শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ০৪:১৭ অপরাহ্ন

চায়না টাউনের গিফটশপগুলোতে মন্দাভাব

  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ২৫ জুলাই, ২০২৪

নিউইয়র্কের বাণিজ্যিক রাজধানী ম্যানহাটানের ডাউনটাউনের ‘চায়না টাউন’ খ্যাত ক্যানেল স্ট্রিটসহ আশেপাশের এলাকায় পর্যটকদেরকে কেন্দ্র করে প্রায় দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে গড়ে ওঠে গিফটশপ। বিশেষ করে প্রতি বছর গ্রীষ্মে এসব গিফটশপগুলো মুখর থাকতো পর্যটকদের আনাগোনায়। প্রতিদিন কয়েক লক্ষাধিক ডলারের বাণিজ্য হতো এসব গিফটশপে। কিন্তু চলতি বছরে এসব গিফটশপে মন্দাভাব বিরাজ করছে। এতে ভাটা পড়েছে কর্মসংস্থানেও।

সরেজমিনে চায়না টাউন খ্যাত ক্যানেল স্ট্রিটসহ আশেপাশের এলাকার গিফটশপে গিয়ে দেখা যায় ক্রেতা তুলনামূলক কম থাকায় অলস সময় পার করছেন শপের মালিক ও কর্মীরা। কোন কোন দোকানে ২ থেকে ৪জন ক্রেতা রয়েছেন। গিফটশপে ব্যবসায়ী ও কর্মীরা জানান প্রতি বছর মে থেকে নভেম্বর পর্যন্ত পর্যটকরা ঘুরতে আসতেন চায়না টাউনের ক্যানেল স্ট্রিট ও আশেপাশের এলাকায়। পর্যটকদের কেন্দ্র করে চায়না টাউনে গড়ে ওঠে ইটালিয়ান, চায়নিজ রেস্টুরেন্ট ও বাহারি পণ্যের পসরা নিয়ে সাজানো গিফটশপ। এ এলাকায় প্রায় অর্ধশতাধিক বাংলাদেশী মালিকানাধীন গিফটশপ রয়েছে। গিফটশপগুলোতে রয়েছে নানা ব্র্যান্ডের পারফিউম, পুতুল, টি-শার্ট, বাচ্চাদের খেলনা, কসমেটিক্স, ব্যাগ, ক্যাপ, জুয়েলারীসহ হরেক রকম গিফট আইটেম। এ সময়ে গিফটশপ ও রেস্টুরেন্টের মূল ক্রেতা ছিলেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পর্যটক ও যুক্তরাষ্ট্রের সবকটি স্টেট থেকে নিউইয়র্কে ঘুরতে আসা আমেরিকানরা। আর এ সময়কে কেন্দ্র করে ব্যবসায় আশায় এসব গিফটশপে ও রেস্টুরেন্টে নতুন করে লোক (কর্মী) নিয়োগ দেওয়া হতো। আবার এসব কর্মীর ৯০ শতাংশ বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশ থেকে নিউইয়র্কে আসা নতুন অভিবাসীরা।

কিন্তু চলতি বছর সামারের প্রায় তিন মাস পার হয়ে গেলেও কাঙ্খিত ক্রেতার অভাবে ব্যবসায় মন্দাভাব দেখা দিয়েছে এসব এসব গিফটশপে ও রেস্টুরেন্টে। অন্যান্য বছর ছোট একটি গিফটশপে গড়ে ৩ থেকে ৪ হাজার ডলার এবং বড় গিফটশপে ৮ থেকে ১০ হাজার ডলার ব্যবসা হলেও এ বছর দিনে গড় ব্যবসা অর্ধেকেরও কম। কোন কোন দিন ৪ থেকে ৫শত ডলারের ব্যবসা হয় না গিফটশগুলোতে। আগের বছরগুলোতে গিফটশপের মালিকরা এ সময় সন্ধান করে নতুন কর্মী নিয়োগ দিতেন। নিউইয়র্কে আসা নতুন অভিবাসীদের অনেকেই প্রতিদিন ‘চায়না টাউন’ খ্যাত ক্যানেল স্ট্রিটে কাজের সন্ধানে গিয়েও কাজ পাচ্ছেন না। উল্টো আগের কর্মীদের কর্মঘণ্টা ও পারিশ্রমিকও কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে।

