শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৪৩ অপরাহ্ন

চীনে নারীরা কেন সন্তান নিতে অনিচ্ছুক

  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

চীনে সন্তান জন্মের হার উদ্বেগজনকভাবে কমেছে। ১৯৬০–এর দশকের পর সন্তান জন্মের হার দেশটিতে সবচেয়ে কম। চীনের জনসংখ্যা জরিপ থেকে জানা গেছে এমন তথ্য। পরিস্থিতি এতটাই উদ্বেগের যে বিশেষজ্ঞরা চীনে জন্মনিয়ন্ত্রণ নীতির কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে আহ্বান জানিয়েছেন।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীনে নতুন প্রজন্মের অনেক নারীই সন্তান নিতে অনিচ্ছুক। এমনই এক নারী হলেন বেইজিংয়ের লিলি (ছদ্মনাম)। দুই বছর হলো বিয়ে হয়েছে লিলির। ৩১ বছর বয়সী এ নারীর এখন পর্যন্ত মা হওয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই।

বিবিসিকে লিলি বলেন, মায়েরা সবচেয়ে ভালো মা হতে পারছেন কি না, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভোগেন। সন্তানকে কীভাবে ভালো স্কুলে ভর্তি করাবেন, তা নিয়ে চিন্তা থাকে। সন্তান লালনপালনের ব্যয়ভার নিয়েও হিমশিম অবস্থা থাকে। পেশাগত জীবনেও প্রভাব পড়ে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি বেশ খারাপ থাকে।

লিলি এটাও জানান, তিনি যেভাবে ভাবছেন, তাঁর মা সেভাবে পুরো বিষয়টা ভাবেননি। এমনকি তিনি যে সন্তান নিতে চান না, মা তা জানলে মানসিক আঘাত পাবেন। সন্তান লালনপালন নিয়ে আর্থিক ও সামাজিক সুবিধা থাকলে পরিস্থিতি অন্য রকম হতে পারত বলে মনে করেন লিলি।

এ মাসের শুরুতে চীনে জনসংখ্যা নিয়ে জরিপ প্রকাশিত হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, গত বছর দেশটিতে ১ কোটি ২০ লাখ শিশুর জন্ম হয়েছে। ২০১৬ সালে দেশটিতে ১ কোটি ৮০ লাখ শিশুর জন্ম হয়। ১৯৬০–এর দশকের পর চীনে সবচেয়ে কমসংখ্যক শিশুর জন্ম হয়েছে গত বছর।

এমন জরিপের পর শিগগিরই জনসংখ্যা নিয়ে সংকটে পড়বে বলে আশঙ্কা করছে চীন। এমনটা ঘটলে চীনের জনসংখ্যায় তরুণদের চেয়ে বয়স্কদের সংখ্যা বেশি হতে পারে।

ন্যাশনাল ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকসের প্রধান নিনগ জিজহে বলেন, জন্মহার কম থাকায় চীনে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে। আবার কোনো দেশ উন্নত হলে শিক্ষা ও পেশাগত জীবনে উন্নয়নের সুযোগ তৈরি হয়। ফলে জন্মহারও কমে যায়।উদাহরণ হিসেবে চীনের প্রতিবেশী দেশ জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার কথা বলা যায়। বেশি সন্তান নেওয়ার জন্য সরকার দম্পতিদের বিভিন্ন প্রণোদনা দেওয়ার পরও এ দুটি দেশে সাম্প্রতিক কয়েক বছরে জন্মহার রেকর্ড পরিমাণে কমেছে।

লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীনের সামাজিক পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। কারণ, বিয়ের জন্য উপযুক্ত পাত্রী খুঁজে পাওয়া চীনের পুরুষদের পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক পুরুষই পারিবারিক জীবন শুরুর কথা ভাবতে পারছেন না। জনসংখ্যা জরিপ বলছে, গত বছর দেশটিতে নারীর তুলনায় পুরুষের সংখ্যা ৩ কোটি ৪০ লাখ ৯ হাজার বেশি ছিল।

জনসংখ্যার বৃদ্ধি কমাতে ১৯৭৯ সালে চীনে এক সন্তান নীতি চালু হয়। এ কারণেই দেশটিতে এমন সংকট দেখা দিয়েছে বলে মত রয়েছে। বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের মতো চীনা সমাজব্যবস্থাতেও মেয়েসন্তানের চেয়ে ছেলেসন্তান বেশি আকাঙ্ক্ষিত। চীনে এক সন্তান নীতির কারণে অনেক দম্পতিই গর্ভপাত ঘটান। ১৯৮০–এর দশকে চীনে ছেলেসন্তানের জন্মহার হঠাৎই বেড়ে যায়।

ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরসের সোশিওলজি ডিপার্টমেন্টের ড. মু ঝেং বলেন, লৈঙ্গিকবৈষম্যের কারণে বিয়ের ক্ষেত্রে কনে পেতে সংকটে পড়েছেন পুরুষেরা।

