যখন সূর্যাস্ত হয়, তখন সূর্যাস্তের আলোয় আকাশে ধোঁয়ার মতো আলোকিত হয়। আকাশে লাল ও থিয়েন হ্রদের নীল পরস্পরকে প্রতিবিম্বিত করে। সে সময় বাতাস এমনভাবে উত্থিত হয়, তখন আমি যেন সবচেয়ে সুন্দর সংগীত শুনেছি।
আর পাহাড়ে শরতের আমেজ আবার দেখতে পান বুতোং নদীর তীরে। চীনা ভাষা বুতোং কথাটির অর্থ বরফে পরিণত হয় না। এ নদী কোনো মৌসুমে বরফ হয় না। নদীর জলের হালকা স্রোত এবং তীরে সোনালি রঙিন গাছপালা যেন ব্রাশের মতো আপনার হৃদয়ে ছবি এঁকে যায়।
প্রশ্ন: আপনি রডোডেনড্রন গাছ দেখেছেন? বাংলার মানুষ কি রডোডেন্ড্রন গাছ চেনে বা জানে?
হাংচৌ
হাংচৌ চীনের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত চ্যচিয়াং প্রদেশের রাজধানী ও সর্বাধিক জনবহুল শহর। এটি উত্তরাংশের শাংহাই নগরের কাছে, ছিয়াং থাং নদীর মোহনার উত্তর তীরে, হাংচৌ উপসাগরের মাথায় অবস্থিত একটি বন্দর শহর। শহরটি নৌপথের মাধ্যমে দক্ষিণ দিকে চ্যচিয়াং প্রদেশের অভ্যন্তর ভাগের সঙ্গে সংযুক্ত। অন্যদিকে শহরটি চীনের প্রাচীন মহাখালের দক্ষিণ প্রান্তসীমার বন্দর, ফলে এটি উত্তরের ইয়াংচি নদীর ব-দ্বীপ অঞ্চলে বিস্তৃত খাল ও জলধারা নেটওয়ার্কের সঙ্গেও সংযুক্ত। মহাখালের হাংচৌ সংলগ্ন অংশটি ৬১০ খ্রিস্টাব্দে নির্মাণ করা হয় এবং এটি একটি ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী স্থান।
চার দিকে ঘিরে চীনের বৃহত্তম বাণিজ্য ও শিল্পনগরী শাংহাইসহ বেশ কয়েকটি শহর ঘিরে থাকলেও হাংচৌ শহরটি অবসর কাটানোর জন্য শান্তিপূর্ণ একটি শহর। হাংচৌ শহর জাতিসংঘের শ্রেষ্ঠ বসতির পুরস্কার লাভ করেছে এবং বিশ্বের সংশ্লিষ্ট সংস্থা কর্তৃক আন্তর্জাতিক ‘উদ্যানশহর’ হিসেবে ঘোষিত হয়েছে।
শহরটি থিয়েনমু (স্বর্গের চোখ) নামের এক সুদৃশ্য পর্বতমালার পূর্ব পাদদেশে, বিখ্যাত শি হু (“পশ্চিম হ্রদ”) হ্রদের তীরে অবস্থিত। হ্রদটির সৌন্দর্য নবম শতক থেকে চীনের অনেক সাহিত্যকর্ম ও চিত্রকর্মে চিত্রিত হয়েছে। এটি চীনের সম্রাটদের একটি পছন্দের অবকাশযাপনস্থল ছিল। পর্যটকরা সুদৃশ্য শি হু বা পশ্চিম হ্রদের তীরবর্তী বহু প্রাচীন মঠ, মন্দির, উদ্যান, খিলান সেতু ও স্মৃতিবিজড়িত পুণ্যস্থান ঘুরে দেখতে পারেন। হ্রদের ভেতরে অনেক ছোট ছোট দ্বীপে নৌকায় ঘুরে আসা যায়। হ্রদের দক্ষিণ তীরে পাঁচ তলাবিশিষ্ট লেইফেং প্যাগোডাটি অবস্থিত, যার মূল কাঠামোটি ৯৭৫ সালে নির্মাণ করা হয়েছিল। শি হু হ্রদটি বর্তমানে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের মর্যাদা লাভ করেছে।
হাংচৌ চীনের অন্যতম একটি প্রাচীন শহর। চীনের সাতটি প্রাচীন রাজধানীর অন্যতম হাংচৌ শহরের রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস এবং সমৃদ্ধ সংস্কৃতি। শহরটি প্রাচীনকালে প্রাচীর দিয়ে বেষ্টিত ছিল। ৬০৬ খ্রিস্টাব্দে শহরটির বর্তমান নামটি দেওয়া হয়। ৯০৭-৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে শহরটি চীনের ইতিহাসের পাঁচ রাজবংশ পর্বের সময় উইউয়ে রাজ্যের রাজধানী শহরের ভূমিকা পালন করে। দক্ষিণ সোং রাজবংশের আমলে (১১২৭-১২৭৯) শহরটি রাজধানী হবার পাশাপাশি একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবেও সুখ্যাতি অর্জন করে। ইতালির ভেনিস থেকে আগত পর্যটক মার্কোপোলো ১৩শ শতকে শহরটি পরিদর্শন করেন। তিনি হাংচৌকে “মর্ত্যের মাঝে স্বর্গ” এবং “বিশ্বের সবচেয়ে সুসজ্জিত শহর” বলে আখ্যা দেন। ১৪শ শতকে পলি সঞ্চয়ের কারণে হাংচৌ বন্দরের নাব্যতা হ্রাস পেলে শহরটির গুরুত্ব কমে যায়।
হাংচৌ চীনের একটি উঠতি প্রযুক্তিকেন্দ্র। এখানেই চীনের সর্ববৃহত্ ইন্টারনেট ব্যবসা বা ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আলিবাবার প্রধান কার্যালয় অবস্থিত। শহরটি ২০১৬ সালে ১১তম জি২০ সম্মেলনের আয়োজন করে।
লু শান বা লু পাহাড়