নাম প্রকাশ না করা শর্তে ক্যানেল স্ট্রিটের গিফটশপের এক কর্মী বাংলা পত্রিকা’র এ প্রতিবেদককে বলেন, তিন বছর ধরে গিফটশপে কাজ করছি। এখানে আমিসহ আরো ৭ জন কাজ করছি নিয়মিত। গত মাস থেকে ব্যবসা ভালো না হওয়ায় মালিক দোকানের তিনজন কর্মী কমিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কাজ হারানোর ভয়ে আগে প্রতি ঘণ্টায় যা পেতাম তার থেকে ৩ ডলার কমে এখানে কাজ করতে বাধ্য হয়েছি। ব্যবসা ভালো হলে আগের মতো বেতন পাবো। আগে এ সময় ক্রেতাদের সামলাতে ব্যস্ত থাকতে হতো। গত বছর আমি নিজেই সামার সিজনের কাজের জন্য ৫ জন কর্মীকে এনে দিয়েছিলাম। এ বছর নিউইয়র্কে আসা নতুন আমার পরিচিত অনেকেই আসেন। চলতি বছর ব্যবসা ভালো নেই তাই নতুন কেউই কাজ পাচ্ছেন না।

বাংলাদেশের সিলেটের হবিগঞ্জের বাসিন্দা তুহিন তালুকদার। দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে আমেরিকা প্রবাসী তিনি। চায়না টাউনের মার্লবেরি স্ট্রিটের লিটল ইটালি নামে পরিচিত টি এন আর নামে গিফটশপের স্বত্তাধিকারী। তার শপের আশেপাশে প্রচুর ইটালিয়ান রেস্টুরেন্ট ঘেরা। মূলত: ইতালিয়ান রেস্টুরেন্টের খাবারের স্বাদ নেওয়ার জন্যই আমেরিকার বিভিন্ন স্টেটের পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে টুরিস্ট আসেন এই ক্যানেল স্ট্রীটে। পর্যটক নির্ভর এখানকার গিফটশপ ব্যবসা।

তুহিন তালুকদার বলেন, এ বছর সামার টাইম শুরু থেকেই টুরিস্ট সংখ্যা কমে যাওয়ায় গিফটশপ ব্যবসায়ে মন্দা দেখা দিয়েছে। আগে এমন সময় ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড় থাকতো। এখন সপ্তাহে দুই একদিন সামান্য ব্যবসা হচ্ছে। বাকি দিনগুলোর ব্যবসা একেবারেই খারাপ। আগে কম হলেও ৬ থেকে ৭ হাজার ডলার ব্যবসা হতো। এখন হাজার পনেরো’শ ডলার ব্যবসা হয় না। এমনটি হবে ভাবিনি কখনো। কর্মীদের বেতন দিতে হিমশিম খেতে হয়। বাধ্য হয়ে আমার দোকানের দুই কর্মীর কাজের সময় কমিয়ে দিয়েছি। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত তারা থাকে। এরপর রাত পর্যন্ত নিজে একাই দোকানের ব্যবসা চালাই।
তুহিন আরো বলেন, আমার দোকানের দুই পাশেই প্রসিদ্ধ ইটালিয়ান রেস্টুরেন্ট। সামার সিজনে ইটালিয়ান খাবারের স্বাদ নিতে উপচে পড়া ভীড় লেগে থাকতো পর্যটকদের। তখন আমার দোকানেরও ব্যবসা ভালো হতো। এখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা এসব রেস্টুরেন্টে কাস্টমার নেই। আগে যখন নতুন আসা বাঙালী যুবকরা কাজের সন্ধানে আসতেন তখন আমার দোকানে নিয়োগ দিতাম। আমার এখানে কাজ না দিতে পারলে এসব রেস্টুরেন্টেও তাদের কাজের ব্যবস্থা করে দিতে পারতাম। এ বছর যারাই আসছে তাদের জন্য কিছুই করতে পারছিনা। এ বছর নির্বাচন এবং বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক অস্থিরতায় পর্যটকরা কম আসছেন। আরো ৩/৪ মাস আছে, দেখা যাক হয়তো শেষ সময়ে পর্যটক আসলে ব্যবসা কিছুটা ভালো হবে।

