পাহাড়ের কথা মনে হলেই চোখে ভেসে ওঠে পার্বত্য অঞ্চলের বিশাল বিশাল পাহাড়ের কথা। যেখান যাওয়া-আসা আর ট্র্যাকিং, সব মিলিয়ে দিন দুয়েকের ব্যপার। তাই অনিচ্ছা থাকা সত্বেও ওই দিকটা আমাকে বাদ দিতেই হয়। আর প্রাধান্য দিতে হয় একদিনে ঘুরে আসা যায় এমন পাহাড়ের কথা। সাথে যদি সাথে ঝর্ণা তাহলে তো সেরের ওপর সোয়া সের। তাই আপাতত ছুটির দিনগুলো প্রাধান্য পায় চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড। কারণ এই একটি জেলাতেই আছে পাহাড়ের সারি আর গোটাদশেক ঝর্ণা।
মূল কথায় আসি, সীতাকুন্ডের পন্থিছিলায় ঝরিঝরি ট্রেইল আর মূর্তি ঝর্ণায় গিয়েছিলাম। এই ট্রেইলটি তেমন একটা পরিচিত না তাই লোক সমাগম কমই বলা চলে। আমরা ডে-ট্রিপ থেকে কয়েকজন মিলে গিয়েছিলাম এই ঝরঝরি ট্রেইলে। সায়দাবাদ গোলাপবাগ থেকে আমরা শ্যামলী পরিবহনের চট্টগ্রামের রাত ১১ টার গাড়িতে চড়েছিলাম। রাস্তায় প্রচন্ড জ্যামের উপেক্ষা করে আমরা ভোর সাড়ে ৪ টায় গিয়ে নামি সীতাকুন্ডে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে। পরে সেখান থেকে পেছনের বাজারে খোলা থাকা একটি চায়ের দোকানের সামনে যাই। আর অপেক্ষা করি দিনের আলো ফোটার। কারণ দিনের আলো ফুটলেই এখান থেকে আমরা পন্থিছিলা যাওয়ার অটোরিকশা বা সিএনজি পাবো। অতঃপর সিএনজি করে চলে যাই পন্থিছিলা বাজারে। সীতাকুন্ড থেকে পন্থিছিলা বাজারে যেতে সময় লাগে মাত্র ১০ মিনিট।
এরপর ওখানেই একটা হোটেলে আমরা সকালের নাস্তাটা সেরে নেই। তবে এখানেও অপেক্ষা করতে হয়েছিলো প্রায় আধা ঘন্টা। কারণ ৭টার আগে এই জনপদের মানুষ খুব কমই বের হয়। আমাদের নাস্তা শেষ করতে করতে প্রায় আটটা বেজে গেলো। মুদি দোকান থেকে সরিষার তেল কিনেছিলাম গায়ে মাখবো জোঁকের ভয়ে। যদিও জোঁক মানেনি সরিষার তেল। হালকা পাতলা কিছু কেনাকাটাও করেছিলাম। পাহাড়ে যেহেতু কোন দোকান নেই তাই হালকা খাবার ও বিশুদ্ধ পানি আপনাকে এখান থেকেই কিনে নিয়ে যেতে হবে।
সকাল ৯টার সময় আমরা পূর্ব দিকে রেললাইনের দিকে হাটা শুরু করলাম। মাত্র পাচ মিনিটের মধ্যেই আমরা রেললাইনের উপর চলে আসলাম। এরপর বাম দিকে রেললাইন ধরে আরো দুই-তিন মিনিট হাটার পর ডান দিকে নেমে গেছে গ্রামের মেঠো পথ। এই মেঠোপথ ধরে ১৫-২০ মিনিট হেটে গেলেই পাওয়া যাবে কানিঝিরি পথের দর্শন।
এই ঝিরি ধরে হেটেই যেতে হবে ঝরঝরি প্রপাত। এখান থেকে ডান দিকে ঝিরি পথ হাটা শুরু করতে হবে। ১৫-২০ মিনিটের মতো হাটার পরেই বাম দিকে একটা খাড়া পাহাড়ে উঠতে হবে। আবার খাড়া পাহাড় ধরে নেমে আসলেই পাওয়া যাবে মূল ঝিরি পথ। এই পথ ধরে আর ১০ মিনিট হেটে এগোলেই মিলবে ঝরঝরি প্রপাত।
