শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:১২ অপরাহ্ন

জলে ভাসার ভেনিস

  • আপডেট সময় সোমবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৩
ইতালি, তথা বিশ্বেরই অন্যতম পর্যটকমুখর শহর ভেনিস। এটি উত্তর-পূর্ব ইতালির ভেনেতো অঞ্চলে অবস্থিত। শহরটি কার্যত ৬০০ বছর আগের মতোই রয়েছে, যা এর চারিত্রিক আকর্ষণের কেন্দ্র। ভেনিস তার বিকাশের দিন থেকে অনেক দূর পেরিয়ে এসেছে, এবং বর্তমানে শহরটিতে প্রচুর পর্যটকের সমাগম ঘটে। সাহিত্য-সংস্কৃতিতেও স্থান পাওয়া ভেনিসে রয়েছে ৫৬,০০০ বাসিন্দা। প্রতি বছর এই প্রাচীন নগরীতে ২০ মিলিয়ন পর্যটকের সমাগম ঘটে।
ভেনিস শহরটি খুব বেশি বিশাল না হলেও এটি অনেকগুলো পৌরসভায় বিভাজিত। সবচেয়ে বিখ্যাত প্রধান জেলাগুলো ১১৮টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত এলাকা, যেগুলোকে ‘সেস্টিরি’ বলা হয়। এদের নাম ক্যানারেজিও, কাস্তেলো, ডরসোদুরো, সান পোলো, সান্তা ক্রোচ, এবং সান মার্কো, যেখানে প্রধান স্মৃতিস্তম্ভ এবং দর্শনীয় স্থানগুলো অবস্থিত। অন্যান্য প্রধান জেলা হলো আইসোলা ডেলা গিউডেকা এবং লিডো ডি ভেনেজিয়া। লেগুনের আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপের মধ্যে রয়েছে মুরানো, তোরসেলো, সান ফ্রান্সেসকো দেল ডেসার্টো এবং বুরানো।
ইতিহাস
ভেনেতোর লোকেরা দীর্ঘকাল ধরে উত্তর-পূর্ব ইতালিতে বসবাস করত। আধুনিক ভেনিসের দ্বীপগুলোতে দীর্ঘকাল বসবাস করেছিল ‘লেগুনার’ নামে পরিচিত অল্প জনসংখ্যার মৎস্যজীবীরা। তবে, শহরের প্রকৃত সূচনা হয়েছিল যখন শরণার্থীরা লুটপাটকারীদের বর্বরতা থেকে বাঁচতে আশেপাশের রোমান শহরগুলো থেকে জলাভূমিতে পালিয়ে আসে। অভিবাসীদের প্রথম স্রোত ১৬০ খ্রিস্টাব্দে কুয়াদি এবং মারকোমান্নি থেকে পালিয়ে যায়। ৫ম শতাব্দীতে, ভিসিগোথ এবং হুন থেকে পালাতে আরও বেশি লোক এসেছিল, এবং ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে আরও বেশি লোক লোমবার্ডস থেকে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজতে এসেছিল এখানে।
বাইজেন্টাইন শাসন পশ্চিমী রোমান সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে যাওয়া, এবং লোম্বার্ডি উপহ্রদ থেকে হুমকির মুখে পড়ায় ভেনিস ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে পূর্ব রোমান (বাইজেন্টাইন) সাম্রাজ্যের সাহায্যকে স্বাগত জানায়।
