বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ০৬:২২ অপরাহ্ন
Uncategorized

ঘুরে ফেরা ভিয়েনায়

  • আপডেট সময় বুধবার, ১৪ জুলাই, ২০২১
ভিয়েনার সিটি সেন্টারে লেখক

ভিয়েনার সিটি সেন্টারে লেখক

সাইকো অ্যানালিসিসের উদ্ভাবক সিগমন্ড ফ্রয়েডের জন্ম হয়েছিল ভিয়েনায়। এ জন্য অনেকে ভিয়েনাকে ‘সিটি অব ড্রিমস’ নামেও অভিহিত করে থাকেন। বাস্তবেও ভিয়েনা স্বপ্নের মতো সুন্দর। বিশ্বের বিভিন্ন বিখ্যাত সব সিনেমার শুটিংও হয়েছে ভিয়েনাতে।
অন্নদাশঙ্কর রায় ‘পথে প্রবাসে’ উপন্যাসে প্যারিসের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছিলেন: অর্ধেক নগরী তুমি, অর্ধেক কল্পনা। ভিয়েনার ক্ষেত্রেও এই উপমা যাকে বলে যথোপযুক্ত।

ভিয়েনার মেট্রো পরিষেবা

ভিয়েনার মেট্রো পরিষেবা

পাশাপাশি ভিয়েনায় আরও একটি জিনিস আমি লক্ষ করেছি। এ শহরের বেশির ভাগ বাসিন্দা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাঁরা শৃঙ্খল জীবনযাপনে অভ্যস্ত। কর্মব্যস্ত ঢাকা শহরকে উচ্চ ডেসিবেলের শব্দ ছাড়া পৃথকভাবে ভাবার অবকাশ নেই। অন্যদিকে ভিয়েনা সম্পূর্ণভাবে নির্ঝঞ্চাট এবং কোলাহলমুক্ত। ‘পিনপতন নীরবতা’ বাগধারাটির বাস্তবিক প্রয়োগ দেখা যাবে ভিয়েনায়।

একটা শহরকে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তুলতে হলে প্রয়োজনীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে হাসপাতাল, ক্লিনিক, সিনেমা, থিয়েটার, পার্কসহ জীবনধারার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানকে শহরের অধিবাসীদের মধ্যে সুষমভাবে বণ্টন করা অত্যাবশ্যক। ভিয়েনা এদিক থেকে অনেকটা সফল। এ কারণে দ্য ইকোনমিস্টসহ বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যম ভিয়েনাকে বেশ কয়েকবার পৃথিবীর সবচেয়ে বাসযোগ্য নগরী আখ্যায়িত করেছে।

অস্ট্রিয়া একই সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং সেনজেনের অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্র। তাই সেনজেনভুক্ত যেকোনো দেশের ভিসা থাকলে অস্ট্রিয়া ভ্রমণ করা যায়। ইউরোপের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ শহর থেকে বাস, ট্রেন—এমনকি অ্যারোপ্লেন–সহযোগে ভিয়েনায় যাতায়াত করা যায়। স্লোভেনিয়ার রাজধানী লুবলিয়ানা থেকে ভিয়েনার দূরত্ব ২৪০ মাইলের কাছাকাছি। পাবলিক বাসে লুবলিয়ানা থেকে ভিয়েনা যেতে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা লাগে।

হাবসবুর্গ সাম্রাজ্যের ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত স্থাপনার একটি শনব্রুন প্যালেস।

হাবসবুর্গ সাম্রাজ্যের ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত স্থাপনার একটি শনব্রুন প্যালেস।

