বগুড়া শহর থেকে উত্তরে ১৩ কিলোমিটার দূরে করতোয়া নদীর তীর ঘেষে প্রাচীনকালে মহাস্থানগড় ছিল বাংলার রাজধানী; যার নাম ছিল পুণ্ড্রনগর, ইতিহাসে যা পুণ্ড্রবর্ধন নামে পরিচিত। মৌর্য ও গুপ্ত রাজবংশের প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে মহাস্থানগড়ের উৎপত্তি হয়। মহাস্থানগড়ের আয়তন দৈর্ঘ ৫০০০ ফুট এবং প্রস্থে ৪৫০০ ফুট। এখানে মৌর্য ও গুপ্তযুগের সভ্যতার বহু প্রাচীন নিদর্শন পাওয়া গেছে। মহাস্থানগড় যুগের ধ্বংসাবশেষের আয়তন প্রায় ৭৮ বর্গ কি.মি.। এখানে রয়েছে প্রাচীনকালের তৈরি একটি ভাঙ্গা দূর্গের ভিতরে ৪ মিটার দৈর্ঘ ও ১ মিটার প্রস্থ একটি পাথর এবং মৌর্যযুগের শীলালিপি পাওয়া যায়।
আড়াই হাজার বছর আগের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে বুকে ধারণ করে গড়ে উঠেছিল বগুড়ার মহাস্থানগড়। বগুড়ার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া উত্তরাঞ্চলের এককালের বিশাল করতোয়া নদীবিধৌত মহাস্থানগড়ের ইতিহাস অত্যন্ত চমকপ্রদ। বগুড়া জেলার এক গৌরবোজ্জ্বল কীর্তি খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দী থেকে পঞ্চাশ শতাব্দীর মধ্যে একটি সমৃদ্ধিশালী জনপদ হিসেবে গড়ে ওঠে। এখানে মৌর্য, গুপ্ত ও পাল রাজাদের প্রাদেশিক রাজধানী ছিল। কিন্তু এখন সেই রাজধানী নেই, রয়েছে ইতিহাসের পাতায় বাংলাদেশের সব প্রাচীন নগরীর ধ্বংসাবশেষ ও প্রত্নতাত্ত্বিক বহু নিদর্শন। ঐতিহাসিক মহাস্থানগড় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব লীলাভূমি। মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান হিসেবে মহাস্থানগড়ের ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে।
মহাস্থানগড়ের বিশাল ঐতিহাসিক পটভূমি থাকায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ও দেশের বাহিরের বহু নারী-পুরুষ প্রতিদিন এখানে আসে। ধীরে ধীরে মহাস্থানগড় হয়ে উঠছে অন্যতম বিনোদন এলাকা। একটু খানি বিনোদন পাওয়ার আশায় প্রতিদিন দেশ-দেশের বাহিরের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এখানে শত শত নারী-পুরুষ আসে। বিশেষ করে, মুসলমান ও হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠানের দিনগুলোতে উপচেপড়া ভিড় লক্ষ্য করার মতো। ইতিহাস থেকে পাওয়া যায়: মহাস্থানগড়ের নামকরণ নিয়ে রয়েছে বিপত্তি। কেউ কেউ বলেন, মহাস্নান থেকে এর নামকরণ করা হয়েছে মহাস্থানগড়, আবার কারো মতে মস্তবড়গড় থেকে নামকরণ হয়েছে। বিখ্যাত শাহ সুলতান বলখী মাহীসাওয়ার ক্ষত্রীয় নরপতি পশুরামকে পরাজিত করে এখানে ইসলামের বিজয় পতাকা উত্তোলন করেন। তার মাজারটি মহাস্থানের দক্ষিণপূর্ব কোণে অবস্থিত।