বাইজেন্টাইনরা উপকূলীয় স্ট্রিপটিকে রেভেনার এক্সারচেটে সংগঠিত করে কনস্টান্টিনোপল থেকে এর শাসন শুরু করে। শুধুমাত্র দূরত্ব এবং ভেনিসের সাথে ভূমি সংযোগের অভাব ভেনিসকে আরও বিচ্ছিন্ন করে রাখে, এবং কালক্রমে এই বিচ্ছিন্নতা ভেনিসের স্বায়ত্তশাসনের আকাঙ্ক্ষার জন্ম দেয়। পরবর্তীতে ৭২৬ সালে একটি বিদ্রোহ শুরু হয়, এবং বাইজেন্টাইন এক্সার্ককে হত্যা করা হয়। তারপর ভেনিসিয়ানরা তাদের ১১৭টি ডোজ (ডিউক) এর একটি দীর্ঘ সিরিজের প্রথমজনকে নির্বাচিত করে। কিন্তু, ভেনিস অবিলম্বে তাদের নতুন নেতার অধীনে থেকে বাইজেন্টাইনদের কাছে নিজেকে পুনরায় সমর্পন করে; অবশ্য এই কৌশল সম্ভবত পাপাল বা লম্বার্ডের আধিপত্য এড়ানোর জন্য।
ভেনিসের উত্থান
৯ম এবং ১২শ শতাব্দীর মধ্যে ভেনিস ধীরে ধীরে একটি সম্পূর্ণ স্বাধীন নগররাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়। এর নৌ এবং বাণিজ্য শীঘ্রই পূর্ব, পশ্চিম ও মধ্য ইউরোপের বেশিরভাগ অংশের মধ্যে সংযোগ হিসেবে মর্যাদা পেতে থাকে। ভেনিসের বিশিষ্টতা ছিল অন্যান্য স্থলভাগের সাথে এর বিচ্ছিন্নতায়। আবার আল্পাইন পাস ও কাছাকাছি ব্যবসায়িক অঞ্চলের নিকটে এর আদর্শ অবস্থানের জন্য ভেনিস হয়ে ওঠে গুরুত্বপূর্ণ। তাই দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন প্রয়োজন পূরণ করতে ভেনিসে বিকাশ লাভ করে জলবাহিত জীবনধারা। ক্রিট, এজিয়ান দ্বীপপুঞ্জের একটি গুচ্ছ, ইস্ট্রিয়ান উপদ্বীপ, ডালমেশিয়ান উপকূল এবং ভেনিস থেকে আল্পাইন ঢাল পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ অঞ্চলগুলো একসময় একটি সাম্রাজ্য গঠিত হয়। ১৩০০ সালের মধ্যে, ভেনিস ইউরোপ মহাদেশের সবচেয়ে ধনী শহরে পরিণত হয়। মধ্যযুগে ভেনিস বাইজেন্টাইনদের সাথে মূল্যবান বাণিজ্য সুবিধা অর্জন করে। পাশাপাশি, সফলভাবে পোপতন্ত্রের ক্ষমতাকে প্রতিরোধ করে এবং ‘বিশ্বের মুদ্রণ রাজধানী’ হয়ে ওঠে।
ভেনিসের পতন
একসময় ভেনিস অটোমানদের কাছ থেকে থেসালোনিকি এবং কনস্টান্টিনোপল রক্ষার ব্যর্থ চেষ্টা করে। যার শেষ ফলাফল ছিল একটি ব্যয়বহুল ৩০ বছরের যুদ্ধ এবং তাদের প্রচুর বিদেশী সম্পত্তির ক্ষতি। এরপর, ১৪৯০-এর দশকে পর্তুগিজরা এশিয়ায় নতুন রুট আবিষ্কারের ফলে ভূমধ্যসাগরীয় বাণিজ্যের আপেক্ষিক মূল্য হ্রাস পায়। অবশেষে, ১৫৭৫, ১৫৭৭ এবং ১৬৩০ সালের প্লেগ মহামারী ভেনিসের জনসংখ্যাকে ব্যাপকভাবে হ্রাস করে।
১৭৯৭ সালে নেপোলিয়নের অধীনে ভেনিস ফরাসিদের দ্বারা জয়লাভ করে, তারপর ১৭৯৮ সালে দ্রুত অস্ট্রিয়ান শাসনে স্থানান্তরিত হয়। নেপোলিয়ন আবার ১৮০৫ সালে শহরটি দখল করেন, এবং ১৮১৪ সালে আবার অস্ট্রিয়ার কাছে একে হারান। ১৮৪৮ সালে একটি বিদ্রোহ শুরু হয়, কিন্তু ১৮৪৯ সালে পরাজিত হয়। অবশেষে , ১৮৬৬ সালে ভেনিস তৎকালীন কিংডম অব ইতালিতে যুক্ত হয়।