পর্যটকদের জন্য ভিয়েনার প্রধান দর্শনীয় স্থানের মধ্যে রয়েছে শনব্রুন প্যালেস, হফবুর্গ, সেইন্ট স্টিফেন’স ক্যাথেড্রাল, বেলভেডেরে, ভিয়েনা স্টেট অপেরা ইত্যাদি।
হাবসবুর্গ সাম্রাজ্যের ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত স্থাপনার মধ্যে শনব্রুন প্রাসাদ অন্যতম। হাবসবুর্গ সাম্রাজ্যের শাসকেরা গ্রীষ্মকালীন অবকাশ যাপনের জন্য শনব্রুন প্রাসাদে আসতেন। বর্তমানে এই প্রাসাদকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়েছে। রাজকীয় কক্ষ, দুর্দান্ত গ্যালারির সঙ্গে প্রাসাদের সিলিংজুড়ে আঁকা অসাধারণ সব চিত্রকর্ম পর্যটকদের মন ভোলাতে যথেষ্ট। তবে শনব্রুন প্যালেসের মূল আকর্ষণ হচ্ছে সম্রাজ্ঞী মারিয়া থেরেসার সুসজ্জিত প্রদর্শনী কক্ষ। হাবসবুর্গ সাম্রাজ্যের ইতিহাসে তিনি ছিলেন একমাত্র নারী শাসক। যুদ্ধ পরিচালনা থেকে শুরু করে অস্ট্রিয়ার শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার, এমনকি দেশটির আধুনিকায়নেও তাঁর অবদান অনস্বীকার্য।

হাবসবুর্গ সাম্রাজ্যের ইতিহাসে একমাত্র নারী শাসক মারিয়া থেরেসার ভাস্কর্য।

হাবসবুর্গ সাম্রাজ্যের ইতিহাসে একমাত্র নারী শাসক মারিয়া থেরেসার ভাস্কর্য।

ভিয়েনার অন্যতম প্রসিদ্ধ পাবলিক স্কয়ার হচ্ছে মারিয়া থেরেসিয়েন প্লাৎজ। মারিয়া থেরেসিয়েন প্লাৎজে মারিয়া থেরেসার স্মরণে নির্মিত ভাস্কর্যটি পর্যটকদের কাছে ভীষণভাবে সমাদৃত। দর্শনার্থীরা ভিয়েনাতে বেড়াতে এলে এ ভাস্কর্যের সামনে ছবি তোলেন, তাই সার্বক্ষণিক সেখানে ভিড় লেগে থাকে। শনব্রুন প্রাসাদের পাশে রয়েছে টায়ারগার্টেন শনব্রুন; ১৭৫২ সালে স্থাপিত এ চিড়িয়াখানাকে এখন পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন চিড়িয়াখানা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

সেইন্ট স্টিফেন’স ক্যাথেড্রালকে অস্ট্রিয়ার প্রধান ক্যাথেড্রাল হিসেবে উল্লেখ করা যায়। ভিয়েনার সিটি সেন্টারে অবস্থিত অন্যতম বিখ্যাত স্ট্রিট গ্রাবেন থেকে কয়েক গজ হাঁটলে সেইন্ট স্টিফেন’স ক্যাথেড্রালের দেখা মেলে। গ্রাবেনকে ভিয়েনার সবচেয়ে চাকচিক্যময় অংশ বললেও ভুল হবে না। বিভিন্ন স্ট্রিট মিউজিকের সুর সব সময় গ্রাবেনকে মুখর করে রাখে। গ্রাবেনের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত প্লেগ কলাম নামের স্থাপনটি ভিয়েনা শহরের আরও একটি প্রতীক হিসেবে ব্যাপক পরিচিত।

ত্রয়োদশ শতাব্দীতে নির্মিত হফবুর্গ প্যালেস।

ত্রয়োদশ শতাব্দীতে নির্মিত হফবুর্গ প্যালেস।

বেলভেডেরে সমগ্র মধ্য ইউরোপের বারোক স্থাপত্যশৈলীর এক অনন্য নিদর্শন হিসেবে ব্যাপকভাবে সমাদৃত। বর্তমানে বেলভেডেরেকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়েছে। হাবসবুর্গ সাম্রাজ্যের অন্যতম রাজকীয় প্রাসাদ হিসেবে শনব্রুন ও হফবুর্গ প্যালেসের মতো বেলভেডেরেও সমানভাবে জনপ্রিয়। অন্যদিকে অস্ট্রিয়ার বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে ভিয়েনা স্টেট অপেরা।

