তৈরি করা হয় এবং বিয়ের সমস্ত আয়োজন সেখানে থাকে। গ্রামীণ গানবাজনা, হালকা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও থাকে।
আমরা যখন অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছালাম, তখন সঙ্গে সঙ্গে আমাদের হাতে ধান কাটার কাঁচি, গামবুট এবং হ্যান্ড গ্লাভস দিয়ে দেওয়া হলো। ধানক্ষেতের পাশে গিয়ে আমাদের জিজ্ঞেস করা হলো, কে কতটুকু ধান কাটতে চান। একেকটি গ্রুপকে একেকটি ছোট্ট প্লট বরাদ্দ দেওয়া হলো। ওই জায়গাটুকু ধান কেটে আমাদের আঁটি বেঁধে রেখে আসতে হলো। ধান কাটা শেষে ফেরার পথে নতুন বউ ও বর নতুন ধান হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে অভিনন্দন জানায় কিষানিদের।
এখানে একটি মজার রেওয়াজ আছে। ধান কাটা শেষ করে যাঁরা ফিরবেন, তাঁদের অভিনন্দন জানানোর পাশাপাশি কারো কারো হাতে নতুন বউ ধান তুলে দেবেন। কিন্তু বউ সবাইকে ধান দেবেন না। যে ব্যক্তি নতুন বউয়ের হাত থেকে ধান পাবেন, তাঁকে জাপানের লোকজ সংস্কৃতি অনুযায়ী ভাগ্যবান হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। ধান কাটা ও বিয়ের অনুষ্ঠানের পাশাপাশি আমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য সামান্য খাবারের আয়োজন থাকে, তবে সেটি খুব বেশি নয়। অনাড়ম্বর এই অনুষ্ঠানে বিয়ে হয় গ্রামীণ যুবক-যুবতীদের আর ধান কাটা হয়ে যায় কৃষকের। সঙ্গে বিকশিত হয় দেশের পর্যটন খাত।
কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে ধান কাটাকে আমরা এমনই উৎসবে রূপান্তর করতে পারি না? এই উৎসবের মাধ্যমে গ্রামের অনেক ছেলেমেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজন হয়ে যাবে, ঘরে উঠে যাবে কৃষকের ধান। স্মরণীয় হয়ে থাকবে ধান কাটা ও বিয়ের অনুষ্ঠান। বিকশিত হবে দেশের পর্যটন খাত। বাংলাদেশের জেলা প্রশাসকগণ সম্মানিত সংসদ সদস্যদের নিয়ে এ ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজন করতে পারেন।
লেখক : অধ্যাপক, কীটতত্ত্ববিদ, গবেষক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়