ঝরঝরি প্রপাতের বাম দিক দিয়ে আরেকটা পাহাড়ের উপরে উঠে সামান্য কিছু দূর হেটে গিয়ে আরেক ঝিরি পথে যেতে হবে। এই ঝিরি পথে হাটতে হাটতে দেখা মিলবে অসাধারণ সুন্দর দুটি ক্যাসকেডের। এছাড়াও এখানে ছোট ছোট কয়েকটা খুমও দেখতে পাবেন। আর ক্যাসক্যাড পার করার ১৫-২০ মিনিট হাটার পর আপনি পৌঁছে যাবেন মূর্তিঝর্ণাতে। আসলে পাহাড় থেকে পানি নামার রাস্তায় অনেকগুলো পাথরের মধ্যে একটিতে মুখের আকৃতির একটি পাথর হয়ে যাওয়ায় স্থানীয়রা অনেকে এটাকে মূর্তি ঝর্ণা বলে।
মূর্তি ঝর্নার খুব কাছে না গেলে রাস্তাটা দেখা যাবে না। ঝিরি পথ থেকে এই মূর্তিঝর্ণায় ওঠাটা একটু কষ্টসাধ্য আবার রোমাঞ্চকরও বলা চলে। কারণ এখানে কোন রাস্তা বানানো নেই। আমরা যেহেতু শীত আসি আসি করছে এমন সময় গিয়েছিলাম তাই পানি কম ছিলো। এরপরও প্রায় বুক সমান পানিতে প্রথমে আমাদের নামতে হয়েছে। এরপর সামান্য হেটে গিয়ে পাথরের উপর লাফ দিয়ে উঠতে হয়েছে।
মূর্তি ঝর্নার মাঝখান দিয়ে উপরে উঠলেই পাওয়া যাবে আরো একটা ঝর্না এবং ক্যাসকেড। তবে এই রাস্তায়ও উঠতে হবে অনেক সাবধানে। কারণ পাথরের উপর শরীরের ভারসাম্য বজায় রেখেই আপনাকে উঠতে হবে। আর নামার সময়ও অনেক সাবধানে নামতে হবে। উপরের ঝর্ণা থেকেও আরো অনেক ভেতরে যাওয়া যায়। কিন্তু সময় কম থাকায় আমরা আর ভেতরে যাইনি। এখানেই গোসল সেরে আবার শহরের পথে রওনা দিয়েছিলাম।
আমরা সকাল ৯ টায় শুরু করে প্রায় সাড়ে ৬ ঘন্টা ট্র্যাকিং শেষে দুপুর সাড়ে তিনটায় পন্থিছিলা বাজারে এসে পৌছাই। এর মাঝে আমাদের সাথে ছিলো একদম হালকা কিছু খাবার ও পানি। যদিও আমরা গোসল করেছিলাম তাই একটু বেশি দেড়ি হয়েছে। তবে চাইলে ৫ ঘণ্টার মধ্যেই এই ট্র্যাকিং শেষ করা যায়।
ঢাকা থেকে চট্রগ্রামগামী যে কোন বাসে উঠে সীতাকুন্ড বাজারে অথবা পন্থিছিলাতে নামতে পারবেন। পন্থিছিলাতে নামতে হলে আগেই বাসের হেলপারের সাথে কথা বলে নিন সে চিনে কিনা। আর রাত হবে অবশ্যই সীতাকুন্ড নামবেন। না হয় আপনাকে একাই বসে থাকতে হবে এই মহাসড়কে। যা একেবারেই নিরাপদ না। চট্টগ্রামের নন এসি বাসে আসতে ভাড়া পড়বে ৪৮০ টাকা। এছাড়াও মেইল ট্রেনে সীতাকুণ্ড, ফেনী বা চট্রগ্রাম নেমে আসতে পারবেন। চট্রগ্রামের শুভপুর বা অলংকার থেকে বাসে সীতাকুণ্ড যেতে পারবেন।
৫-৬ জনের গ্রুপ হয়ে গেলে ভাল। বর্ষার সময় যাবেন তাহলে ঝর্ণার পূর্ণ সৌন্দর্য দেখতে পাবেন। প্রায় ট্রেইল শেষ করতে দিনের অর্ধেক সময়ই যথেষ্ট। তাই যত তারাতারি সম্ভব ট্র্যাকিং শুরু করবেন। তাহলে এক দিনে দুইটি স্থানেও যেতে পারবেন। ঝিরি পথে পানির গতির দিকে খেয়াল রাখতে হবে এবং দেখে সাবধানে পা ফেলতে হবে। অহেতুক তাড়াহুড়া করবেন না। বিশেষভাবে জোক ধরলে অবশ্যই লাফালাফি করবেন না। একদম চুপচাপ থাকুন আর ভ্রমণসঙ্গীকে বলুন ছাড়িয়ে দিতে। নিজে ছাড়াতে পারলে সেটা আরো ভালো।
অবশ্যই পাহাড়ে যাওয়ার সময় হালকা খাবার ও বিশুদ্ধ খাবার পানি ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে যাবেন। তবে ময়লাগুলো ফেলে এসে পরিবেশ নষ্ট করবেন না।
তথ্যসূত্র:সংগৃহীত।