“যদি সুন্দর একখান মুখ পাইতাম
যদি নতুন একখান মুখ পাইতাম
মহেশখালীর পানের খিলি তারে বানাই খাবাইতাম”
কেউ মহেশখালী যাক আর না যাক, মহেশখালীর পানের খিলি খাক আর না খাক কিন্তু শেফালী ঘোষের গাওয়া এই বিখ্যাত গানটি সবারই শোনা আছে। শেফালী ঘোষের এই গানের মাধ্যমেই নাকি মহেশখালীর নাম সারা বাংলাদেশের মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। তখনও নাকি কক্সবাজারের মতো মহেশখালী তেমন পরিচিত ছিল না। মহেশখালীর প্রাকৃতিক রূপ সৌন্দর্যের কথা দেশের অধিকাংশ মানুষ জানতো না। আর বর্তমানের দৃশ্যপট পাল্টে গেছে, এখন মহেশখালী একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন স্পট। যে কেউ কক্সবাজারে ঘুরতে গেলে, মহেশখালী ঘুরে দেখার জন্য একদিন হাতে রাখেই যাওয়ার চেষ্টা করে। আমি তো দুই এক বছরের মধ্যে অন্তত একবার হলেও কক্সবাজারে যাই কিন্তু বিগত সাত বছর যাবত মহেশখালী যাওয়া হয়নি। গতবছর কক্সবাজার গিয়ে সমুদ্র সৈকতে এক ছোট্ট মেয়ের কন্ঠে শেফালী ঘোষের এই বিখ্যাত গানটি শুনতেই সিদ্ধান্ত নিলাম মহেশখালী ঘুরতে যাব। যেই ভাবনা, সেই কাজ। পরের দিন সকালে আমরা বন্ধুরা মিলে কক্সবাজার থেকে মহেশখালীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম।
কক্সবাজারের বিআইডব্লিউটিএ এর ৬ নাম্বার ঘাটে গিয়ে দেখি বঙ্গোপসাগর চ্যানেলটি বেশ উত্তাল হয়ে আছে। এই অবস্থা দেখে আমাদের গলা শুকিয়ে কাঠ। দুজন বললো, যেতে হবে না কিন্তু আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল ছিলাম। একজন প্রস্তাব রাখে সড়কপথে চকরিয়া থেকে বদরখালী হয়ে মহেশখালী যেতে কিন্তু এতে অনেক সময় লাগবে। তাই বুকে অনেক সাহস সঞ্চয় করে স্পিডবোটে করেই রওয়ানা দিলাম।
স্পিডবোটে মাত্র ১৫/২০ মিনিটের পথ কিন্তু এই সময়র মধ্যেই আমাদের সবার চোখে পানি এসে গেল। অবস্থা ছিল এমন, ঢেউয়ের বাড়িতে স্পিডবোট যেন ভেঙে চৌচির হয়ে যাবে। প্রাণভয়ে আমাদের একজন হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিয়ে ছিল। যাইহোক, বিশাল এক দুঃসাহসিক অভিযান সেরে আমরা পৌঁছে গেলাম মহেশখালীর জেটির ঘাটে। এই জেটি ঘাটটি ১৯৮৯ সালে কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ড স্থাপন করে।
ঝাউবনের মধ্যে দিয়ে ১৮২টি পিলারের ওপর জেটি দণ্ডায়মান। জেটি স্থাপন হওয়ার আগে মহেশখালীর যাতায়াত ব্যবস্থা ছিল নাজুক। স্পিডবোট থেকে নেমে ঝাউবনের মধ্যে দিয়ে চলে যাওয়া সরু জেটি ধরে হাঁটতে শুরু করলাম।
দু’পাশে ঝাউবন, সুনসান নীরবতা, সাঁইসাঁই বাতাস সময়টাকে আরো রোমাঞ্চকর করে তুলেছে। ইতিমধ্যেই আমাদের সব ভয় কেটে যেন একটা আলাদা প্রশান্তি অনুভব করছি। জেটির শেষ প্রান্তে এসে মিলল রিকশা এবং টমটম। সারাদিনের জন্য আমরা একটা টমটম ভাড়া করে নিলাম।
টমটম যোগে প্রথমে গেলাম রাখাইন পাড়ায়। সেখানে বেশ কিছু সময় ঘুরে দেখলাম তাদের জনজীবন, হস্ত ও বস্ত্র শিল্পের কারুকাজ।
কারো কারো সাথে গল্প করেছি এবং তাদের ব্যবহারে বেশ মুগ্ধ হয়েছি। এদের বাংলায় কথা বলার ধরণটা আমার শুনতে বেশ মজা লাগে। তবে শুধু গল্প-ই করিনি, পছন্দমত আমরা কিছু হস্ত ও বস্ত্রশিল্প কিনে নিলাম।
তারপর এদের থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলাম স্বর্ণমন্দিরে। মুগ্ধ হয়ে অসাধারণ স্থাপত্য নিদর্শন, দৃষ্টিনন্দন, কারুকার্যখচিত স্বর্ণমন্দির দেখতে দেখতে একসময় পেটে প্রচন্ড রকম ক্ষুধা অনুভব করলাম। তখন কাছেই একটা খাবার হোটেলে ঢুকে সামুদ্রিক কোরাল মাছ ও বিভিন্ন ধরণের শুঁটকি ভর্তা দিয়ে দুপুরের খাবার সেরে নিলাম। তারপর সোজা চলে গেলাম মৈনাক পাহাড়ে। সেখানেই অবস্থিত আছে প্রায় ৫০০ বছরের পুরানো আদিনাথ মন্দির।
পাহাড়ের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলাম। পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছেই চারপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। ঘুরে ঘুরে আদিনাথ মন্দিরের চারপাশ দেখলাম। প্রতি বছর মার্চের ৪ তারিখ চতুর্দশী মেলা বসে এখানে, লাখ লাখ মানুষের মিলনমেলা হয়। তখন এই স্থানটি হয়ে ওঠে বাঙালির ঐতিহ্যের ধারক-বাহক। ইচ্ছে ছিল সোনাদিয়া দ্বীপ ঘুরে দেখার কিন্তু সবারই ছিল ফিরে যাওয়ার তাগিদ। তাই পরবর্তীতে সোনাদিয়া দ্বীপ দেখার ইচ্ছে রেখে আবারও ফিরে গেলাম কক্সবাজার। আর হ্যাঁ, ফেরার পথে মহেশখালীর কিছু পানের খিলি সঙ্গে করে নিয়ে এসে ছিলাম।
যেভাবে যাবেনঃ
ঢাকা থেকে সরাসরি বাসে বা প্লেনে করে কক্সবাজার যাওয়া যায়। ট্রেনে করে যেতে হলে চট্টগ্রাম স্টেশনে নেমে কক্সবাজারের বাস ধরতে হবে। কক্সবাজারের কলাতলী, সুগন্ধা ও লাবণী বীচ থেকে রিকশা বা টমটম করে বিআইডব্লিউটিএ এর ৬ নাম্বার ঘাটে যেতে হবে। সেখানে থেকে স্পিডবোট বা ট্রলারে করে মহেশখালী যেতে হবে। স্পিডবোটে মাথাপিছু ৭৫ টাকা ও ট্রলারে ৩০ টাকা খরচ পড়বে।
সৈয়দ আসাদুজ্জামান সুহান