ছিংতাও শহরকে সংক্ষেপে ‘ছিং’ বলা হয়। এই শহর চীনের শানতোং প্রদেশের দক্ষিণপূর্ব উপকূলীয় অঞ্চলে অবস্থিত। এর আয়তন ১১,২৮২ বর্গকিলোমিটার। ২০১৭ সাল পর্যন্ত এর স্থায়ী জনসংখ্যা ৯২.৯ লাখ, জিডিপির পরিমাণ এক লাখ দশ হাজার তিনশ ৭২ কোটি ইউয়ান। এটি শানতোং প্রদেশের প্রধান অর্থনৈতিক কেন্দ্র। সমুদ্র তীরবর্তী এ শহরটি ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ শহরটি চীনের সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন শহরগুলোর অন্যতম। একে চীনের ‘হলুদ সাগরের মুক্তা’ বলে ডাকা হয়। এখানে বিভিন্ন দেশের দশ সহস্রাধিক স্থাপত্য নিদর্শন আছে। এখানে আছে বিয়ারের জন্য বিখ্যাত পুরাতন শহর। এখানে আছে উদার মনের উদ্যমী মানুষ। সূর্যাস্তের সময় এখানকার পুরাতন শহর দেখার মতো। এখানকার কুয়াশা-ঢাকা পাহাড় ও সমুদ্র, সুন্দর আবহাওয়া ও বৃষ্টিপাত, বসন্তকালের শুরুতে গাছের নতুন পাতা, বসন্তের শেষে ভূমিতে তুষারের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা চেরি ফল, শরত্কালে পার্কে গিংকো গাছের হলুদ রঙের পাতা, এবং শীতকালে লাও পাহাড়ে তুষার-ঢাকা পর্বতশৃঙ্গ-এ সব কিছুই বেশ আকর্ষণীয়।
চমত্কার আবহাওয়া ও ভৌগোলিক দিক থেকে এর অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায়, প্রাচীনকাল থেকেই বিদেশিরা এই শহরের প্রতি আগ্রহী ছিল। ১৮৯৭ সালে জার্মানি আক্রমণ করে দখল করে নেয় ছিংতাও শহরটি, এ সময় এ শহরটি জার্মানির কলোনিতে পরিণত হয়। পরবর্তীতে ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান জার্মানির কাছ থেকে দখল করে নেয় ছিংতাও।
১৯১৯ সালে এই শহরের সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধারে শুরু হয় ‘৪ঠা মে আন্দোলন’। এরপর ১৯২২ সালে এ শহরটি চীন প্রজাতন্ত্রের অধিকারে আসে। কিন্তু ১৯৩৮ সালে জাপান পুনরায় এ শহরটি দখল করে নেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ‘চীন জাতীয়তাবাদী দল’ ছিংতাওকে আমেরিকার নৌবাহিনীর পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় নৌবহরের প্রধান ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহারের অনুমতি দেয়। পরে ১৯৪৯ সালের জুন মাসে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ‘লাল ফৌজ’ ছিংতাও শহরে প্রবেশ করে এবং তখন থেকে এ শহরটি গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের অধীনে আসে।
আবহাওয়া
শহরের আবহাওয়া অত্যন্ত ভালো, এখানকার বাতাস বেইজিংয়ের মতো শুষ্ক নয়, তুলনামূলক আর্দ্র, এখানে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় আর তাপমাত্রাও বেশ সহনীয়। এ শহরে চারটি ঋতুর পার্থক্য খুবই স্পষ্ট। গ্রীষ্মকালে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়, শরত্কালে আবহাওয়া সবচেয়ে আরামদায়ক, তবে শীতকাল বেশ দীর্ঘ, এ সময় তাপমাত্রা অনেক কমে যায় এবং সমুদ্র তীরবর্তী শহর হওয়ায় বাতাস খুব বেশি থাকে। শহরের বার্ষিক গড় তাপমাত্রা ১২.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস, সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৮.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ১০০ বছরে ধারণকৃত তাপমাত্রায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রার রেকর্ড হচ্ছে হিমাংকের নীচে ১৬.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অগাস্ট মাস সবচেয়ে গরম, এ সময় গড় তাপমাত্রা ২৫.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সবচেয়ে ঠাণ্ডা জানুয়ারি মাসে, এসময় গড় তাপমাত্রা থাকে হিমাংকের নীচে ০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
খাওয়া-দাওয়া
আমাদের বন্ধুদের মাঝে যারা সামুদ্রিক খাবার খেতে ভালবাসেন, তাদের জন্য এখানে আছে নানা ধরনের সামুদ্রিক খাবারের আয়োজন। এখানকার রেস্তোরাঁগুলোতে নানা ধরনের তরতাজা ও সুস্বাদু সামুদ্রিক মাছ পাওয়া যায়। বিশেষ করে রেস্তোরাঁগুলোতে এ্যকুরিয়ামে ভেসে-বেড়ানো সম্পূর্ণ জীবন্ত মাছ থেকে পছন্দমতো মাছ বাছাই করে নেওয়া যায়। তার পর অর্ডার দিলে সেই মাছ আপনার চোখের সামনেই ভেজে বা বারবিকিউ করে বা চীনা স্টাইলে রান্না করে আপনার সামনে হাজির করা হবে। পুরো প্রক্রিয়াটি চোখের সামনে হবে।
থাকার ব্যবস্থা
ছিংতাওয়ের হোটেলগুলোতে পর্যটকদের জন্য নিরাপদ ও আরামদায়ক থাকার ব্যবস্থা আছে। শহরটিতে তিন তারকা হোটেলে এক রাত কাটালে প্রায় ২৭০ ইউয়ানের মতো, চার তারকা হোটেলে এক রাতের জন্য ৫১০, এবং পাঁচ তারকা হোটেলে প্রতি রাতের জন্য ভাড়া ৯৫০ ইউয়ানের মতো। প্রতি অগাস্ট মাসে বিয়ার উত্সবের জন্য হোটেলের ভাড়া কিছুটা বেড়ে যায়।
যাতায়াত ব্যবস্থা
ছিংতাও শহরটি বেইজিং থেকে ৮০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। বেইজিং দক্ষিণ রেল স্টেশন থেকে দ্রুতগতির ট্রেনে মাত্র সাড়ে চার ঘণ্টায় আপনি পৌঁছে যেতে পারেন সমুদ্র তীরবর্তী এ আধুনিক শহরের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করতে। ছিংতাও’এ আছে লিউ থিং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। এ ছাড়া চিয়াও তোং আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর তৈরি হচ্ছে। ২০১৭ সাল পর্যন্ত শহরটিতে ১৫৭টি দেশীয় রুট এবং ২৭টি আন্তর্জাতিক রুট ছিল। তাই চীনের যে-কোনো শহর থেকে এবং বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকেও আপনারা এখানে বেড়াতে আসতে পারেন।
Like this:
Like Loading...