মেঘের স্বর্গরাজ্য হিসেবে পরিচিত দার্জিলিং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত। সেখানে প্রায় সারা বছরই ঠান্ডা থাকে। নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, চা ও রেলওয়ের জন্য দার্জিলিং বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। দার্জিলিং ভ্রমণের অভিজ্ঞতা লিখেছেন এ এস এম শাহীন।
ঢাকা-শিলিগুড়ি সরাসরি ট্রেন চালুর পর থেকেই ভাবছিলাম দার্জিলিং বেড়াতে যাব। তাই ভারতীয় হাইকমিশনে পাসপোর্ট জমা দিয়ে চলমান ভিসাতে ‘বাই রেল নিউ জলপাইগুড়ি’ পোর্ট সংযুক্ত করার আবেদন করলাম। তিন সপ্তাহ পর পাসপোর্ট ফেরত পেয়েই টিকিট কাটলাম শিলিগুড়িগামী মিতালী এক্সপ্রেস ট্রেনের।
বৃহস্পতিবার অফিস শেষে ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন থেকে আধা ঘণ্টায় ইমিগ্রেশন করে সপরিবারে রাত ৯টা ৫০ মিনিটে যাত্রা শুরু করলাম।
৬ ডিগ্ৰি তাপমাত্রা ছিল। সেই সঙ্গে বৃষ্টি। সারারাত ভালো ঘুম হলো। সকালে উঠে নাশতা সেরে রওনা দিলাম লামাহাটার উদ্দেশে। ততক্ষণে রোদের দেখা মিলেছে, ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে মসৃণ পথে এক ঘণ্টার কম সময়ে পৌঁছে কাউন্টার থেকে টিকিট কেটে লামাহাটা ইকোপার্কে প্রবেশ করলাম। ২০১২ সালে এই পার্কের যাত্রা শুরু হয় লামাহাটা গ্রামে। সুন্দর পরিবেশ ও পাইনের ঘন জঙ্গলের কারণে এটি অল্পসময়েই দর্শনীয় স্থানে পরিণত হয়। পার্কের শুরুর দিকে পাহাড়ের ধাপে ধাপে বিভিন্ন ফুল ও অর্কিডের বাগান। কিছদূর ওঠার পর শুধুই ঘন পাইনের গাছ। ঘনত্বের কারণে সেখানে সূর্যের আলো প্রবেশ করা মুশকিল। মেঘের আনাগোনার মাঝে প্রায় এক কিলোমিটার ট্র্যাক করলে জোড়পুকুর বা টুইন লেকের সন্ধান মেলে। ঘণ্টা দুয়েক এখানে কাটিয়ে লেপচা দম্পতির দোকানে মোমো, শিঙাড়া আর চা খেয়ে আবার গাড়িতে উঠলাম পরবর্তী গন্তব্য তিনচুলের দিকে।
আধা ঘণ্টার রাস্তায় চা বাগানের ভেতর দিয়ে ওপরে উঠতে উঠতে মনে হচ্ছিল, কেরালার মুনারে পৌঁছে গেছি। ভৌগোলিক অবস্থান, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর অধিবাসীদের সহযোগিতার ফলে এই ছোট্ট গ্রাম তিনচুলে এখন দার্জিলিং বেড়াতে আসা পর্যটকদের আগ্রহের কেন্দ্র। ৬ হাজার ফুট উচ্চতায় কালিম্পংমুখী তিনচুলের প্রায় প্রতিটি বাড়ি হোমস্টেতে পরিণত হয়েছে। তিনচুলে মনেস্ট্রি ও সূর্যোদয় দেখার জন্য সানরাইজ পয়েন্ট বিখ্যাত।
এর পরের আকর্ষণ ত্রিবেণী। ত্রিবেণীতে খুব সুন্দর পরিবেশে রিভার সাইট ক্যাম্পিং ও রাফটিংয়ের সুযোগ আছে। আমরা ভিউ পয়েন্টে মোমো, পেয়ারা আর চা খেয়ে তাকদহের দিকে রওনা দিলাম। উদ্দেশ্য, চা বাগান দেখতে দেখতে ঝুলন্ত ব্রিজ পর্যন্ত যাওয়া। আমার কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় লেগেছে রংলি-রংলিয়াট চা বাগান, যার বর্ণনা ব্রিটিশ সাহিত্যিক মার্গারেট রুমার গোডেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন এই বাগানে তাঁর বছরখানেক থাকার অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন। ১৯৪৩ সালে বইটি লন্ডন থেকে ‘রুংলি রুংলিওট’ নামে প্রকাশিত হয়। অতুলনীয় এই বাগান পেরিয়ে আমরা চললাম শতাব্দীপ্রাচীন ঝুলন্ত সেতু দেখতে পুমং চা বাগানে। এই সেতু মূলত চা শ্রমিকদের পাতা পরিবহনের জন্য তৈরি করা হয়। কয়েক দশক আগেও এটি ব্যবহারের উপযোগী ছিল। মোটরবাইকের অত্যাচারে এটি এখন বিপজ্জনক অবস্থায় আছে।