ক্যানেল স্ট্রীটের গিফটশপের কর্ণধার সমীর রঞ্জন ঘোষ বলেন, এখানে গত ১৪ বছর ধরে এ ব্যবসায় আছি। এখানে গিফটশপসহ পর্যটকনির্ভর প্রায় ২৫০ এরও অধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এ বছরে শহরের শুধু গিফটশপ না রেস্টুরেন্টসহ পর্যটকনির্ভর ব্যবসায় এমন মন্দা দেখিনি। সারাদিনে যা ব্যবসা হয় আগের বছর গুলোর তুলনায় এখন প্রায় ৪০ শতাংশ কমেছে। আগে আমার এখানে ৬ জন লোক কাজ করতেন। এখন মাত্র দুইজন আছেন। ব্যবসায় এমন প্রভাব পড়ার কারণ সামনে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন ও ইউক্রেইন-রাশিয়া এবং গাজারয় যুদ্ধে বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অস্থিরা হতে পারে। তাই হয়তো এখানের ব্যবসার মূল ক্রেতা পর্যটকরা কম আসছেন। তবে এমন মন্দা খুব সহসাই কেটে যাবে হয়তো।

লিটিল লিটিল গিফটশপের কর্ণধার আব্দুর রাকিব জানান, প্রতি বছরের মতো এ বছর সামার সিজনে পর্যটক আসবে। ভালো ব্যবসা হবে এই আশায় দোকানে পারফিউম, পুতুল, টি-শার্ট, ব্যাগসহ গিফট আইটেম তুলেছি। কিন্তু পর্যটক অনেক কম। আগে রাস্তায় পর্যটকদের আনাগোনায় জমজমাট ছিলো। এখন বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হাতে গোনা কয়েকজন টুরিস্টের দেখা মিলে। সারাদিনে আগে ৪ হাজার ডলার গড়ে ব্যবসা করতাম। বড় দোকানগুলোতে ১০ থেকে ১২ হাজার ডলার ব্যবসা ছিলো। এখন হাজার ডলার ব্যবসা করতে হিমশিম খাই। এরকম আগামী মাসগুলো যদি মন্দা থাকে তাহলে প্রতিষ্ঠানের রেন্ট দেওয়া কঠিন হয়ে যাবে।

আব্দুর রাকিব জানান, প্রতিদিন কাজের সন্ধানে আমার দোকানে ৫-৬ জন লোক আসে। ব্যবসায় মন্দা তাই কাউকে কাজ দিতে পারি না। এমন মন্দায় আমি নিজেই একজন লোক নিয়েই ব্যবসা পরিচালনা করতে হচ্ছে। আশেপাশের অনেক দোকানে বাধ্য হয়েই কর্মী ছাটাই করতে হচ্ছে শপের মালিকদের।

তাদের মতো একাধিক ব্যবসায়ী জানান, এ এলাকার এমন পরিস্থিতি গত ১৫ বছরে দেখেননি। চায়না টাউনে পর্যটকনির্ভর ব্যবসায় অনেকটাই মন্দাভাব চলছে। ব্যবসায় মন্দার প্রভাবে প্রবাসী বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের মাঝে হতাশার সৃষ্টি হয়েছে। এ সিজনে মন্দাভাব কেটে আবারো প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে পাবে চায়না টাউনের ব্যবসা এবং কর্মসংস্থানেরও সুযোগ ফিরে আসবে এমনটি আশা করছেন ব্যবসায়ীরা।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com