২০১৬ সালে চীনের সরকার ‘এক সন্তান নীতির’ অবসান ঘটায়। সরকার দম্পতিদের দুই সন্তান নেওয়ার অনুমতি দেন। তবে নীতি বদলের পরও দেশটিতে জন্মহার কমছে। পরিস্থিতির খুব বেশি বদল ঘটেনি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক সন্তান নীতিতে বদল আনলেও চীনে শিশুদের শিক্ষা বা সামাজিক সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকার কোনো পরিকল্পনা নেয়নি। আর্থিক কোনো প্রণোদনাও দেওয়া হয়নি। বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, জীবনযাপনের খরচ বেড়ে যাওয়ায় চীনে শিশুদের লালনপালনের ব্যয়ভার অনেকেই নিতে চান না।

ড. মু বলেন, উন্নত শহরগুলোতে মানুষের জীবনে সাফল্য নিয়ে ভাবনায় বদল এসেছে। সন্তান লালনপালনের ব্যয়ভারের কারণে অনেকে সন্তান নিতে অনাগ্রহ দেখাচ্ছেন। বিয়ে ও সন্তান জন্মের চেয়ে জীবনযাত্রার মান উন্নত করাকে সাফল্য হিসেবে মনে করছেন অনেকে।

চীনে নারীদের সন্তান না নিতে চাওয়ার পেছনে আরও কারণ রয়েছে। বেশির ভাগ দেশের মতো চীনেও সমাজব্যবস্থার কারণে সন্তান লালনপালনের ভার নারীদের ওপরই থাকে। ড. মু বলেন, সন্তান লালনপালনের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেক নারীই পেশাগত জীবনে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এমন আশঙ্কা করে থাকেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ব্যক্তি জানান, চীনে নারীদের জন্য এখনো ভালো কর্মসংস্থানের সুযোগ কম। যেসব নারী ভালো চাকরি করেন, তাঁরা যেকোনো মূল্যে সেটি চালিয়ে যেতে চান। পেশাগত জীবনে উন্নতি করতে চান। ওই ব্যক্তির প্রশ্ন, ‘এ পরিস্থিতিতে কে সন্তান নেওয়ার মতো সাহস দেখাবে?’

সাম্প্রতিক বছরে চীনের কিছু শহরে মাতৃত্বকালীন ছুটি বাড়ানো হয়েছে। ৯৮ দিনের বেশি ছুটির জন্য আবেদন করতে নারীদের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। আবার এ পরিস্থিতিকে কর্মক্ষেত্রে লৈঙ্গিকবৈষম্য বলেও মনে করছেন অনেকে। গত মার্চে চংকুইং নামের এক নারী চাকরির আবেদন করেন। অন্তঃসত্ত্বা হলে চাকরি ছেড়ে দেবেন, এমন শর্ত মেনে নিতে তাঁকে বাধ্য করে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান।

আশা এখনো আছে
আগামী তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে চীনে সন্তান জন্মের ব্যাপারে বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হতে পারে বলে রয়টার্সকে একটি সূত্র জানিয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞদের অনেকে জন্মনিয়ন্ত্রণ নীতিতে অবিলম্বে কাটছাঁট করতে চীনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

চীনের সেন্ট্রাল ব্যাংকের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনে গবেষকেরা বলছেন, ‘সন্তান নেওয়ার ব্যাপারে চীনে এখন দম্পতিদের পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া প্রয়োজন। কারণ, এখনো হয়তো কিছু দম্পতি সন্তান নিতে চান। যখন আর কেউই সন্তান নিতে চাইবে না, তখন নীতি বদলানো অর্থহীন হয়ে পড়বে। আমাদের এ নিয়ে দ্বিধায় ভোগার কোনো কারণ নেই।’

তবে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে এ নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। গ্রামাঞ্চলে ও শহরাঞ্চলে পরিস্থিতি আলাদা হওয়ায় বিশেষজ্ঞরা জন্মনিয়ন্ত্রণ নীতিতে এখনই বদল আনতে চান না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেইজিং ও সাংহাইয়ের মতো উন্নত শহরগুলোতে যেসব নারী বসবাস করেন, তাঁরা দেরিতে সন্তান নিতে চান। অথবা সন্তানের জন্ম দিতে চান না। কিন্তু যেসব নারী গ্রামাঞ্চলে থাকেন, তাঁদের পরিবার এখনো বড়।

সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নীতিনির্ধারকদের একজন রয়টার্সকে বলেছেন, যদি পরিবার পরিকল্পনা নীতি উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়, তাহলে গ্রামাঞ্চলে সন্তান জন্মের হার বেড়ে যাবে। এতে গ্রামাঞ্চলে দারিদ্র্য বাড়বে। বেকারত্ব তৈরি হবে।

তবে জিয়ান জিয়াওটং ইউনিভার্সিটির জনসংখ্যাতাত্ত্বিক ড. জিয়াং কুয়ানবাও বলেন, সন্তান লালনপালন ও শিক্ষার জন্য পরিবারগুলো প্রণোদনা পেলে পরিস্থিতি বদলাতে পারে। এখনো আশা আছে। খুব বেশি দেরি হয়ে যায়নি।

বিবিসি

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com