প্রযুক্তি ও সেবাসহ বিভিন্ন খাতের দক্ষ কর্মীদের যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ অনেক উন্নত দেশেই চাকরির সুযোগ রয়েছে। তাদের অনেকেই চাকরি নিয়ে ওইসব দেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। অনেকে আবার ইউরোপের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ জার্মানিকে অভিবাসনের জন্য পছন্দের তালিকার শীর্ষে স্থান দিচ্ছেন।
দেশে থাকা কর্মীদের দিয়ে জার্মানির চলমান শ্রম সংকট কাটানো সম্ভব নয় বলে মনে করছেন শিল্প সংশ্লিষ্টরা। এমন অবস্থার প্রেক্ষিতে দক্ষ কর্মীর সন্ধানে নানা পরিকল্পনা ও নীতি হাতে নিয়েছে জার্মান সরকার। এরই মধ্যে উত্তর আমেরিকার দেশ ক্যানাডা ভ্রমণ করেছে সরকারে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের একটি দল। মূলত কীভাবে দক্ষ শ্রমিকদের আকৃষ্ট করা যায় সেই অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্যই সফর করেন তারা।
অভিবাসীদের ছাড়া দেশটির বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশলসহ এমনসব খাতে চার লাখ ৪৪ হাজার ২০০ কর্মীর ঘাটতি তৈরি হবে বলে সতর্ক করেছে জার্মানির ইকোনোমিক ইনস্টিটিউট।
এদিকে দক্ষ শ্রমিকদের যারা এরই মধ্যে জার্মানিতে চাকরি নিয়ে এসেছেন তাদের অনেকেই বলছেন, সরকারের এই চেষ্টা সফল হয়েছে।
ভারত থেকে আসা প্রকৌশলী নেইল বলেন, অন্য দেশে না গিয়ে তার জার্মানিতে আসার মূল কারণ হলো দেশটি চায় যে, দক্ষ শ্রমিকেরা এখানে আসুক।
নেইলসহ আরও অনেকেই চাকরি নিয়ে কানাডা বা যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোতে যেতে চেয়েছিলেন। কারণ ওই দেশগুলোর ভাষা ইংরেজি। আর তাই প্রয়োজনীয় ভাষাগত দক্ষতা তাদের এরই মধ্যে রয়েছে।
ইচ্ছা থাকলেও ইংরেজি ভাষার ওই দেশগুলোতে প্রবেশের সুযোগ পাওয়া এত সহজ নয়। যেমন চাকরি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার ভিসা হলো এইচওয়ান-বি। কিন্তু লটারির মাধ্যমে এই ভিসা প্রদান করে যুক্তরাষ্ট্র সরকার। তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসার জন্য চলতি বছর সাত লাখ ৫৮ হাজার ৯৯৪টি আবেদনের মধ্যে এক লাখ ৮৮ হাজার ৪০০টি ভিসা দেওয়া হয়েছে।
শুধু তাই নয়, রয়েছে প্রশাসনিক জটিলতাও। মিশরের সফটওয়্যার প্রকৌশলী মারজান সাদেক জানালেন, যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত তার বোনের ওই দেশের গ্রিন কার্ড বা পার্মানেন্ট রেসিডেন্সি পেতে ১২ বছর সময় লেগেছে।
বাংলাদেশি সফটওয়্যার প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান অবশ্য নিরাপত্তার কথা বলছেন। জানালেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার কথা চিন্তা করেছিলেন। কিন্তু সেখানে প্রায়ই বন্দুক হামলার ঘটনা ঘটে, যে কারণে তিনি যুক্তরাষ্ট্র না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
দক্ষ শ্রমিকদের জন্য উত্তর আমেরিকার আরেক দেশ কানাডাও রয়েছে পছন্দের তালিকায়। কিন্ত এই দেশটিতে অভিবাসনের ক্ষেত্রেও রয়েছে কিছু জটিলতা।
মিশরের সাদেক বলছেন, কানাডার চেয়ে তার পছন্দ ইউরোপ, কেননা ইউরোপে থাকলে তিনি কায়রোতে থাকা পরিবারের কাছ থেকে দূরত্বের দিক থেকে কিছুটা নিকটে থাকতে পারছেন।
এদিকে ভারতের নেইলের মতে, কানাডা অভিবাসীদের জন্য বন্ধুসূলভ হলেও অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নবায়ন করতে না পারলে কানাডামুখী হচ্ছেন। আর কানাডা সরকার এরই মধ্যে অভিবাসীদের বিষয়ে চাপে রয়েছে।
নতুন করে জার্মান ভাষা শিখতে হয় বলে অনেকের কাছেই জার্মানি পছন্দের তালিকায় প্রথম দিকে থাকছে না। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে শিক্ষার্থীরা স্কুল থেকেই ইংরেজি ভাষা চর্চা করে থাকে। যে কারণে ইংরেজি ভাষার দেশগুলো অভিবাসনের জন্য তাদের পছন্দের শীর্ষে থাকে।
