প্রকৃতির নির্মল রসায়নের এক অপরূপ আনন্দধারার দেখা পাবেন হাওরের বাঁকে বাঁকে। সবকিছু মিলিয়ে প্রকৃতির একটি অনবদ্য উপন্যাসের শতসহস্র ছন্দের উপকথার সঙ্গে পরিচিত হতে পারবেন আপনি।
চারদিকে থৈথৈ পানি, সাগরের মতো ঢেউ আর দূরে দূরে ছোট ছোট হাওর দ্বীপ—এসবই মুগ্ধ করবে আপনার মনকে। হাওর হলো এমন একটি বিস্তীর্ণ এলাকা, যেখানে বৃষ্টি মৌসুমে থৈথৈ জলে পরিপূর্ণ হয়ে যায়, সমুদ্রের মতো ঢেউ থাকে। আবার শীতকালে শুকিয়ে খোলা প্রান্তর হয়ে যায়। কোথাও ফসল চাষ করা হয়, কোথায় গবাদিপশু চড়ে বেড়ায়
বাংলাদেশে এমন অনেক হাওর রয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত দুটি হাওরের মধে একটি হাকালুকি হাওর । এবারের শীতকালে হাকালুকি হাওর দেখে আসতে পারেন এ ভ্রমণে।
হাকালুকি
হাকালুকি হাওর মৌলভীবাজার ও সিলেট জেলার পাঁচটি উপজেলাজুড়ে বিস্তৃত। ২৩৮টি বিল ও নদী মিলে তৈরি হয়েছে প্রায় ৬০ হাজার একরের এ হাওর। বর্ষাকালে একে হাওর না বলে সমুদ্র বলা যায় অনায়াসে। জীববৈচিত্র্যে ভরপুর এ হাওরে নানা প্রজাতির মাছ রয়েছে। বর্ষায় থৈথৈ পানিতে নিমগ্ন হাওরের জেগে থাকা উঁচু স্থানগুলোতে অনেক পাখি আশ্রয় নেয়। আর শীতের সময়ে হাজার হাজার পরিযায়ী পাখি মেলা বসায় হাওরের বুকে।
হাকালুকি নামকরণ নিয়ে কিছু কথা প্রচলিত আছে। জানা যায়, অনেক বছর আগে ত্রিপুরার মহারাজা ওমর মানিক্যের সেনাবাহিনীর ভয়ে বড়লেখার কুকি দলপতি হাঙ্গর সিং জঙ্গলপূর্ণ ও কর্দমাক্ত এক বিস্তীর্ণ এলাকায় এমনভাবে লুকি দেয় বা লুকিয়ে যায় যে, কালক্রমে ওই এলাকার নাম হয় ‘হাঙ্গর লুকি’, ধীরে ধীরে তা ‘হাকালুকি’-তে পরিণত হয়। আবার অনেকে এ মতের বিরোধিতা করেন। তাঁদের মতে, প্রায় দুই হাজার বছর আগে প্রচণ্ড এক ভূমিকম্পে ‘আকা’ নামে এক রাজা ও তাঁর রাজত্ব মাটির নিচে সম্পূর্ণ তলিয়ে যায়। কালক্রমে এই তলিয়ে যাওয়া নিম্নভূমির নাম হয় ‘আকালুকি’ বা হাকালুকি। এখানে আরো কিছু মত প্রচলিত আছে, তবে একটিও পুরোপুরি তথ্যভিত্তিক নয়।
কীভাবে যাবেন
হাকালুকি যাওয়ার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো ট্রেন। নামতে হবে মাইজগাঁও স্টেশনে। এটি সিলেটের ঠিক আগের স্টেশন। মাইজগাঁও থেকে দুটি উপায়ে যাওয়া যায় হাকালুকি।