নেপোলিয়নের ভেনিস আক্রমণ
মুসোলিনির অধীনে, ১৯৩৩ সালে, ভেনিসের দীর্ঘকালের ইহুদি জনগোষ্ঠীকে নির্বাসিত করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, এই শহরের কেন্দ্রে খুব বেশি বোমা হামলা করা হয়নি, তবে মূল ভূখণ্ডের সাথে এর রেল সংযোগ এবং এর কয়েকটি শিল্প এলাকা লক্ষ্যবস্তু ছিল। ২৯ এপ্রিল, ১৯৪৫ সালে মিত্রবাহিনীর সৈন্যরা শহরটিকে মুক্ত করতে আসার পর্যায়ে বিদ্রোহীরাই নাৎসি নিয়ন্ত্রণ থেকে একে মুক্ত করে ফেলে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ভেনিসের জনসংখ্যা ৫০% সংকুচিত হয়েছে। কারণ, অনেকেই মূল ভূখণ্ডে চলে গেছে। তবে বর্তমানে শহরটিতে পর্যটনশিল্প বিকাশ লাভ করছে, এবং শহরের অর্থনীতির মূল ভিত্তি হয়ে উঠেছে। ১৯৬৬ সালে এক বিধ্বংসী বন্যা সত্ত্বেও শহরটি পুনরায় মাথা তুলে দাঁড়ায়, এবং ইউরোপের শীর্ষ পর্যটন-গন্তব্যে পরিণত হয়েছে।
গন্ডোলার শহর
কয়েক শতাব্দী আগে, গন্ডোলা ছিল ভেনিসের পরিবহনের প্রধান মাধ্যম। তবে সময়ের পরিক্রমায় বর্তমানে এটি খুব জনপ্রিয় পর্যটক আকর্ষণ হয়ে উঠেছে, এবং সম্ভবত ভেনিসের সবচেয়ে স্বীকৃত প্রতীক। গন্ডোলা একটি ঐতিহ্যবাহী সরু এবং দীর্ঘকায় ভেনিসিয়ান দাঁড়টানা নৌকা। একটি লম্বা বৈঠার সাহায্যে নৌকাটি চলে, নৌকাচালককে বলে গন্ডোলিয়ার। যদিও কয়েক শতাব্দী আগে গন্ডোলাগুলো ভেনিসে পরিবহনের প্রধান মাধ্যম ছিল, আজ এটি পর্যটকদের শহরের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যায়। সপ্তদশ শতাব্দীতে খালগুলো গন্ডোলা দিয়ে পরিপূর্ণ ছিল। আজকাল সেখানে একশোরও কম গন্ডোলা আছে।
গন্ডোলা ভেনিসের অন্যতম আকর্ষণ, এবং পর্যটকদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। এর সুবিধা- এগুলো পর্যটককে শহরের এমন কিছু অংশে নিয়ে যেতে পারে যা অন্য কোনো উপায়ে যাওয়া সম্ভব না। শহরের মাঝে দুর্গম স্থানের একমাত্র বাহন বলা চলে।
ভেনিসে গন্ডোলা রাইড সম্পর্কে মনে রাখার দুটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম রয়েছে:
যদি ভাড়া আপনার কাছে বেশি মনে হয়, তবে এড়িয়ে চলুন।
যদি দাম আপনার কাছে বেশি মনে না হয়, তবে নিশ্চিত করুন যে আপনি গন্ডোলিয়ারকে আপনার গন্তব্য সঠিকভাবে বোঝাতে পেরেছেন।
আসলে, ভেনিসের একটি গন্ডোলা ক্রুজ হলো নিউ ইয়র্কের সেন্ট্রাল পার্কে ঘোড়ার গাড়িতে ভ্রমণ করার মতো। অবশ্য, অভিজ্ঞতা আনন্দদায়ক হতে পারে, শুধুমাত্র যদি আপনি ভাড়ার চিন্তা ভুলে ভ্রমণ উপভোগ করতে সক্ষম হন।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com