তাছাড়া, সেই দেশগুলো আগে ব্রিটিশ কলোনিভুক্ত থাকায় ব্রিটেনের সংস্কৃতির সঙ্গে তাদের কিছুটা পরিচিতি রয়েছে। কিন্তু বর্তমান যুক্তরাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। আর চাকরিপ্রত্যাশীরা বলছেন, সেই দেশটিতে চাকরি পাওয়া অনেকটা কঠিন হয়ে উঠেছে।
মিশরের সাদেক বলেন, ‘বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি আবেদন করে আমি ব্যর্থ হয়েছি।’
চাকরির সুযোগ তুলমূলক বেশি থাকার কারণেই মূলত অনেক অভিবাসনপ্রত্যাশীদের কাছে জার্মানি হয়ে উঠেছে পছন্দের দেশ।
জার্মানিকে পছন্দ করার আরেকটি কারণ হলো দেশটিতে কম খরচে পড়াশোনা করতে পারার সুযোগ পাওয়া। যেমন, ভারত থেকে আসা সিভিল ইঞ্জিনিয়ার থমাস বিনু নিজ দেশে ব্যাচেলর ডিগ্রি শেষ করে স্কলাশিপ নিয়ে জার্মানির একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন।
বিনু জানালেন, ‘আমি যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র বা অস্ট্রেলিয়ায় পড়াশোনা করার চিন্তা করেছিলাম। কিন্তু আমি ভিসা পাইনি। তাছাড়া সেখানে পড়াশোনা করাও খুব ব্যয়বহুল।’
জার্মানির একটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন ভারতের প্রথমেশ সাকপাল। নিজের অভিজ্ঞতার বিষয়ে জানালেন, এখানে (জার্মানিতে) শ্রম আইন মেনে চলা হয়। তাছাড়া পরিবারকে সময় দেওয়ার বিষয়টিও প্রতিষ্ঠানে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়।
তিনি জানালেন, জার্মানিতে অতিরিক্ত সময় কাজ করার প্রয়োজন হয় না এবং ছুটি পাওয়ার সুযোগও বেশি।
সেই তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে দুই সপ্তাহের সাধারণ ছুটি পাওয়া যায়। কখনো কখনো এটি দুই সপ্তাহেরও কম।
বার্লিন-ব্রান্ডেনবুর্গ পরিসংখ্যান দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, জার্মানিতে ভারতীয় অভিবাসীদের সংখ্যা বাড়ছে। ১০ বছর আগে রাজধানী বার্লিনে ভারতীয় অভিবাসীদের সংখ্যা ছিল তিন হাজার ৫৭৯জন। গত বছর এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৩ হাজার ২৫৭ জনে।
তবে জার্মানিতে অভিবাসনের বিষয়টি এতটা সহজও নয়। বাসস্থান খুঁজে পাওয়া অনেক কঠিন। রয়েছে বর্ণবাদ। সেইসাথে ডানপন্থি দলগুলোর উত্থান সমস্যা হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করছেন অনেকেই।
শুধু সামাজিক ও রাজনৈতিক ইস্যুই নয়, ব্যাকরণের জটিল ব্যবহারের কারণে ভাষা শেখাও অভিবাসীদের কাছে অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে। আর বড় শহরগুলোতে বিদেশিদের জন্য জার্মান ভাষা চর্চা করাও কখনো কখনো কঠিন। তার কারণ হলো, বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশিদের এমন জায়গাগুলোতে নিয়োগ দিয়ে থাকে যেখানে দাপ্তরিক কার্যক্রম ইংরেজি ভাষায় পরিচালিত হয়।
মিশরের সাদেক বললেন, ‘রাজধানী বার্লিন শহরে আপনি খুব কমই লোকজনকে জার্মান বলতে শুনবেন।’ জানালেন, জার্মানির ভ্যুর্জবুর্গ শহরে যখন চাকরি করতেন তখন তিনি জার্মান ভাষায় কথা বলার বেশি সুযোগ পেতেন।
ভারতের বিনু জানালেন, জার্মানিতে ভালো মানের ভারতীয় খাবার নেই। তার মতে, ভারতীয় রেস্টুরেন্টগুলো জার্মানদের আকৃষ্ট করতে খাবারে মসলার পরিমাণ কমিয়ে দেয়।
আরেক ভারতীয় অভিবাসী ভার্ষা বললেন, ‘আপনি খাবারের মূল স্বাদ পাবেন না।’ সমাধান হিসেবে তিনি বললেন, ‘আমি নিজে রান্না করি। দেশ থেকে মসলা নিয়ে আসি। কারণ জার্মানিতে ভারতীয় যেই মসলা বিক্রি হয় সেগুলো তার কাছে খাঁটি মনে হয় না।’