পরদিন সকালে নাশতা শেষে গেলাম ঘুম রেলস্টেশনে। এই স্টেশন থেকে বাতাসিয়া লুপ হয়ে প্রায় এক হাজার ফুট নিচে পাহাড়ের রানীখ্যাত দার্জিলিংয়ের অবস্থান। ঘুম স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের ঠিক উল্টো দিকেই দার্জিলিং হিমালয়ান রেলের মিউজিয়াম, যেখানে আরও অনেক কিছুর সঙ্গে এই রুটের প্রাচীনতম ইঞ্জিন ও একটি বগি সংরক্ষিত আছে। স্টেশন ছাড়াও এখানে ঘুম মনেস্ট্রি, বাতাসিয়া লুপ ও ওয়ার মেমোরিয়াল ঘুরে দেখা যায়। ঘুম থেকে গন্তব্য লেপচাজগৎ। লেপচাদের এই গ্রাম থেকে খুব সুন্দর কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়। ওক আর পাইনের ঘন ঘেরা বনে যে কোনো হোমস্টে থেকেই সূর্যোদয় দেখার সুযোগ আছে। রাস্তার পাশে গাড়ি রেখে মোমো, সুপ আর চা খেয়ে হাঁটতে শুরু করলাম বনের গভীরে। বিশাল গাছ, বুনো অর্কিড ও পুরু ঘাস দেখে মনে হচ্ছিল অন্য কোনো গ্রহে চলে এসেছি।
দার্জিলিং মিরিক রোডের মাঝামাঝি ইন্ডিয়া-নেপাল সীমান্তে অবস্থিত সীমানা ভিউ পয়েন্ট। এখানে রাস্তা ভারতের ভূখণ্ডে আর তার অন্যদিকে সব নেপালের অন্তর্ভুক্ত। প্রায় ৭৫০০ ফুট উচ্চতার এই ভিউ পয়েন্ট থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা, মানেভঞ্জন শহর ও আশপাশের দৃশ্য চমৎকার। গাড়ি রাস্তার পাশে পার্ক করে বর্গাকার একটি মাঠে অনেকক্ষণ হাঁটাহাঁটির পর জানলাম, এটি নেপাল। নেপালি রেস্তোরাঁয় হালকা খাবার খেয়ে ও কিছু নেপালি চকোলেটে কিনে ফিরতি পথ ধরলাম।
দার্জিলিংয়ের শেষ দিনটি আমরা রেখেছিলাম দার্জিলিং ম্যালে সময় কাটানোর জন্য। ম্যাল অর্থ চৌরাস্তা– আঠারো শতক থেকে এই চৌরাস্তা দার্জিলিংয়ের কেন্দ্রবিন্দু। ৭১০০ ফুট উচ্চতায় নেহরু রোড, ড. জাকির হুসেইন রোড, ইস্ট ও ওয়েস্ট ম্যাল রোডের সংযোগকারী ম্যাল থেকে আকাশ পরিষ্কার থাকলে কাঞ্চনজঙ্ঘাসহ হিমালয়ের ১২টি শৃঙ্গ দেখা যায়। এখানে অভিজাত ও প্রাচীন বুকশপ, খাবার দোকান, পানশালা, স্যুভেনির শপ, কী নেই! ম্যালের তিনটি বিখ্যাত রেস্তোরাঁর অন্যতম গ্লেনারি, বাকি দুটি কুঙ্গা ও কেভেন্টার্স। কেভেন্টার্সে অনেক ভিড় থাকায় ঢুকতে পারিনি আর কুঙ্গা মূলত টিবেটিয়ান মেন্যু সার্ভ করে। তাই ইংলিশ খাবারের অপশনই বেছে নিলাম। রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে দোকানে দোকানে ঢুঁ মেরে কিছু কেনাকাটা করলাম। তার পর ম্যালের বেঞ্চে বসে ভাসমান বিক্রেতাদের বানানো অসাধারণ মোমো আর চা খেলাম। স্থানীয় এক স্কুলের বাচ্চাদের কালচারাল শো দেখতে দেখতে দুপুর পার করে ফিরতি পথ ধরলাম।
কীভাবে যাবেন
দার্জিলিং ও সিকিমে যেতে হলে অবশ্যই শিলিগুড়ি হয়ে প্রবেশ করতে হবে। বাংলাদেশ থেকে সড়কপথে ফুলবাড়ী ও চ্যাংড়াবান্ধা সীমান্ত দিয়ে অথবা মিতালী এক্সপ্রেস ট্রেনে সহজেই শিলিগুড়ি যাওয়া যায়। আকাশপথে শিলিগুড়ির সবচেয়ে নিকটবর্তী বাগডোগরা বিমানবন্দরে কলকাতা থেকে অনেকগুলো ফ্লাইট আছে।
থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা
দার্জিলিং মলের আশপাশে বিভিন্ন মানের অসংখ্য আবাসিক হোটেল ও রেস্তোরাঁ আছে। ইদানীং ভালো পরিবেশ ও সহনীয় খরচের কারণে হোমস্টে পর্যটকদের কাছে বিকল্প হিসেবে জনপ্রিয় হচ্ছে। এখানে অনেক আবাসিক হোটেলে তিন বেলা খাবারসহ থাকার ব্যবস্থাও আছে। তবে আমার কাছে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় ভিন্ন স্বাদের খাবার উপভোগ করাই বুদ্ধিমানের কাজ মনে হয়েছে।