ছোট–বড় সব মিলিয়ে ভিয়েনায় আশিটির বেশি মিউজিয়াম রয়েছে। এত মিউজিয়ামের ভিড়ে শনব্রুন, হফবুর্গ এবং বেলভেডের—এ তিনটি মিউজিয়াম সবচেয়ে বেশি দর্শকনন্দিত। অন্যান্য মিউজিয়ামের মধ্যে কুন্সহিস্টোরিসচে মিউজিয়াম, লিওপোল্ড মিউজিয়াম, মিউজিয়াম অব ইন্টারন্যাশনাল কনটেম্পোরারি আর্ট ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এতগুলো মিউজিয়ামের উপস্থিতি নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে, অস্ট্রিয়ানরা চিত্রকলা ও ইতিহাসচর্চায় বিশেষ অনুরাগী। বিশ্বের অনেক খ্যাতনামা ব্যক্তিত্বের জন্ম হয়েছে অস্ট্রিয়ায়। এমনকি আমার প্রিয় বিজ্ঞানী ড. আরভিন স্রোডিঙ্গারের জন্মও হয়েছিল অস্ট্রিয়ায়। আমার দৃষ্টিতে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে ড. আরভিন স্রোডিঙ্গার হচ্ছেন শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী যদিও গত শতাব্দীর সেরা বিজ্ঞানী হিসেবে সবার প্রথমে ড. আলবার্ট আইনস্টাইনের নাম সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয়।

টায়ারগার্টেন শনব্রুন, ১৭৫২ সালে স্থাপিত এ চিড়িয়াখানাটিকে এখনও পর্যন্ত পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন চিড়িয়াখানা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

টায়ারগার্টেন শনব্রুন, ১৭৫২ সালে স্থাপিত এ চিড়িয়াখানাটিকে এখনও পর্যন্ত পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন চিড়িয়াখানা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

জার্মানির মতো অস্ট্রিয়ারও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মুখের ভাষা জার্মান। তবে জার্মানির অধিবাসীদের তুলনায় অস্ট্রিয়ানদের আমার কাছে একদম আলাদা মনে হয়েছে। এখন পর্যন্ত চারবার জার্মানি ভ্রমণের সুযোগ হয়েছে। জার্মানির স্থানীয় অধিবাসীরা অনেকাংশে অনুভূতিহীন যান্ত্রিক সত্ত্বার মতো। কাজ, বাসা এবং জার্মান বিয়ার—এ তিনের মধ্যে তাদের জীবন সীমাবদ্ধ। ইতালিয়ান কিংবা স্প্যানিশদের মতো তারা হাসিখুশি নয়, রসবোধ জিনিসটি তাদের মধ্যে অনেকাংশে অনুপস্থিত। এসব দিক বিবেচনায় অস্ট্রিয়ানরা অনেকটা ভিন্ন প্রকৃতির। জার্মানিতে বসবাসরত অধিবাসীদের তুলনায় আমার কাছে অস্ট্রিয়ানদের অনেক বেশি বন্ধুবৎসল মনে হয়েছে।

অস্ট্রিয়ায় আমার এক পরিচিত বড় ভাই আছেন, ভিয়েনায় গেলে মাঝেমধ্যে তার সঙ্গে দেখা করি। একবার তার বাসা থেকে ফেরার সময় আচমকা এক ছোট বাচ্চার দেখা পাই। বাচ্চাটির বয়স খুব বেশি হলে চার হবে। আমাকে দেখামাত্র সে জার্মান ভাষায় অভিবাদন জানাল, গুটেন আবেন্ড—অর্থাৎ শুভ সন্ধ্যা। কিন্তু আমি বাচ্চাটিকে দেখেও না দেখার ভান করলাম। এর কারণ আমার পূর্বাভিজ্ঞতা। এই প্রসঙ্গ না হয় জানানো যাবে পরের পর্বে।

লেখক রাকিব হাসান

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com