মহাস্থানগড়ের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের গুরুত্ব উপলব্ধি করে ১৯৬৭ সালে করতোয়া নদীর কিনারা ও মহাস্থানগড়ের টিলা সংলগ্ন এলাকায় প্রতিষ্ঠা করা হয় প্রত্নতাত্ত্বিক এই জাদুঘর। গণপ্রজতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় সেটি দেখাশোনা করে। উত্তরাঞ্চলের ঐতিহাসিক স্থানগুলো মহাস্থানগড়, দিনাজপুর, পাহাড়পুর, শেরপুর, রানী ভবানীপুর এলাকা থেকে বিভিন্ন সময়ে উদ্ধার করা প্রাচীন সামগ্রী ধীরে ধীরে জাদুঘরে রুপ নিতে থাকে। হাজার হাজার বছর পূর্বের সোনা, রুপা, লোহা, ব্রোঞ্জ, পাথর, পিতল,কাঁসাসহ বিভিন্ন মূল্যবান ধাতব পদার্থ ও পোড়ামাটির তৈরি মূর্তি, আত্মরক্ষার জন্য ধারালো অস্ত্র, নিত্যপ্রয়োজনীয় তৈযশপত্র ইত্যাদি সামগ্রী দিয়ে শোভাবর্ধন করে মহাস্থানগড় জাদুঘরের। প্রায় সাড়ে তিন হাজার মিটার দৈর্ঘ্য, আড়াই হাজার মিটার প্রশস্ত ও উঁচু টিলাবেষ্টিত বগুড়ার মহাস্থানগড়ের নৈসর্গিক দৃশ্য দেখতে প্রতিদিন হাজার হাজার নারী-পুরুষ ভিড় জমায় এখানে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শিক্ষা সফরের জন্য পছন্দনীয় স্থান মহাস্থানগড়ের মতো ঐতিহাসিক এ স্থানকে।
আড়াই হাজার বছর আগের মানুষের তৈরি ইমারতগুলো এখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বছরের সব সময় দেশ-দেশের বাহিরের পর্যটকরা এখানে আসেন। মহাস্থানগড়ের সুউচ্চ টিলার ওপর হজরত শাহ সুলতান বলখীর (রহ.) মাজারে কেউ আসেন জিয়ারত করতে, কেউ আসেন মহাস্থানগড়ের ধ্বংসাবশেষ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের নানা তথ্য-ইতিহাস জানতে ও দেখতে। দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, গবেষক, বিশেষজ্ঞরা শিক্ষা সফরের সুন্দর স্থান হিসেবে বেছে নিয়ে এখানে এসে থাকেন। মহাস্থানগড় জাদুঘর ফিল্ডে সৃষ্টি করা হয়েছে রঙ-বেরঙের ফুলবাগান। জাদুঘরের চারপাশে নানা জাতের গাছ লাগিয়ে এর সৌন্দযবর্ধন আরও বাড়িয়ে তোলা হয়েছে। দূর-দূরান্ত থেকে আগতদের জন্য মহাস্থানগড়ের টিলাসংলগ্ন আমবাগানে গড়ে তোলা হয়েছে পিকনিক স্পট। দেশ-বিদেশের ভিআইপিদের জন্য করতোয়া নদীর ওপর অত্যন্ত সুন্দর পরিবেশে তৈরি করা হয়েছে আধুনিক ইমারত।
জাদুঘর কাস্টোডিয়ানের (জিম্মাদর) অনুমতি নিয়ে সেখানে অতিথিরা থাকতে পারেন। মহাস্থানগড় ও এর আশপাশের যেসব ঐতিহাসিক নিদর্শন আজও তার ঐতিহ্য নিয়ে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে, সেগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি নিদর্শনের নাম এখানে উলেখ করা হলো : ১. খোদার পাথর ভিটা, ২. মানখালীর কুণ্ড, ৩. জীবিত কূপ বা জিয়ত কুণ্ড বা জিয়ন কূপ, ৪. বৈরাগীর ভিটা, ৫. বন্দুকধরা, ৬. হাতিবান্ধা, ৭. হাতিডোবা পুকুর, ৮. ধোপাপুকুর বা ধোপা পক্রা, ৯. মনিরঘোন, ১০. শিলাদেবীর ঘাট, ১১. গোবিন্দভিটা, ১২. কালিদহ সাগর, বিষপত্তন ও পদ্মার বাড়ী, ১৩. গোকুলের বেহুলা লক্ষীন্দরের মেধ বা মেড়, ১৪. মথুরা, ১৫. চিঙ্গাশপুর, ১৬. ভীমের জাঙ্গাল, ১৭. কাঞ্জিরহাঁড়ি এবং ছেলীরধাপ, ১৮. ভাসু বিহার, ১৯. সম্রাট ফারুক শিয়ারের আমলের মসজিদ, ২০. গোদার ধাপ, ২১. কানাইয়ের ধাপসহ আরও শতাধিক উলেখযোগ্য প্রাচীন ঐতিহ্য।