লু শান বা লু পাহাড় বর্তমান চীনের জাতীয় উদ্যান। লু শানের কাছাকাছি নদী ও হ্রদ আছে। এখানকার পাহাড় উঁচু ও উপত্যকা বেশ গভীর। এখানকার জলবায়ু পাহাড়ি বৈশিষ্ট্যময়। এখানে বছরের ১৯১ দিনই কুয়াশা থাকে। বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ১ হাজার ৯১৭ মিলিমিটার। বার্ষিক গড় আর্দ্রতা ৭৮ শতাংশ। প্রতি বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গড় তাপমাত্রা থাকে ১৬.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গ্রীষ্মকালে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা থাকে ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এখানকার আবহাওয়া হালকা ঠান্ডা ও আরামদায়ক। পাহাড়ের উপর তাপমাত্রা তলদেশের চেয়ে ৭ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস কম থাকে। এটা আসলেই গরমকাল কাটানোর উপযুক্ত স্থান। এখানে ভ্রমণের শ্রেষ্ঠ ঋতু অবশ্যই শরত্কাল।
লু শানের প্রাকৃতিক দর্শনীয় স্থানগুলো প্রধানত পাহাড়ের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত। কিন্তু দর্শনীয় স্থানগুলো বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। এখানকার চলাচলের পথগুলোও কঠিন এবং বিপজ্জনক। পাহাড়ের গুলিং টাউনে কিছু সাংস্কৃতিক সম্পদসমৃদ্ধ স্থান আছে। প্রতিটি স্থাপত্য অথবা প্রতিটি দৃশ্যের পেছনে রয়েছে একেকটি কিংবদন্তি বা ইতিহাস। অফ পিক সিজনে টিকিটের দাম ১৩৫ ইউয়ান। পিক সিজনে ১৮০ ইউয়ান। এক টিকিটে এখানকার সব দর্শনীয় স্থানে যাওয়া যায়। তবে, দু’একটি জায়গায় বিশেষ কয়েকটি স্থান দেখতে নতুন করে টিকিট কাটতে হতে পারে।
শরত্কালে তৃণভূমি খুব সুন্দর অঞ্চল। বিপুল হলুদ রঙ আপনার চোখের সামনে ভেসে উঠবে, যেন বিছিয়ে থাকা একটি অসীম চাদর!
হুলুনবেইর
হুলুনবেইর মহা-তৃণভূমি বর্তমানে চীনের সবচেয়ে সমৃদ্ধ ও সুন্দরতম তৃণভূমি। এখানে আছে সবচেয়ে পরিষ্কার নীল আকাশ, সাদা মেঘ এবং শ্রেষ্ঠ ঘাস। যারা তৃণভূমির সুন্দর ছবি তুলতে চান, তাদের এখানে আসতেই হবে। সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্যের পাশাপাশি এখানে আছে বিভিন্ন বিনোদনের ব্যবস্থা। ঘোড়া ও উটে চড়ার সুযোগ পাবেন এখানে। এখানে ঘোড়ার দৌড় প্রতিযোগিতা আপনাকে আকৃষ্ট করবে। প্রতি বছরের জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ তৃণভূমি ভ্রমণের শ্রেষ্ঠ সময়। এর মধ্যে জুলাই ও অগাস্ট মাসে তৃণভূমির ঘাস দেখতে অসাধারণ সুন্দর লাগে। এ সময় মঙ্গোলীয় জাতির বৈশিষ্ট্যময় নাদামু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বিশাল তৃণভূমি ঘুরে দেখতে ভাড়া-করা-গাড়ি বা নিজের গাড়িতে যাওয়া ভালো। গরমকালে এ অঞ্চলে মশার উপদ্রব দেখা দেয়। অতএব আপনাকে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ তৃণভূমিটি ঘুরে দেখতে আপনার অন্তত একদিন লেগে যাবে।
এরকুনা জলাভূমি
একুনা জলাভূমিকে বলা হয় এশিয়ার প্রথম জলাভূমি। এ জলাভূমি বর্তমানে চীনের সবচেয়ে ভালোভাবে সংরক্ষিত ও বৃহত্তম জলাভূমি। সুন্দর ছবি তোলার জন্য এ জায়গাটি উত্তম। বিশ্বের বহু আলোকচিত্রী এখানে আসেন ছবি তুলতে। এ জলাভূমিতে বিশাল এলাকাজুড়ে আছে ঝোপঝাড় দেখা যায়। এখানে নানা ধরনের পশুপাখির বাস। এখানে আনুমানিক ২ কোটি পাখি রয়েছে। এ ছাড়া, জলাভূমিতে লাল-ঝুঁটি সারসের (রেড-ক্রাউন্ড ক্রেইন) শ্রেষ্ঠ প্রজননকেন্দ্র। বিলুপ্তপ্রায় ‘সোয়ান গুজ’ (এক ধরনের বিরল ও বড় রাজহাঁস)-এর বিচরণস্থলও এই জলাভূমি। এ অঞ্চলে ৭২০ মিটার উঁচু একটি পাহাড়ে আরোহণ করলে পুরো জলাভূমি একসঙ্গে দেখা যায়। তবে, যারা পাহাড়ে চড়তে পারেন না, তারা জলাভূমির বিশেষ যানে চড়ে পুরো এলাকা ঘুরে দেখতে পারেন। জলাভূমিটি ঘুরে দেখতে এক থেকে দু’ঘণ্টা সময় লেগে যাবে।
রুবি/তৌহিদ/শিখা