ফেঞ্চুগঞ্জ বাজার হয়ে : মাইজগাঁও নামার পর গাছপালা ঘেরা একটা রাস্তা ধরে প্রায় এক কিলোমিটার হাঁটলেই পৌঁছে যাবেন ফেঞ্চুগঞ্জ বাজার। সকালবেলা হাঁটতে ভালোই লাগবে। আবার একটু অপেক্ষা করলে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা পাবেন। তাতে করে ১০ মিনিটে ফেঞ্চুগঞ্জ বাজার।
বাজারে নেমেই আল মুমিন রেস্টুরেন্টে বসে যাবেন। সেখানে ফ্রেশ হয়ে, হাত-মুখ ধুয়ে নাশতা করে সামনের নৌকাঘাটে চলে আসুন। এখান থেকে নৌকা দরদাম করে উঠে পড়ুন সারা দিনের জন্য। বড় গ্রুপ হলে (১০/১৫ জন) বড় ছইওয়ালা ট্রলার দিন। দিনপ্রতি ভাড়া নিতে পারেন (অবশ্যই দামাদামি করবেন)। কিছু খাবার এবং পানি কিনে নিন, কারণ হাওর ও কোনো দোকানপাট পাবেন না। এবার নৌকায় উঠে কুশিয়ারা নদী পাড়ি দিয়ে হাওরে ঘুরে বেড়ান। কুশিয়ারা পারি দিতে প্রায় ৪০ মিনিট লাগবে।
গিলাছড়া বাজার হয়ে : কুশিয়ারা নদীর ৪০ মিনিট সেভ করতে মাইজগাঁও থেকে সরাসারি ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ে চলে আসতে পারেন গিলাছড়া বাজারে। এখান থেকেই হাওর শুরু। তবে সমস্যা হলো এখানে বড় নৌকা পাওয়া যায় না। নৌকা আনতে হবে সেই ফেঞ্চুগঞ্জ বাজার থেকেই। এখানকার লোকজন খুব অতিথিপরায়ণ। তাঁরা আপনাকে নিজেদের বাসায়ে নিয়ে যাবে এবং টয়লেট ইউজ করতে দেবে।
যা দেখবেন : পুরো হাওরই দেখার মতো। সমুদ্রের মতো বিশাল ঢেউ, চারদিকে পানি আর পানি। অনেক দূরে দূরে গ্রাম। চলে যেতে পারেন এমনি কোনো গ্রামে। সারা দুপুর কাটিয়ে বিকেলে ফিরে আসতে পারেন।
গ্রাম ইসলামপুর। ইসলামপুর গ্রামটি হাওরের মধ্যে একটি সমৃদ্ধ গ্রাম। এখানে যেতে ফেঞ্চুগঞ্জ থেকে প্রায় দুই ঘণ্টা লাগবে। গ্রামে নেমে কোনো একটি বাড়িতে গিয়ে রান্না করার অনুরোধ করতে পারেন। তাঁরা করে দেবেন। রাতে থাকতে চাইলে তাঁদের বাড়িতে থাকতে পারেন। এ ছাড়া ইসলামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নামের একটি স্কুল আছে। থাকতে পারেন তার মেঝেতেও। আর নৌকার ছাদে থাকলে তো কথাই নেই।
যে বিষয়ে বিরত থাকবেন :
১. হাওরে, পাহাড়ে অথবা নদীতে কোনোক্রমেই চিপস, সিগারেট, বিস্কিটের প্যকেট অথবা অন্য যেকোনো ধরনের ময়লা ফেলবেন না।
২. ময়লা রাখার জন্য নিজেদের কাছে একটি পলিব্যাগ রাখুন, পরবর্তী সময়ে নির্দিষ্ট কোনো ডাস্টবিনে ময়লা ফেলুন।
৩. অনেকেই সেখানে নেশা করে এবং সেই বোতলগুলো পানিতে নিক্ষেপ করে। বিষয়টা প্রচণ্ড দুঃখজনক। দয়া করে এ ধরনের জঘন্য অপকর্ম হতে নিজে বিরত থাকবেন এবং অন্যকেও সচেতন করার চেষ্টা করবেন।